দাবি মেনে নেওয়ার পরও বুয়েটে আন্দোলন কেন?

49

আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডের পর বুয়েট শিক্ষার্থীদের ১০ দফা দাবি মেনে নেওয়ার পরও তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল শনিবার ঢাকার ফার্মগেইটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে মহিলা শ্রমিক লীগের দ্বিতীয় সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি এই প্রশ্ন তোলেন। শেখ হাসিনা বলেন, “সাধারণ ছাত্ররা যারা, তাদের ১০ দফা দাবি মেনে নিয়েছে ভিসি। তারপরও না কি তারা আন্দোলন করবে। কেন করবে, জানি না। এরপর আন্দোলন করার কি যৌক্তিকতা থাকতে পারে।” খবর বিডিনিউজের
বুয়েট ছাত্রলীগের এক দল নেতা-কর্মীর নির্যাতনে গত ৬ অক্টোবর প্রাণ হারান তড়িৎ কৌশল বিভাগের ছাত্র আবরার। এই হত্যাকান্ডের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উত্তাল এখন বুয়েট। ছাত্রলীগ ইতোমধ্যে ১১ জনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছে, হত্যাকান্ডে জড়িত অভিযোগে ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ।
১০ দফা দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শুক্রবার আলোচনায় বসে বুয়েটে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ, আসামিদের বহিষ্কার করাসহ বিভিন্ন দাবি পূরণের আশ্বাস দেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম। কিন্তু শিক্ষার্থীরা দাবি বাস্তবায়ন বাস্তবে না দেখা পর্যন্ত আন্দোলনে রয়েছে, ফলে আগামী ১৪ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় ভর্তি পরীক্ষা পড়েছে অনিশ্চয়তায়।
আবরার হত্যাকান্ডের পর সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “গত কয়েকদিন আগে বুয়েটে যে ঘটনা ঘটেছে। আমরা তো পিছিয়ে থাকিনি। কোন দল করে, সেটা না, খুনিকে খুনি হিসেবে দেখি। অন্যায়কারীকে অন্যায়কারী হিসেবে দেখি। অত্যাচারীকে অত্যাচারী হিসেবে দেখি। খবরটা পাওয়ার সাথে সাথে কারও আন্দোলনের অপেক্ষা করিনি। সঙ্গে সঙ্গে আমি পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছি যে এদেরকে গ্রেপ্তার এবং ভিডিও ফুটেজ থেকে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করতে।”
এই তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে পুলিশের ‘বিপদে’ পড়ার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, “এই ভিডিও ফুটেজ যখন সংগ্রহ করছে তখন তারা বাধা দিয়েছিল, কেন বাধা দিয়েছিল, আমি জানি না।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমার কাছে পুলিশের আইজিপি ছুটে আসলো। বললাম, তারা কী চায়। বলল, কপি চায়। বললাম কপি করে তাদের দিয়ে দাও। তোমরা তাড়াতাড়ি ফুটেজটা নাও, এটা নিলেই তো আমরা আসামি চিহ্নিত করতে পারব, ধরতে পারব, দেখতে পারব এবং সাথে সাথে ব্যবস্থা নিতে পারব। এই তিন-চার ঘণ্টা সময় যদি নষ্ট না করত, তাহলে তার আগেই হয়ত অনেকে পালাতে পারত না, তারা ধরা পড়তে পারত। এখানে সন্দিহান হওয়ার কিছু ছিল না। বিষয়টা কী আমি জানি না। সন্দিহান, না কি যারা জড়িত তারা বাধা, কোত্থেকে কী করেছে, বুঝতে পারি না। মনে হলো যেন আসামিদের চলে যাওয়ার একটা সুযোগই করে দেওয়ার.. না কি ছিল..ওই আন্দোলন যারা করেছে তারা বলতে পারবে।”
সরকার প্রধান বলেন, “আমি কিন্তু এক মিনিট দেরি করিনি। খবর পাওয়ার সাথে সাথে আমি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি এই ধরনের অন্যায় করলে কখনও তা মেনে নেওয়া যায় না।”
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্ত্র ঢোকানোর জন্য সামরিক শাসকদের দায়ী করে শেখ হাসিনা বলেন, “জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়ার আমল থেকে শুরু করে এরশাদের আমলে, সব সময় ছিল একটা অস্ত্রের ঝনঝনানি। মেধাবী ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছিল। হিজবুল বাহার নামে যে জাহাজ জাতির পিতা বাংলাদেশের জনগণকে হজ করতে পাঠাত, হজ করা বন্ধ করে দিয়ে সেটা হয়ে গেল প্রমোদতরী।”
ছাত্রদলের কোন্দলে এক যুগ আগে বুয়েটে সাবেকুন নাহার সনি হত্যার ঘটনাটি তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, “ছাত্রদলের দুই গ্রুপ বুয়েটে। তাদের টেন্ডার নিয়ে গোলাগুলিতে মারা গেল সাবেকুন নাহার সনি। সেই হত্যার কি বিচার হয়েছে? তখন কে প্রতিবাদ করল? তখন আমাদের বুয়েটের যারা অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, তারা তো নামে নাই। তাদেরকে তো তখন নামতে দেখিনি। তখন তো প্রতিবাদ করতে দেখিনি তাদের। তখন তো তারা কোনো কথা বলেনি। হ্যাঁ, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে সবার কথা বলার অধিকার আছে। বলতে পারে অন্তত, এই সুযোগটা আছে।”
শেখ হাসিনা বলেন, “যখন জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় গিয়ে জাতির পিতার খুনিদের পুরস্কৃত করল, একেকটা হত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধীদের যারা ছেড়ে দিল, সাত খুনের আসামি কে যখন নেতা বানাল, কে তখন প্রতিবাদ করেছে? তখন মানবাধিকারের চিন্তা কোথায় ছিল? তখন ন্যায়নীতিবোধ কোথায় ছিল? আমি খালি জিজ্ঞেস করতে চাই, এত ছাত্র হত্যা হয়েছে, কয়টার বিচার কে করেছে। সেই ৭৪ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে করেছে, আর যখনই আমরা সরকারে এসেছি তখন আমরা সাথে সাথে বিচার করেছি। এর বাইরে কি আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারবে কোনো বিচার হয়েছে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “কোনো অন্যায়-অবিচার আমরা সহ্য করব না, করি নাই। ভবিষ্যতেও করব না। যারাই করুক, সে যেই অপরাধী হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার পরিবেশ রাখতে হবে।”
বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে জ্ঞানপাপীরা :
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারতের সঙ্গে করা সাম্প্রতিক চুক্তি নিয়ে ‘জ্ঞানপাপীরা’ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।
“মানুষের মাঝে একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্য জেনে-শুনে জ্ঞানপাপীরা কথা বলে যাচ্ছে। ত্রিপুরা রাজ্যকে ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহার করতে দেওয়ার ব্যাখ্যাও নেতাকর্মীদের দেন তিনি।
তিনি বলেন, ভারতের একটা জায়গা সাবরং। সেখানে থাকা মানুষের পান করা পানির অভাব। এত দীর্ঘ নদীটা যার অধিকাংশ বর্ডার এলাকায়। সেখানকার নদী মানে নদীতে সমান অংশীদার। ভারত এবং বাংলাদেশের। সেখান থেকে তারা একটু খাবার পানি নেবে। সেইটা নিয়েই ‘নদী বেচে দিলাম’, ‘নদী বেচে দিলাম’ ইত্যাদি ইত্যাদি খুব আন্দোলন ¯েøাগান বক্তৃতা। একটা মানুষ যদি পান করার জন্য পানি চায়, ও তো দুশমন হলেও মানুষ দেয়। মাত্র ১.৮২ কিউসেক পানি নেবে তারা। সেটার জন্য এত কান্নাকাটি করার কী আছে?”
এলপিজি রপ্তানি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “চিৎকার করছে ‘গ্যাস বিক্রি’, ‘গ্যাস বিক্রি’। এলপিজি হচ্ছে সিলিন্ডার গ্যাস। সেটা কিন্তু আমাদের দেশের না। বিদেশ থেকে আমদানি করি। এখানে সিলিন্ডারে ভরা হয়। তারপরে সেটা সকল জায়গায় আমরা দেই, যাতে গ্যাসে সবাই রান্না করতে পারে। সেখান থেকে কিছু গ্যাস যাবে ত্রিপুরায়। এটা তো আমরা আমদানি করে বোতলজাত করে রপ্তানি করছি। আরেকটা রপ্তানিপণ্য বাড়ছে। বাংলাদেশের যেসব ব্যবসায়ীরা (রপ্তানি) করবে, লাভবান তারাই হবে। আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না। এটা নিয়ে একটা চিৎকার এবং ¯েøাগান এবং অনেক কিছু হয়ে যাচ্ছে। কাজেই যাব কোথায়?
ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সেখান থেকে আমরা ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছি। তাদের প্রাকৃতিক গ্যাসে উৎপাদিত বিদ্যুৎ আমরা নিয়ে আসছি। বিনিময়ে আমরা এলপিজি তাদের দিচ্ছি। লাভ-লোকসান হিসাব করলে বাংলাদেশেরই লাভ বেশি”।
ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহারের চুক্তি নিয়ে বিএনপির সমালোচনার জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “যারা এত কাঁদছেন, তাদের জিজ্ঞেস করি গঙ্গার পানি আনার কথা। খালেদা জিয়া দিল্লি গিয়ে ভুলে গেল। কেউ তো আনলো না। তিস্তায় ব্যারাক দিল ভারতকে শিক্ষা দেবে। এখন শিক্ষা দেওয়ার পরিবর্তে ভিক্ষা চাইতে হচ্ছে। এই নীতি ছিল এরশাদের। জিয়াউর রহমান হাঁটু গেঁড়ে বসে থাকত, তার ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে। কোনো কথা বলতো না। যা কথা বলত, হুবহু তাই শুনে আসত।”
শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা এনেছি। আমরা পানি চুক্তি করতে সক্ষম হয়েছি। স্থল সীমানা চুক্তি আমরা করেছি, সমুদ্রসীমায় আমাদের অধিকার আমরা রক্ষা করতে পেরেছি”।
মহিলা শ্রমিক লীগের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক আফম বাহাউদ্দিন নাছিম, মহিলা শ্রমিক লীগের সভাপতি রওশন জাহান সাথী, সাধারণ সম্পাদক শামসুন্নাহার ভূঁইয়া।