ত্রিমুখি চাপে ইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা

27

নির্বাচন কমিশনে কর্মরত স্থায়ী-অস্থায়ী সাতজন কর্মচারী ও তাদের সহযোগীসহ পুলিশের কব্জায় আছে নয়জন। এরমধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া জয়নাল আবেদীন পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। এর আগে দুদকের প্রাথমিক তদন্তে উঠে আসে বেশ কয়েকজনের নাম। মূলত দুদকের নজরদারির পর টনক নড়ে ইসির। পরে মামলা হওয়ার পর পুলিশও এ তদন্তে সামিল হলে ত্রিমুখী চাপে পড়ে ইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এখনো অফিসজুড়ে গ্রেপ্তার আতঙ্ক বিরাজ করছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে।
সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত ডবলমুরিং নির্বাচন কার্যালয়ের পিয়ন জয়নাল আবেদীন, জেলা নির্বাচন অফিসের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মোস্তফা ফারুক, কোতোয়ালী নির্বাচন অফিসের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মো. শাহীন, ফাহমিদা আক্তার, বন্দর নির্বাচন অফিসের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মো. জাহেদ হাসান, ডবলমুরিং নির্বাচন অফিসের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পাভেল বড়ুয়া ও ঢাকা এনআইডি বিভাগের টেকনিক্যালয় এক্সপার্ট শাহানুর মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চারধাপে এই নয়জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট।
এদিকে গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে পিয়ন জয়নাল আবেদীন তার সাথে এনআইডি জালিয়াতিতে সম্পৃক্ত থাকা কমপক্ষে ১৬জন স্থায়ী-অস্থায়ী কর্মচারীর নাম বলেছেন। দুদকও প্রাথমিক তদন্ত শেষে যে কয়জনের বিষয়ে অনুসন্ধানের অনুমতি পেয়েছেন তার মধ্যে দুইজন কর্মকর্তার নামও রয়েছে। ইসির নজরদারিতে আছেন কমপক্ষে ১৫জন কর্মচারী। তিন সংস্থার তদন্তে একই ব্যক্তিদের নাম ঘুরেফিরে আসে। যারা দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের ভোটার করার কাজে নিয়োজিত ছিল।
নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, সাম্প্রতিক এনআইডি জালিয়াতির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ভোটার করার কয়েকটি ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জড়িত থাকলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব আমরা। এখন পর্যন্ত কেউ আমাদের নজরে আসেনি। যদি নজরে আসে কেউ বাদ পড়বে না। সবার বিরুদ্ধেই আমরা ব্যবস্থা নেব। আমাদের এখানে কর্মকর্তা যারা আছে, শুধু এখানে না, সারা দেশে এ গুরুত্বপূর্ণ সেবা কোন দুর্নীতি যদি হয় কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।
সরেজমিনে দেখা যায়, চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিসে স্বাভাবিক কার্যক্রম চলমান থাকলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। জয়নাল ও মোস্তফার সাথে বিরোধ থাকা কর্মচারীরা যথেষ্ট আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। কারণ, ইতোমধ্যেই নিশ্চিত হওয়া গেছে জয়নাল ও মোস্তফার বিরোধের কারণেই এ চক্রটি ধরা পড়েছে। রোহিঙ্গা ভোটার করার বিনিময়ে পাওয়া টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়েই মূলত এই দ্ব›দ্ব। যা নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তারাও জানতেন। দুইজনের পক্ষেই আঞ্চলিক ও জেলা নির্বাচন অফিসের কর্মচারীরা বিভক্ত ছিলেন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদেও এক পক্ষ অপর পক্ষের নাম বলতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন কেউ কেউ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মচারী বলেন, ডাটা এন্ট্রি অপারেটররা অনিয়ম-জালিয়াতির সাথে জড়িত থাকতে পারে। তবে কয়েকজন স্থায়ী কর্মচারী তাদের এ কাজে উৎসাহ জুগিয়েছে। আবার অনেকেই ডাটা ইনপুট করতে না জেনে তাদেরকে ব্যবহার করেছে। এখন যারাই গ্রেপ্তার হয়েছে তারা নিজেদের বিপক্ষের লোকদের ফাঁসিয়ে দিচ্ছে। যে কারণে বড়ধরনের দুশ্চিন্তা নিয়েই অফিস করছি। পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দির চেয়ে দুদক ও ইসির তদন্তেই ভালো ফলাফল আসতে পারে।
তালিকায় রোহিঙ্গা ভোটার :
এনআইডি জালিয়াতি ও দুর্নীতি বন্ধে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু হয়েছে উল্লেখ করে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বলেছেন, ইতোমধ্যে দুটি তদন্ত কমিটির দেওয়া প্রাথমিক তথ্যে সন্দেহভাজন ১৫ জনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। চট্টগ্রামসহ ৩২টি অঞ্চলের ভোটার তালিকা যাচাই-বাছাই করা হবে। গতকাল সোমবার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে এক সাংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এনআইডি জালিয়াতি বন্ধে যা যা দরকার, তার সবই করা হবে।
তিনি আরও বলেন, আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, আমাদের মূল ডেটাবেজ সুরক্ষিত আছে। যারা এখানে ঢোকার অপচেষ্টা করেছিল তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের আইটি বিভাগ এই অপচেষ্টাকারীদের চিহ্নিত করেছে। আমরা কাউকে ছাড় দেব না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। এটা বাস্তবায়ন করতে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, সিআইডি, দুদক, এসবির সহায়তা প্রয়োজন হলে আমরা তাদের সহায়তাও নেব।
মহাপরিচালক জানান, রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়া ঠেকাতে ইসি কর্মকর্তাদের বদলি করা হবে, যাতে তারা একই জায়গায় দীর্ঘদিন কাজ করতে না পারে। সেই সঙ্গে নিবন্ধন কর্মকর্তাদের পাসওয়ার্ড যাতে অন্যরা ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য কড়া নজরদারি করা হবে। যদি কেউ হস্তান্তর করে তাহলে সেই ব্যর্থতার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রোহিঙ্গারা কোনোভাবে ভোটার হতে পারবে না, কারণ সব ভোটারের হালনাগাদ তথ্য ২০২০ সালের ২ জানুয়ারি খসড়া আকারে প্রকাশ করা হবে। সব যাচাই বাছাই করেই মূল সার্ভারে যাবে ডেটা। সেক্ষেত্রে ডেটাবেইজ নিয়ে শঙ্কার কোনো কারণ নেই। তথ্যভান্ডার পুরোপুরি সুরক্ষিত।
এ সময় সংবাদ সম্মেলনে, ইসির এনআইডি উইংয়ের পরিচালক (অপারেশন্স) আবদুল বাতেন, ইসির আইসিটি মেনটেইনেন্স ইঞ্জিনিয়ার আশরাফ হোসেন, গঠিত ৫ সদস্যের প্রশাসনিক তদন্ত কমিটির প্রধান এনআইডি উইং পরিচালক খোরশেদ আলম, কারিগরি বিশেষ তদন্ত কমিটির প্রধান এনআইডি পরিচালক ইকবাল হোসেন ও সদস্য এনআইডি উইংয়ের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট সাহাব উদ্দিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।