দিবস যাপন

161

ইদানীং প্রতিনিয়ত আমরা সভ্য মানুষরা, কেন জানি খুব উপলক্ষ্যকে খুঁজে বেড়াই নিজেকে প্রদর্শনের জন্য। ব্যাপার টা এমনি ঠেকেছে যে, আমাদের উপলব্ধি গুলোও যেন শামুকের খোলশের ভেতর স্বযত্নে লালিত হতে থাকে কোন না কোন উপলক্ষ্যকে স্বাগত জানানোর অপেক্ষায়। তাই ই যদি না হত, তাহলে নেহায়েত একটি মাত্র দিনের জন্য উৎসব পালনার্থে আমরা সভ্য মানুষরা একত্রিত হতাম না। হতাম না স্লোগানমুখর, করতাম না সভা সেমিনার বা এরকম কিছু। আসলে এসব লেখার পেছনে লেখক হিসেবে আমার খুব যে অভিজ্ঞতা আছে, তাও নয়। আশেপাশের কিছু ব্যাপার সহসাই মনকে বার বার জানান দেয় যে, ‘আমরাই তো পারি পরিবর্তনের নতুন ধারা শুরু করতে আজ থেকে, এখন থেকেই, আর আজ এই উপলক্ষ্যকে ঘিরেই’। শুধু প্রদর্শনের জন্যই নয়, অন্তরাত্মা থেকেই হতে হবে এই সংকল্পের সূচনা।
আবহমান কাল থেকেই বাঙালি আমোদ প্রিয়, অতিথি বৎসল, উপলক্ষ্য আর উপঢৌকন যেন অঙ্গাঙ্গীভাবে আমাদের সাথে জড়িত। প্রতিটি বছরের শুরু থেকেই আমরা উৎসব পালনে অভ্যস্থ। আর আজকাল তার সাথে যুক্ত হয়েছে এইরকম পাশ্চাত্য থেকে ধার করে নেয়া উৎসব পালনের রীতি। যার মধ্যে পরে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’, ‘হেলোইন ডে’, ‘ফ্রেন্ডশিপ ডে’, ‘ফাদারস ডে’, ‘মাদারস ডে’।
প্রসঙ্গটা প্রথমেই টেনে আনলাম না নচেৎ, পাঠক তার আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন। কিছুদিন আগেই ৮ই মার্চ গেল, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। আর আমরা যে নারী স্বাধীনতায় আগের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছি, তার প্রমাণ বিগত তিন দশকের পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। আমি নিজেও একজন নারী হিসেবে এ রকম পদক্ষেপগুলোকে অন্তঃস্থল থেকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু কেন আমরা মা দিবস, বাবা দিবস নামের দিনগুলোকে আলাদা করে দেখছি। এর পিছনে কারণগুলোই বা কিভাবে কাজ করছে।
‘মা’ শব্দটা নিজেই একটা উপাখ্যান, একটা ইতিহাস, একটা অভিধান। যাকে কখনো কোন গল্পে যাবে না বাঁধা। যার ইতিহাস অনেক গভীর, যার মহাত্ব্য লিখে অভিধান ও ফুরাবে না। তাহলে কেন এই সভ্য যুগে এসে আমরা পাশ্চাত্য ঢঙ্গে পালন করতে যাব আলাদাভাবে একটা দিনকে ‘মাদারস ডে’ হিসবে। সন্তান জন্মদানের যে তীব্র শারীরিক কষ্ট, তাকে পালনের জন্য যে ত্যাগ তিতিক্ষা, তাতো কোন দিন দিয়ে উপলব্ধির নয়। তাই যদি হতো কেন তাহলে মা বাবারাও বিশ্বজুড়ে পালন করছেন না, ‘হ্যাপি চিলড্রেনস ডে’।
প্রকৃতপক্ষে, দিবস যাপন ব্যাপারটার প্রচলন শুরু হয় পাশ্চাত্য সংস্কৃতির হাত ধরে, যে দিবসটির আলাদা পরিচিতি দিবসটিকে করে তোলে বৈশিষ্ট্যমÐিত, আর সেটিই হলো সে দিবসের তাৎপর্য। সামনে ১২ মে আসছে ‘বিশ্ব মা দিবস’। আসলে মা ব্যাপারটি আপেক্ষিক, কোন দিবসের পরিসীমায় শব্দটি বেমানান। মানুষ স্বভাবতই স্বার্থপর আর আজকের দিনের প্রেক্ষাপটে নাকি জীবনে যে যত স্বার্থপর সে তত স্বার্থক। কিন্তু একজন ‘মা’ যিনি যেই ধর্মের, যে জাতির, যে কুলেই হোক তাঁকে কি আমরা এই কাতারে সামিল করতে পারি? আমাদের সমাজে একজন মা গার্মেন্টস কর্মী, সেও তার সন্তানের উন্নত ভবিষ্যৎ এর দিকনির্দেশনার জন্যই এত কষ্ট করেন। তাদের দিন শেষে ওভার টাইম করাটাও যেন অতি (ওভার) আনন্দের বটে, কেননা এর ফলে হয়তো সে হারাচ্ছে সন্তানকে দিতে পারা সুন্দর মুহ‚র্তগুলো কিন্তু নিরাপদ করতে পারছে তার সন্তান্দের ভবিষ্যৎ, একেই বলে ‘জীবন যেখানে যেমন’।
আমরা ‘নারী দিবস’, ‘মাতৃদিবস’ নিয়ে এরকম গা ভাসানো রীতিতে সোচ্চার কিন্তু তাদের অধিকার আদায়ে কতটুকু এগিয়ে? পুরুষ শাসিত সমাজটাতে আমাদের অংশগ্রহণটাও বা কতটুকু নিরাপদ? আমরা ‘মা’, ‘বাবা’ দিবস পালন করি ভাল, কিন্তু যে দেশে আজও মা, বাবারা শুধুমাত্র ছেলেমেয়েদের অবহেলার জন্যই জীবন সায়াহ্নে ‘ওল্ড এইজ হোমে’ যান? দিবসগুলো পালনে আমার প্রশ্ন যৌক্তিকতা কতটুকু? তাহলে কেনইবা আমরা “বিশ্ব অবহেলা দিবস” পালন করিনা? জানি এর সুস্পষ্ট কোন উত্তর নেই। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভিয়েতনামও বিগত বছরগুলোতে মা দিবসে মায়ের নিরবচ্ছিন্ন ত্যাগকে সম্মান জানানোর জন্য দেশটির নারীরা শ্লোগানমুখর হয়েছিল কিছু দাবি নিয়ে। দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল বাবারা যদি সংসারের অন্যতম অর্থ যোগানদাতা হন, তাহলে মায়েদের অবদান কি শুধু সন্তান জন্মদান ও পালনে সীমাবদ্ধ? আর যদি তাই হয়, তাহলে হোম মেকার অথবা গৃহিণী হিসেবে সংসারে তাদের প্রতিটি কাজের যথাযত সম্মানী প্রদানে সম্মানিত করা উচিত।তাহলে হয়তো এক জন নারী হতো তুলনামূলকভাবে সংসারের সর্বোঃ অর্থের যোগানদাতা। বিষয়টি সত্যিকারের অর্থেই বিবেচনার যোগ্য, এজন্যই যে মা ও নারীরা আজও যে অবহেলিত পরোক্ষ হোক বা প্রত্যক্ষ তা প্রতীয়মান। হোক তা যেকোন দেশেই।
কোন সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে ছোট করতে নয়, বরং আমার ক্ষুদ্র পরিসরে এই লেখাটা ছিল শুধুমাত্র আমাদের ফ্রেমে বন্দি মন মানসিকতা টাকে বদলানোর কিছুটা অভিপ্রাস মাত্র। তাও যে ফ্রেমটা বাহির থেকে আমদানি করা, আর বন্দি ছবিগুলো আমাদের আবহমান কালের।
আসুন, জীবনকে শুধু জীবন হিসেবেই ভাবতে শিখি, সহজ করে দেখতে শিখি, মানবতার পাশে দাঁড়াতে শিখি।আমাদের আগামী প্রজন্ম যাতে বিবেক জাগ্রতকরে বুঝতে শিখে। একটি মাত্র সেলফি আর হলমার্ক, আর্চিজের উপঢৌকনই যাতে জীবনের মেকি হসি না হয়, বুঝাতে পারি যে এরপরও কিছু বাকি থাকে, বাকি আছে। আর যার সবচেয়ে বড় উপলব্ধি হল আমাদের ছোট্ট জীবনের প্রতিটি দিনলিপি, যাকে বলি ‘দিবস’ আর ভিনদেশি ভাষায় ‘ডে’। সর্বোপরি আমাদের প্রতিটি দিবসই হোক উপলক্ষের ও উপলব্ধির আর তার সাথে আত্মশুদ্ধির।
লেখক : প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ
চট্টগ্রাম ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি