দিবার বন্ধুরা আসাদ জোবায়ের

165

শীতের দিন যেন ব্যস্ত কুটুম। দেরি করে এসে টুপ করে চলে যায়। বিষন্ন বিকেলে ঝুপ করে নেমে আসে সন্ধ্যা। এইসব ভালো লাগে না দিবা’র। ৫টা বাজতে না বাজতেই জানালা বন্ধ করে দিতে হয়। না হলে মা বকাবকি করেন। তার জীবনেও তো এভাবেই হঠাৎ সন্ধ্যা নেমে আসছে। আজ ক’দিন হলো বাইরে বের হতে মানা করে দিয়েছেন বাবা। মা বলেছেন, যদি বাইরে যেতেই হয় ছোট ভাইকে যেন সাথে নিয়ে যায়। আর মাথায় যেন বড় একটা কাপড়ের ঘোমটা দিয়ে যায়।
অথচ বাইরে কতো কাজ দিবা’র। এক জোড়া কাঠবেড়ালির সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়েছে মাস খানেক হলো। বাড়ির পেছনের নারিকেল গাছে উঠা-নামা করে তারা। দিবাকে দেখেই দাঁড়িয়ে যায়। গলা উঁচিয়ে তাকিয়ে থাকে।
– ‘কাঠবেড়ালি কাঠবেড়ালি পেয়ারা তুমি খাও? দুধভাত খাও?’
দিবা কবিতা আবৃত্তি করে। কাঠবেড়ালি দুটি তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কোনো জবাবই তারা দেয় না। আজ দু’দিন দিবা ঘরে বন্দি। কাঠবেড়ালি দুটি নিশ্চয় খুঁজছে দিবাকে। ওদিকে বাবার সবজির বাগানে লাউ ধরেছে। দিবা প্রতিদিন সকালে গিয়ে দেখে আসে সেগুলো কতবড় হলো? দুদিন হলো সে তা পারছে না। লতিফ চাচার খেজুরের বাগানে সকালে গিয়ে গুড় বানানো দেখা, দুপুর রোদে ছোট্ট বাছুরের সাথে দৌড়াদৌড়ি করা, বিকেলে বাঁশঝাড়ে গিয়ে পাখিদের সাথে ছড়াকাটা- আরো কতশত কাজ দিবার। সব বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি স্কুলে যাওয়াও। স্কুলের বন্ধুরা কী ভাবছে? দিবা পড়া পারে না বলে স্কুলে আসছে না? অথচ দিবা তো সব পড়া পারে। ক’দিন পরেই বার্ষিক পরীক্ষা। তাও দিতে পারবে কি না জানে না দিবা।
দিবাকে তার মা-বাবা বন্দি করে রেখেছে। কারণ, তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়ে কী জিনিস? জানে না ১২ বছরের দিবা। এ দু’দিনে শুধু এটুকু বুঝেছে- বিয়ে মানেই সবকিছু বন্ধ হয়ে যাওয়া, নতুন শাড়ি পরে অচেনা একটা বাড়িতে যাওয়া। আর কিছু জানে না দিবা।
পড়ন্ত বিকেল। বাড়ির পেছনের দিকে একটা ঘরে জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে দিবা। তার গাল বেয়ে পড়ছে পানি। রাস্তা দিয়ে একদল পাতিহাঁস হেলে-দুলে হেঁটে যাচ্ছে। সম্ভবত তারা দিবার কষ্টের কথা জানে না। মতিউর চাচা গরু নিয়ে যাচ্ছে। তার পিছে তিড়িং বিড়িং করে যাচ্ছে একটা বাছুর। সেও জানে না দিবার কষ্ট। মশা তাড়াবার জন্য কোনো এক বাড়িতে ধোঁয়া দেয়া হয়েছে। একটু সময়ের মধ্যেই পুরো পাড়া ধোঁয়ায় ঢেকে গেল।
– এই ছুঁড়ি, মশা ঢুকপি, জানলা বন্ধ কর।
পেছন থেকে মায়ের তাড়া খায় দিবা। জানালা বন্ধ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। কাপড় শুকানোর আড়া বাঁশে একটা কাঠবেড়ালি একমনে তার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু দূরে একটা কালো ফিঙে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা কি তাহলে দিবার কষ্ট বুঝতে পেরেছে? জানালা বন্ধ করে বাড়ির ভেতরে চলে আসে দিবা। সেখানে বেশ শোরগোল। কারণ, কালকেই দিবার বিয়ে। কত প্রস্তুতির বিষয় নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। শুধু ব্যস্ততা নেই দিবার। বারান্দায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে আবার ঘরের মধ্যে চলে যায়।
রাত পোহালেই দিবার বিয়ে। বালিশে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কখন সে ঘুমিয়ে গেছে জানে না। ঘুমের মধ্যে সে সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখলো। তার ঘরে কয়েকটা সাদা পরি এসেছে। তাকেও সাদা জামা পরিয়ে দেয় তারা। দুটো ডানা লাগিয়ে দেয় দুটো পরি এসে। তারপর দিবাকে নিয়ে তারা উড়াল দেয়। অনেক দূরে একটা বাগানের মধ্যে নিয়ে যায়। সেখানে অনেক পাখি। সবাই দিবাকে পেয়ে খুব খুশি। পাখিগুলো দিবার চারপাশ দিয়ে উড়তে লাগলো। আর নাচতে নাচতে পরিরা ছড়া কাটতে লাগলো-
ছোট দিবা পরি
আয় খেলা করি
পিঠে দুই ডানা
উড়ে যারে যেথা খুশি
নেই কোনো মানা।
পরিদের সাথে সাথে পাখিরাও ছড়া কাটতে লাগলো। পাখিদের পাখনা দোলানোর শব্দ আর কিচিরমিচির ডাকে অন্যরকম এক পরিবেশের সৃষ্টি হলো। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় দিবার। পাখির ডাক এখনো সে শুনতে পাচ্ছে। পষ্ট। সে জানালার দিকে যায়। শব্দ আরো জোরালো হয়। জানালা খুলে ফেলে সে। শীতের ঠান্ডা বাতাস এসে তার চুল উড়িয়ে দেয়। ভোরের আলোয় সে দেখতে পায় কাপড় শুকানোর আড়া বাঁশে অনেকগুলো পাখি বসে কিচিরমিচির করছে। সবাই দিবার দিকেই মুখ করে আছে। ফিঙে, শালিক, শ্যামা, দোয়েলসহ আরো অনেক পাখি। সব পাখিকেই দিবা চেনে। ওরা যে দিবার প্রতিদিনের বন্ধু। এক পাশে কাঠবেড়ালি দুটিও বসে আছে। সবাই যেন মিটিংয়ে বসেছে, দিবার কষ্ট কীভাবে মুছে দেয়া যায়?
বাড়ির সামনে প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। বরযাত্রী দুপুরের মধ্যেই চলে এসেছে। দিবাকে সাজিয়ে দেয়া হচ্ছে এক ঘরে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ছুটোছুটি করছে বাড়ির এপাশ থেকে ওপাশ। দিবা আড়চোখে দেখছে ওদের। ইশ! এখই দৌড়ে গিয়ে যদি ওদের সাথে যোগ দেয়া যেতো। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। তারই তো বিয়ে। নিজের বিয়ের দিনে কি দৌড়াদৌড়ি করা যায়? যায় না।
এরমধ্যে ঘটে গেল এক অদ্ভুত কান্ড। বিয়ে পড়ানোর প্রস্তুতি চলছে। হঠাৎ একদল পাখি ঢুকে পড়ে প্যান্ডেলের মধ্যে। এক পাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে তারা উড়ে চলে যায়। আর সব বরযাত্রীর গায়ে পায়খানা করে দেয়। এ ঘটনায় বিয়ে পড়ানো এক ঘন্টা পিছিয়ে যায়। মেয়ে পক্ষের লোকজন বালতিতে করে পানি এনে ভিজা গামছা দিয়ে বরযাত্রীদের কাপড় পরিস্কার করিয়ে দেয়। এ খবর চলে যায় দিবার কানেও। সে বুঝতে পারে এটা তার পাখি বন্ধুদের কাজ। নিশ্চয় তারা বিয়ে বন্ধ করার চেষ্টা করছে।
ফের বিয়ে পড়ানোর প্রস্তুতি চলছে। এরমধ্যে ঘটলো আরেক ঘটনা। প্যান্লেডের এক পাশ ধড়াস করে পড়ে গেল। একটা বড় বাঁশ গিয়ে পড়ল ঘটক মশাইয়ের মাথায়। অমনি তিনি চিতপটাং। আরো দুএক জন আহত হলো প্যান্ডেলের নিচে চাপা পড়ে। তাদের ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়া হলো ডাক্তারবাড়িতে। এ খবরও চলে গেল দিবার কানে। এবার সে ফিক করে হেসে দিল। সে বুঝতে পারলো এ কাজ কাঠবেড়ালি দুটির। নিশ্চয় তারা প্যান্ডেলের দড়ি কেটে দিয়েছে।
এদিকে ডাক্তারবাড়ির পাশেই ছিল থানা। খবর পেয়ে বিয়ে বাড়িতে ছুটে এলেন দারোগা বাবু। এসেই কটমট করে জিজ্ঞেস করলেন- কার বিয়ে হচ্ছিল?
দিবার বাবা- আমার মাইয়া দিবার।
– বয়স কতো?
– ১৮ তো হবেই স্যার।
– কোন ক্লাসে পড়ে?
– সে তো অনেক দিন হলো লেখাপড়াই ছাইড়া দেছে স্যার।
এ কথার প্রতিবাদ করে ওঠে দিবার সমবয়সী কয়েকজন। তারা বলে- না স্যার, দিবা স্কুলে যায় তো। ক্লাস সিক্সে পড়ে।
এই কথা শুনে দারোগা বাবু বুঝতে পারলেন, দিবাকে ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে দেয়া হচ্ছে। তিনি আর দেরি করলেন না। দিবার বাবা, বর ও বরের বাবাকে ধরে থানায় নিয়ে গেলেন। বন্ধ হয়ে গেল বিয়ের সব আয়োজন। এই খবরও চলে গেল দিবার কানে। সে দৌড়ে জানালার কাছে দাঁড়ালো। বাইরে হইচই করছে পাখিরা। দিবার বন্ধু ওরা। দিবা জানালার শিক গলে দুই হাত বাড়িয়ে দেয় বাইরে। পাখিরা আরো জোরে চিৎকার করতে থাকে। তারা তো চিৎকার করবেই। তারা যে আজ বড় যুদ্ধ জয় করেছে।