‘দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ’

215

জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ৪০ তম অধিবেশন গত মার্চ মাসের ৬ তারিখে (২০১৯) জেনেভায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার মাইকেল ব্যাচলেট তাঁর বক্তৃতায় বর্তমান বিশ্বে আয় এবং সম্পদে যে ভয়াবহ বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে তাতে বিশ্বের অনেক দেশেই সামাজিক অস্থিরতা আরম্ভ হয়েছে। মানবাধিকার কাউন্সিলে তিনি যে বার্ষিক রির্পোট উপস্থাপন করেছেন তাতে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে আজ সারা বিশ্বে প্রায় দেশে যে সামাজিক নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে, তার মূল কারণই হলো মানুষের মাঝে অকল্পনীয় আকারে আয় এবং সম্পদের মালিকানায় বৈষম্য সৃষ্টি। মানবাধিকার কাউন্সিলে তাঁর বার্ষিক রিপোর্ট উপস্থাপন করতে গিয়ে আয় এবং সম্পদের মালিকানায় যে ভয়াবহ বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে তার সাথে মানবাধিকারের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা বাগ্নিতার সহিত উপস্থাপন করেন। তার মতে আয় এবং সম্পদের এই ভয়াবহ বৈষম্যের সমাধান না করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করার কোন উপায় নেই। তার মতে ‘এই বৈষম্যেই’ বিশ্বের সর্বত্র লাগামহীন ভাবে মানবাধিকার লংঘনের মূল কারণ। তিনি আরও বলেছেন সম্প্রতি ফ্রান্সে, সুদানে এবং হাইতিতে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে তার পিছনেও সম্পদের ও আয়ের একই বৈষম্যই দায়ী। ২০৩০ সালের মধ্যে মানবাধিকার কাউন্সিলের এজেন্ডা বাস্তবায়িত করতে হলে সমস্ত রাষ্ট্রগুলিকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সম্পদের বৈষম্য, ক্ষমতার বৈষম্য, বিচার লাভে বৈষম্য সর্বোপরি মানবাধিকারের মর্যাদা সমভাবে রক্ষা করার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জাতিসংঘের মানবাধিতকার কাউন্সিলের হাই কমিশনারের ভাষায় “To achieve the 2030 Agenda the world’s states need to advance on tackling in-equalities, in-equality of resources, income, Power, access to justice and with respect to the basic conditions for human dignity. অর্থাৎ ‘২০৩০ সালের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বের রাষ্ট্রগুলিকে বর্তমনে প্রচলিত অসাম্যগুলি দূর করতে হবে। সম্পদের বৈষম্য, ক্ষমতার বৈষম্য দূর করতে হবে। ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে। মানবিক মর্যাদা নিশ্চয়তার জন্য মৌলিক শর্তগুলি নিশ্চিত করতে হবে।’
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস সহ দেশটির অন্যান্য অঞ্চলে গত বৎসরের ১৭ নভেম্বর থেকে জনগণ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাকরণ কর্তৃক জ্বালানির উপর ট্যাক্স বৃদ্ধির প্রতিবাদে তীব্র আন্দোলন শুরু করেছে এবং বর্তমানেও তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন সারা দেশব্যাপী তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ফ্রান্সবাসী মনে করেন শুধু দেশের ধনিক শ্রেণির স্বার্থেই প্রেসিডেন্ট জ্বালানির উপর কর বৃদ্ধি করেছেন। ফ্রান্সের সাধারণ মানুষ মনে করে প্রেসিডেন্টের এই পদক্ষেপ সামাজিক কর্মসূচির প্রতি তাঁর অবজ্ঞা এবং সহানূভূতিহীনতায় প্রমাণ করে।
সুদানে প্রেসিডেন্ট বশিরের নেতৃত্বে গত ২০ বৎসর ধরে দেশটিতে একনায়কতন্ত্র কায়েম রয়েছে। বর্তমানে তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে সমস্ত কর্মজীবীদের এবং ছাত্র সমাজের তীব্র আন্দোলন অব্যাহত গতিতে চলছে। সুদানের দুটি বিরোধী রাজনৈতিক দল ও ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট বশিরকে উৎখাতের আন্দোলনে শরিক হয়েছে। বশির এক বৎসরের জন্য দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। ২০১০ সালে হাইতিতে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল। সে ভূমিকম্পে প্রায় ১ লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল। সে দুদর্শাগ্রস্ত হাইতিতে কিছুদিন আগে সামাজিক উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত ৪ বিলিয়ন ডলারের ফান্ড গায়েব হয়ে গেছে। মানুষের ভয়াবহ দুর্গতির মধ্যেও সরকারি তহবিল নিয়ে লুটপাট বন্ধ হচ্ছেনা। হাইতিতে বর্তমানে এব্যাপারে আন্দোলন তুঙ্গে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের পর্যবেক্ষণে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেছে যে, সারা বিশ্বে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে যেভাবে আয়ের এবং সম্পদের বৈষম্য সৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে এবং যা বৎসরের পর বৎসর জ্যামিতিক হারে বাড়ছে, এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে সংশ্লিষ্ট দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ পরিত্রাণের আশায় দেশ ত্যাগ (সরমৎধঃরড়হ) করার সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া অন্যকোন রাস্তা তাদের সামনে নাই বললেই চলে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার মাইকেল ব্যাচলেটের মতে মানুষের সৃষ্ট এই সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য যদি দূর করা না যায়, সেক্ষেত্রে জাতিসংঘের আদর্শ যে তিন স্তম্ভের উপর স্থাপিত যথা-ক. শান্তি ও নিরাপত্তা খ. উন্নয়ন গ. মানবাধিকার, সে স্তম্ভগুলিই ধ্বংস হয়ে যাবে।
গোয়েতামালা, হন্ডুরাস ইত্যাদি দেশের লোক যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, সে সব দেশের সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচির ফলাফল কিছুতেই সাধারণ মানুষের দ্বারে পৌঁছছেনা। গুটিকতক মানুষ ছাড়া প্রায় উন্নয়নশীল দেশগুলির সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টার সুফল সাধারণ মানুষে ভোগ করতে পারছে না। তারা অসহায় হয়ে পেটের জ্বালায় দেশান্তরিত হচ্ছে। অনেকেই দেশান্তরিত হয়ে গিয়ে ভূমধ্যসাগর, আটলান্টিক ইত্যাদি সাগরে লাশ হয়ে ভাসছে। ইউ.এন.ডি.পির সাম্প্রতিক পরিচালিত এক অনুসন্ধানে জানা যায় আয় বৈষম্য ভয়াবহভাবে চলছেই। সবচাইতে ধনী ১০ শতাংশের আয় বিশ্বের সর্বমোট আয়ের ৪০ শতাংশ। আর বিশ্বের সবচাইতে দরিদ্র ১০ শতাংশের আয় হলো মাত্র ২ শতাংশ।
সুইজ্যারল্যান্ডের দ্যাভোসে ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের’ সম্মেলনে কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এর আগে আন্তর্জাতিক বিশ্ব অর্থনৈতিক গবেষণাসংস্থা ‘অক্সফাম’ ধনী গরিবের বৈষম্য নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সুইজারল্যান্ডের দ্যাভোসে ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের’ সম্মেলনে সামনে রেখে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ধনী দরিদ্রের মধ্যে সম্পদের বৈষম্য বাড়ার গতি আগের চাইতেও অত্যন্ত দ্রæতগতিতে চলছে। অচিরেই বিশ্বের প্রায় সম্পদ গুটিকতক মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয়ে যাবে। এই বৎসরের প্রথম দিকে মানবাধিকার কমিশনার ব্যাচেলেট এজেন্ডাগুলি বাস্তবায়নে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অথচ এই এজেন্ডাগুলি নেওয়া হয়েছিল বিশ্বের অসংখ্য প্রান্তিক মানুষের জন্য যারা যুগ যুগ ধরে অবহেলিত, পদ্্দলিত বাস্তচ্যুত, নির্যাতিত এবং অস্পৃশ্য। ২০৩০ সালে ১৭ টি এজেন্ডার মধ্যে ১০নং এজেন্ডায় ছিল মানুষের আয়ের মধ্যে ‘অসমতা হ্রাস করা’ কিন্তু বর্তমানে সবচাইতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে এই ১০ নং এজেন্ডা। কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ‘অক্সফাম’ ধনী গরিবের বৈষম্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে বিশ্বের ২৬ ব্যক্তির কাছে ৩৮০ কোটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সমান সম্পদ রয়েছে। ২০১৭ সালে এই সংখ্যক দরিদ্রগোষ্ঠীর সমান সমপদ ছিল ৪৩ জন ধনকুবরের কাছে। এর আগের বছর এই ধনকুবের সংখ্যা ছিল ৬১ জন। অর্থাৎ সময় আর বেশি নাই যখন ১ জনের কাছে ৩৮০ কোটি নিম্ন আয়ের মানুষের আয় জমা হবে।
আসলে বর্তমানে সারা বিশ্বে যে পুঁজিবাদ কায়েম রয়েছে তা দিয়ে বিশ্বের মানুষের মধ্যে আয়ের সমতা আনা কিছুতেই সম্ভব নয়। পুঁজিবাদের প্রবক্তারা কেমন করে নিজের লভ্যাংশ সর্বাধিক করা যায় সে ধারণার উপর ভিত্তি করে পুঁজিবাদের তত্ত্ব করেছেন। কাজেই এই তত্ত্ব দিয়ে আয় বৈষম্য কমানো কিছুতেই সম্ভব নয়।
২০১৪ সালে বিশ্বের মাত্র ৮৫ জন লোকের কাছে বিশ্বের নিম্ন আয়ের অর্ধেক লোকের সম্পদ পরিমাণ সম্পদ জমা হয়েছিল। এই চিত্র দিনের পর দিন ভয়াবহ হচ্ছে। এর শেষ কোথায়? সেদনি বেশি দূরে নয়, যে দিন মানুষ মনে করবে ধনীদের এই সম্পদ পরিশ্রমের ফসল নয় বরং লুঠের সম্পদ তখন বিশ্বব্যাপী যে অরাজকতা সৃষ্টি হবে তা নিয়ন্ত্রণ করা শত শত একনায়কের পক্ষেও সম্ভব হবেনা।

লেখক : কলামিস্ট