দিদার বলী চ্যাম্পিয়ন

160

সাতকানিয়ার ঐতিহ্যবাহী মক্কার বলীখেলায় চকরিয়ার বাদশা বলীকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন রামুর দিদার বলী। গতকাল শনিবার বিকালে সাতকানিয়া উপজেলার মাদার্শা ইউনিয়নের মক্কার বাড়ির মাঠে বসে ১৪০তম এই বলীখেলার আসর। এবার কক্সবাজারের রামুর দিদার বলী, উখিয়ার শামসু বলী, টেকনাফের আলম বলী, খুলনার শিপন বলী, যশোরের কামাল বলীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় অর্ধশত বলী এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। খেলা শেষে চ্যাম্পিয়ন, রানার্স আপসহ প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া বলীদের পুরস্কার দেওয়া হয়।
বলী খেলায় প্রধান অতিথি ছিলেন সাতকানিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাসানুজামান মোল্যা। বিশেষ অতিথি ছিলেন, সাতকানিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ শফিউল কবির, মাদর্শার চেয়ারম্যান আ ন ম সেলিম চৌধুরী, সাবেক চেয়ারম্যান নাজমুল আলম চৌধুরী, কাইসার উল আলম চৌধুরী, মাহফুজুর রহমান চৌধুরী, জিল্লুর রহমান চৌধুরী, চৌধুরী হিমেল শাহরিয়া প্রমুখ।
জানা যায়, মক্কার বাড়ির ঐতিহ্যবাহী এ বলীখেলা উপলক্ষে মক্কার বাড়ির আশপাশে বিশাল মেলা বসে। বৈশাখ মাসে আয়োজিত এই বলীখেলা ও মেলায় লাখো মানুষের ঢল নামে।
সূত্র জানায়, প্রায় তিন শতাধিক বছর পূর্বে তাদের পূর্ব পুরুষ সৌদি আরবের মক্কার বাসিন্দা ইয়াছিন মক্কী ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে সাতকানিয়ায় আসেন এবং মাদার্শার পাহাড়ি এলাকায় বসবাস শুরু করেন। এরপর থেকে এলাকাটি মক্কা বাড়ি হিসেবে পরিচিতি পায়। ইয়াছিন মক্কী এলাকায় ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি কিছু ব্যবসাও শুরু করেন। হজ্ব মৌসুমে তিনি বাংলাদেশের অনেক হাজীকে হজ্ব করানোর জন্য সৌদি আরবে নিয়ে যেতেন। সাতকানিয়া ছাড়াও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে তিনি বিপুল পরিমাণ জায়গা কিনে নেন। ইয়াছিন মক্কী এক হজ্ব মৌসুমে বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু হাজী নিয়ে সৌদি আরবে যান এবং সেখানে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ইয়াছিন মক্কীর পরবর্তী প্রজন্ম জমিদারি প্রথা চালু করেন। ১৮৭৯ সালে ইয়াছিন মক্কীর নাতি কাদের বক্সু চৌধুরী খাজনা দিতে আসা প্রজা এবং এলাকার লোকজনকে আনন্দ দেওয়ার উদ্দেশ্যে সর্বপ্রথম বলীখেলার আয়োজন করেন। এরপর থেকে এটি মক্কার বলি খেলা নামে পরিচিতি লাভ করেন।
কাদের বক্সুর নাতি ও বর্তমানে মক্কার বলী খেলার মূল আয়োজক নাজমুল আলম চৌধুরী বলেন, আমার দাদা মূলত খাজনা দিতে আসা লোকজন এবং এলাকার মানুষকে আনন্দ দেওয়ার জন্য বলী খেলার আয়োজন করতেন। প্রতিবছর বৈশাখ মাসের ৭ তারিখে সবাই দল বেঁধে খাজনা দিতে আসতেন। ওই দিন মক্কার বাড়ি এলাকায় খাজনা দিতে আসা লোকদের ভিড় জমে যেতো। আমার দাদা খাজনা দিতে আসা লোকদের জন্য মেজবানের আয়োজন করতেন। শুরুর দিকে বাড়ির সামনে বিশালাকৃতির একটি গাছের টুকরো রাখতেন। খাজনা দিতে আসা এবং স্থানীয় লোকদের মধ্য থেকে যারা ওই গাছের টুকরো আলগাতে (উপরে তুলতে) পারতেন তারাই কেবল বলীখেলার উপযোগী হিসেবে বিবেচিত হতেন। গাছের টুকরো আলগা করে যারা বলী ধরার যোগ্যতা অর্জন করতেন তাদের মধ্যে মূল প্রতিযোগিতা হতো এবং বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার দিতেন। গাছের টুকরো আলগা করে প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জনকারীরা বলী খেলায় হেরে গেলেও তাদের মাঝে শান্তনা পুরস্কার বিরতণ করতেন। এভাবে চলতে চলতে মক্কার বলী খেলা একপর্যায়ে এলাকার মানুষের আনন্দের মূল কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়। সাতকানিয়া ছাড়াও দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে বলী খেলা দেখতে উৎসুক জনতা মক্কার বাড়তি এলাকায় ভিড় জমান। এরপর থেকে বলী খেলা উপলক্ষে মেলার আয়োজন শুরু হয়।
নাজমুল আলম চৌধুরী আরো জানান, আমার দাদা যেহেতু বৈশাখের ৭ তারিখে খেলার আয়োজন করতেন আমরাও একই তারিখে বলীখেলা এবং মেলার আয়োজন করি। কোন ধরনের প্রচার প্রচারণা ছাড়াই এই মক্কার বলী খেলায় চট্টগ্রাম ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য লোক ছুঁটে আসেন। এসময় মক্কার বাড়ির আশপাশে কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বসে বৈশাখী মেলা। মেলার আগের দিন থেকে দোকানিরা নানা পন্যের পসরা সাজিয়ে বসেন। খাবার, কাপড়-চোপড়, কসমেটিকসের দোকান ছাড়াও বাঁশ-বেতের তৈরি জিনিসপত্র, নানা কৃষি উপকরণসহ গ্রামীণ পরিবারে সারা বছরের প্রয়োজনীয় যাবতীয় সামগ্রী মেলায় পাওয়া যায়। লোকজন বলীখেলা উপভোগের পাশাপাশি মেলা থেকে ব্যবহারের সব জিনিসপত্রও কিনে নেন।
তিনি আরো জানান, বৈশাখ মাসের ৭ তারিখে সকাল থেকে মেলায় কেনাকাটা হলেও বলী খেলা শুরু হয় মূলত বিকালে। সমস্ত মেহমান এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বলীদের খাবারের পর দুপুর আড়াইটার দিকে মক্কার বাড়ির লোকজন হলুদ রঙের বিশাল আকৃতির ছাতা মাথায় দিয়ে বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে মাঠে প্রবেশের পর শুরু হয় বলী খেলার মূল কার্যক্রম। মক্কার বাড়ির লোকজন মাঠে উপস্থিত হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা নামকরা বলীরা খালি গায়ে বাজনার তালে তালে নিত্য করে মাঠের চার পাশে কয়েক বার ঘুরে শক্তি প্রদর্শন করে। এসময় মেলায় আসা লোকজনের মধ্য থেকে খেলায় অংশ নেওয়ার আগ্রহী বলীদেরকে মাঠের মাঝখানে ডেকে নিয়ে আসে। শুরু দিকে স্থানীয় বলীরা খেলায় অংশ নেয় এবং ধাপে ধাপে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা সুঠাম দেহের নামকরা বলীরা খেলা শুরু করে। এবারে ক্সবাজারের রামুর দিদার বলী, উখিয়ার শমসু বলী, টেকনাফের আলম বলী, খুলনার শিপন বলী, যশোরের কামাল বলীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নামকরা বলীরা অংশ নেন। রামুর দিদার বলী চ্যাম্পিয়ন হন।