তোমার আসন শূন্য আজি

171

দেশবরেণ্য জাতীয় নেতা, বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ, চট্টল শার্দুল, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, চট্টগ্রাম-১৩ সংসদীয় আসনের সাংসদ এবং আনোয়ারার কৃতি সন্তান, আমাদের গর্ব মরহুম আলহাজ্ব আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু’র ৭ম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
তিনি জীবদ্দশায় পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক, ১৯৭৮ সাল হতে আমৃত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি, ৭৭ জাতি চেম্বার অব কমার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট, দি ফেডারেশন বাংলাদেশ অব চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজের ও দি চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি, দেশের শীর্ষ স্থানীয় ইউসিবি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ছিলেন। অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, খ্যাতিমান শিল্পপতি, বিশিষ্ট দানবীর, মরহুম আলহাজ্ব আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৪৫ সালের ০৩ মে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলাধীন হাইলধর গ্রামের তৎকালিন জমিদার এডভোকেট নুরুজ্জামান চৌধুরীর ঔরশে জন্মগ্রহণ করেন। তার অগ্রজ মরহুম বশিরুজ্জামান চৌধুরী চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামীলীগের কোষাধ্যক্ষ ও চট্টল গৌরব এম,এ আজিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তার অনুজ মরহুম বশরুজ্জামান চৌধুরী মহান মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ।
বিশিষ্ট পার্লামেন্টেরিয়ান ও গণমানুষের নেতা আলহাজ্ব আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৭০ সালে তিনি সাধারণ নির্বাচনে আনোয়ারা-পশ্চিম পটিয়া হতে প্রাদেশিক সদস্য, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ গণ পরিষদের সদস্য এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৎকালিন চট্টগ্রাম-১২ সংসদীয় আসন হতে ১৯৮৬, ১৯৯১ ও ২০০৮ সালে সাংসদ নির্বাচিত হন।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারি আলহাজ্ব আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছাত্রজীবনে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ১৯৫৮ সালে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সাল হতে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আনোয়ারা উপজেলাধীন হাইলধর ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। মরহুম ১৯৬৭ সালে আওয়ামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জনাব বাবু ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে তার চট্টগ্রামস্থ পাথরঘাটার আন্দোলন ও সংগ্রামের সুতিকাগার ঐতিহাসিক ‘জুপিটার হাউস’ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদের কর্মকাÐ পরিচালনা করেন। সেখানে চট্টগ্রামের আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের সাথে বসে তিনি সিদ্ধান্ত নিতেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এখান থেকে সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ছাপিয়ে প্রচার করতেন। যা বর্তমানে সরকারি আনোয়ারা কলেজে সংরক্ষিত আছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ চালাকালীন সময়ে তিনি বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারতে গিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। মরহুম মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। তিনি বাংলাদেশ সংবিধান প্রণয়নে অনন্য ভূমিকা পালন করেন। ’৭২ এর সংবিধানের তিনি অন্যতম স্বাক্ষরকারী। দেশ ও দলের দুঃসময়ের কাÐারি জনাব চৌধুরী ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর নিজের জীবনবাজি রেখে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে দল পুনরুজ্জীবিত ও পুণর্গঠনে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। নির্ভীক এই নেতা আওয়ামীলীগের দুঃসময়ে আর্থিকভাবে সাহায্য সহায়তা করে দলকে শক্তিশালী করেন। তার সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল অপরিসীম। চরম দুঃসময়ে তিনি দলকে দিকনির্দেশনা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ৮০ দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তাকে কারাবরণ করতে হয়। খালেদা জিয়া আমলেও তাকে অনেক জুলুম, নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল।
ব্যবসায়ী আলহাজ্ব আখতারুজ্জামান চৌধুরী রাজনীতি ব্যতীত তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি বেসরকারি ব্যাংকিং সেক্টরে অন্যতম পথিকৃত। তিনি একজন শিল্প উদ্যেক্তাও বটে। মরহুম একে একে গড়ে তোলেন ইউসিবি ব্যাংক লিঃ, জনতা ইনসুরেন্স কোঃ লিঃ, রনি কেমিক্যাাল, আরামিট লিঃ সহ অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান। তিনি একমাত্র ব্যক্তি ১৯৮৯ সালে ৭৭ জাতি চেম্বার অব কমার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশের জন্য বিরল সম্মান বয়ে এনেছিলেন। তার খ্যাতি ছিল দেশে বিদেশে। তিনি অত্যন্ত সৌখিন ছিলেন। তিনি ব্যক্তিগত ভাবে পৃথিবীর অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন।
দানবীর আলহাজ্ব আখতারুজ্জামান চৌধুরী একজন দানশীল ব্যক্তি ও বিশাল হৃদয়ের অধিকারি ছিলেন। সবসময় দুঃস্থ, অনাথ ও অসহায় ব্যক্তিদের প্রতি তার সাহায্য ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত ছিল। তার কাছ হতে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠি রিক্ত হস্তে কখনও ফিরে আসতে হয়নি। তার পর্বতসম হৃদয় দিয়ে মানবসেবা করে গেছেন। তিনি চট্টগ্রামের আনোয়ারা, তৎকালিন পশ্চিম পটিয়া সহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের অনেক এলাকায় বিভিন্ন মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল, কলেজ, মন্দির, মঠ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা ও আর্থিক সহায়তা করে গেছেন। তাছাড়া নিজ সংসদীয় এলাকার উন্নয়নে তিনি অনন্য অবদান রাখেন।
পরম দয়ালু মরহুম আলহাজ্ব আখতারুজ্জামান চৌধুরী অত্যন্ত পরোপকারী ছিলেন। মানুষের উপকার করা যেন তার নেশা। দেশে বিত্তশালী ব্যক্তি অনেক আছে কিন্তু অসহায়দের মাঝে দু’হাতে বিলানোর মানুষ খুব কমই দেখা যায়। তিনি মানুষের জন্য সবসময় দু’হাতে বিলিয়ে দান করেছেন। যেটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনা পঞ্চদশ অধিবেশনের প্রথম বৈঠকে শোক প্রস্তাবে বলেছিলেন। তার মতো মানুষ এ সমাজে বিরল। তার সবসময় তার সার্সন রোডের ‘ভলকার্ট হাউস’ এর আঙিনা দলীয় নেতা, কর্মী ও সাধারণ জনগণের পদচারণায় মুখরিত থাকতো। কোনদিন বিরক্তি প্রকাশ করতেন না। তিনি মানুষের দুঃখ, দুর্দশার কথা ধৈর্য সহকারে শুনতেন এবং তা সমাধানের সাধ্যমতো চেষ্টা করতেন। তিনি সহজে মানুষকে যেকোন সমস্যার সমাধান দিতে পারতেন। রিক্ত হাতে মানুষকে তিনি বিমুখ করেননি। এই মহান ব্যক্তি ইউসিবি ব্যাংক, নিজস্ব প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন জনকে চাকরি দিয়ে পুনর্বাসন ও প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
¯েœহপরায়ণ ও মমতাময়ী মরহুম আলহাজ্ব আখতারুজ্জামান চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে তাকে খুব কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তিনি বনেদী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও অত্যন্ত বিনয়ী, মিষ্টিভাষী, সদালাপী ও নিরহংকারী ছিলেন এবং তার ছিলনা কোন ক্ষমতার দম্ভ। মরহুমের সম্মোহনি শক্তি ছিল প্রখর। তিনি অতি সহজে মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। তার ব্যবহারে যেকোন লোক সহজে মুগ্ধ হয়ে যেতেন। দলের সর্বস্তরে নেতা তাকে সম্মান করতেন। মরহুম উদার রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। সব দলের নেতাদের সাথে ছিল তার সদভাব। তার প্রতি সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা ছিল।
তীক্ষè বুদ্ধি, মেধা, বিচক্ষণতা ও যোগ্যতা সম্পন্ন জনাব চৌধুরী দেশ-বিদেশে সব মহলেই ছিলেন আলোচিত ব্যক্তি। ন্যায় ও নীতিবান আলহাজ্ব আখতারুজ্জামান চৌধুরী একজন আদর্শবান ব্যক্তি ছিলেন। কোন লোভ লালসা তাকে তার আদর্শ থেকে বিচ্যুতি করতে পারেনি। এমনকি বিএনপি ও জাতীয় পার্টির আমলে মন্ত্রীত্বের লোভনীয় প্রস্তাব পেলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি আমৃত্য বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল ছিলেন। সোনালি জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি রাজনীতি ও মানুষের জন্য ব্যয় করেছেন। অন্যায়ের সাথে তিনি কখনো আপোষ করেননি। সকল লোভ লালসার উর্ধ্বে থেকে তিনি দলকে ভালোবেসেন। রাজনীতির প্রবাদপুরুষ ও জননন্দিত আখতারুজ্জামান চৌধুরী সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ২০১২ সালের ০৪ নভেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর তার জানাজায় লাখো মানুষের ঢল প্রমাণ করেছিল তার প্রতি মানুষের কত অকৃত্রিম ভালোবাসা।
আশা আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতিক আখতারুজ্জামান চৌধুরী সর্বদা চট্টগ্রামের উন্ন্য়ন নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন। চট্টল দরদী বাবু ভাই শুধু নেতা ছিলেন না। তিনি নেতৃত্ব সৃষ্টি করতেন। বাবু ভাই বীর চট্টলার অহংকার ও গৌরব। তিনি কালজয়ী পুরুষ। চট্টগ্রাম ইতিহাসের তিনি অবিচ্ছেদ্য অংশ। জনাব চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের অভিভাবক। চট্টগ্রামবাসি হারিয়েছে তাদের প্রিয় অভিভাবককে। তার মৃত্যুতে জাতি ও বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তার শূন্যতা কোনদিন পূরণ হওয়ার নয়। বাবু ভাই আজ আমাদের মাঝে নেই এ কথা ভাবতে অবাক লাগছে। এ ক্ষণজন্মা নেতা বারে বারে আসবেন না এই মর্ত্যলোকে। তার মতো উদার নেতা কোনদিন এই বীর প্রসবিনী চট্টগ্রামে জন্ম হবেনা। তার মতো নেতা পাওয়া বড় সৌভাগ্যের বিষয়। মরহুমের অবদান চির অ¤øান হয়ে থাকবে এবং তাকে জাতি চিরদিন মনে রাখবে। তিনি মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। প্রাজ্ঞ, ত্যাগী, প্রবীণ ও সিনিয়র নেতা আলহাজ্ব আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু’র জীবন ও আদর্শ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। আখতারুজ্জামান চৌধুরীর সুযোগ্য উত্তরসূরি সৎ, নির্লোভ ও নির্ভীক জনাব সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপিকে ভূমিমন্ত্রী করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমরা চট্টগ্রামবাসি চির কৃতজ্ঞ। আশা করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মাধ্যমে চট্টগ্রামের উন্নয়নে যথেষ্ট অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারবেন এই আমাদের প্রত্যাশা। আজকের এইদিনে বাবু ভাই আমাদের মাঝে না থাকলেও আমাদের হৃদয়ের গহীনে তিনি সদা জাগরুক থাকবেন। আজকের এই দিনে কামনা করছি আল্লাহতায়ালা যেন তাকে বেহশতবাসি করেন।

লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট