তেরো নম্বর রাশি

171

ভাগ্যতে কখনো বিশ্বাস করিনি, সবসময় বলতাম, ভাগ্য বলে কিছু নেই। ভাগ্য নিজেকেই গড়তে হয়। কিন্তু জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে ভাগ্য আমাকে ভুগিয়েছে, এখনো ভোগায়। দুবাইর মত একটা জায়গায় যেখানে প্রতিদিন কদমে কদমে শত শত লটারি, সেখানে আমি কখনো ফ্রি’তে একটা পেপসি কোলার টিন কিংবা বোতল পাইনি। আমার আরেক প্রবাসী বন্ধু ওয়াহিদুল আলম (বর্তমানে আলজেরিয়া প্রবাসী)। ওয়াহিদ আর আমি একসাথে বের হওয়া মানে সচল জিনিস অচল হয়ে যাওয়া। শেখ জায়েদ রোডে আট লাইন কোথাও কোথাও দশ লাইনে গাড়ি চলে। এই আট/দশ ট্র্যাক লাইনেও জ্যাম লেগে যায়। কোন সময় দেখা গেল আমি অনেকদূর কচ্ছপের মত ধীরে ধীরে এগুচ্ছি। আমার পাশের ট্র্যাকটা তুলনামূলক ভালো গতিতে চলছে। এইদেশে জ্যাম সড়কে সহজে লাইন চেঞ্জ করতে পারে না। যখন অনেক কষ্ট করে লাইন চেঞ্জ করে ওই লাইনে গেলাম, তখন দেখি আমার আগের লাইনটার গতি বেড়ে গেল আর সচল লাইনটা একেবারে থেমে গেল। এটাকে অনেকে কাকতালীয় বলবেন। কিন্তু কাকতালীয় ব্যপারটা সবসময় হয় না। অথচ উল্লেখিত ঘটনা আমার সাথে সবসময় হয়। আমি বরং অভ্যস্ত হয়ে গেছি। প্রবাসজীবনের সাড়ে সাতাশ বছরে একবার দেখেছিলাম পাঁচ মিনিটের জন্য বিদ্যুৎ ছিল না। ঘটনাক্রমে সেদিন আমি আর ওয়াহিদ দুবাই চেম্বার অব কমার্সে গিয়েছিলাম ওয়াহিদের এক অফিসিয়াল কাজে। আমরা চেম্বার অব কমার্সের পার্কিং পেরিয়ে প্রশস্ত রিসিপশনে পা রাখতেই সাঁ সাঁ করে কয়েকটা সাদা দপদপে প্রাঢো এসে চেম্বারের এন্ট্রান্সে দাঁড়ালে সেখান থেকে কয়েকজন শেখ নেমে দ্রæত চেম্বারের ভেতর ঢুকে গেল। বোধহয় আজকে কোন বড় সড় মিটিং আছে। বুঝলাম অপেক্ষা করতে হবে। হঠাৎ এক শব্দ হয়ে বিদ্যুৎ চলে গেল। উপস্থিত সবাই বিস্মিত ! কারণ এখানে এটা আশ্চর্য ঘটনা। সাথে সাথে দ্রুত বেরিয়ে শেখগণ নিজ নিজ গাড়িতে বসে চলে গেলেন। ঐদিন আরবি শেখদের গরম থেকে পালাতে দেখে বোঝা গিয়েছিল তারা কত আরাম প্রিয় জাতি। ঠিক পাঁচ মিনিট পর বিদ্যুৎ ফিরে এলো। পরে জেনেছিলাম, জেবল আলী পাওয়ার প্ল্যান্ট এ সর্টসার্কিট হয়ে বিস্ফোরণ ঘটে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটেছিল। কিন্তু খুব কম সময়ে তারা আবার বিদ্যুৎ সচল করে দিয়েছিল। এখানেও ওয়াহিদ আর আমি এসে মনহুছ শব্দটাকে বিকাশ করলাম। শপিং করতে গেলে ভিড় বাট্টা ওয়ালা দোকানে আমি ঢুকিনা। যে দোকানে কাস্টমার নেই ভিড়-বাট্টা নেই সে দোকানে আমি কেনাকাটা করতে ঢুকি। কিন্তু ঢোকার খানিক পরে এমন অবস্থা হয় যে অন্য গ্রাহকদের জন্য দোকানির সাথে কথাও বলা যায়না। শপিং শেষে ক্যাশ কাউন্টারে পে করার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছি। ধীরে ধীরে সামনের লোকগুলি আগে বাড়ছে। আমার সিরিয়াল আসতেই ক্যাশ মেশিনে হয় পেপার ফেঁসে যাবে, না হয় আগের কাস্টমারের ক্রেডিট কার্ডের কোন সমস্যার জন্য অহেতুক দাঁড়িয়ে থাকা। মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে একটু আগেবাগে গিয়ে ফ্যানের নীচে বসে পড়ি। এসি থাকলেও মানুষের গরমে অস্থির লাগে। যথাসময়ে মানুষে মসজিদ ভরে গেল। এসির সাথে সাথে আমি ব্যতীত সবার মাথার ওপরের ফ্যানগুলি ঘুরতে লাগলো। মোয়াজ্জিনকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম- এটা ঘুরছে না কেন ? মোয়াজ্জিন বলল- হাদা হারবান (এটা খারাপ)। অজু খানায় ২০/৪০ টা পানির টেপ। সবগুলিতে স্রোতের মত পানি। আমি অভাগা যেটাই অজু করছি ওটার পানি ঝরছে ফোঁটা ফোঁটা। কষ্ট লাগলেও অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কোম্পানিতে একধাপ ওপরে কোন পদ শূন্য হয়েছে, যেটা আমি পাওয়ার কথা। কিন্তু কোথাও না কোথাও থেকে কেউ উড়ে এসে বসে যায়, আমার প্রমোশন বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। একদিন বন্ধু ওয়াহিদ আমাকে জিজ্ঞেস করলো- আচ্ছা নাদিম ভাই, রাশি কয়টা ? আমি বললাম বারোটা। ওয়াহিদ বলল, বারোটা না তেরোটা। আমি হেসে বললাম, আরেকটা কোনটা ? ওয়াহিদ হেসে বলল- আমাদের দুজনের যে রাশি সেটা। মানে কুত্তা রাশি। দুজনের সে’কি দমফাটা হাসি। এই কুত্তা রাশি খুব দুঃখ থেকে বলেছিল ওয়াহিদ। আবুধাবি থেকে বদলি হয়ে আসা ওয়াহিদ দুবাই দেখার জন্য আমার সাথেই বেশিরভাগ সময় বেরিয়ে পড়তো। দুবাই ক্রিক এর তলদেশ দিয়ে এক কিলোমিটার টানেল দিয়ে আমার সাথে গাড়িতে আসা যাওয়া করে প্রায়শ। একদিন বলল নাদিম ভাই একদিন গাড়ি বারদুবাই পার্কিং করে আমরা বোটে করে হাবরা পার হবো কী বলেন ? বোটে করে হাবরা পার হওয়ার মজাটা নেয়া যাক। আগে এটাকে লোকে বলতো- চার আনার হাবরা। কারণ মাত্র পঁচিশ ফিলস দিয়ে তখন লোকে এই হাবরা পার হতো। হাবরার মাঝিরা অধিকাংশই রোহিঙ্গা স¤প্রদায়। রোহিঙ্গাদের ভাষা চট্টগ্রামের ভাষার সাথে মিল থাকায় এরা সুযোগে নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দিলেও অনেকেই জীবনে বাংলাদেশ দেখেনি। তাই রোহিঙ্গারা বেশিরভাগ পাকিস্তানি মানসিকতার। ওরা গোঁড়া মুসলমান। জন্ম নিয়ন্ত্রণে বিশ্বাসী নয়। যারা এখানে জন্ম হয়ে বেড়ে উঠেছে, লেখাপড়া করে চাকরি করছে কিংবা ব্যবসা করছে তারা মাতৃভাষার মত আরবি ভাষা বলে। অনেককে দাঁড়ি ও হেয়ার স্টাইল আর পরিচ্ছদে চেনার উপায় থাকেনা কথা না বলা পর্যন্ত। একদিন বারদুবাই প্লাজা সিনেমার পার্কিং এ গাড়ি রেখে ওয়াহিদকে সাথে নিয়ে বোটে চেপে বসলাম। বোটে বসে ওয়াহিদ অনেক এক্সাইটেড। বোটের আশে পাশে সাদা সাদা গাংচিল উড়ছে। বারদুবাই মন্দিরের দেবী দর্শন শেষে প্রচুর হিন্দু নারী পুরুষ হাবরার তীরে দাঁড়িয়ে ওপারের দৃশ্য দেখছে। এখন হাবরা আর চার আনাই থেমে নেই। একদফে পঞ্চাশ পয়সা বাড়ানোর পর এখন এক দেরহাম ভাড়া নেয় হাবরা পারাপারে। ফুরফুরে মেজাজে বাদাম চিবুতে চিবুতে ওয়াহিদ আর আমি বোটে উঠে বসলাম। দ্রæত বোট ভরে গেল। এই বোটগুলি ডিজেল দ্বারা চালিত ইঞ্জিনে ভট ভট ভট ভট করে চলে। বাতাসের সাঁ সাঁ আর বোটের ভট ভট শব্দে ওয়াহিদের কথা কানে যাচ্ছে না। তারপরও দুজনে নানাকথা বলে যাচ্ছি। হঠাৎ ভ-ট ভ-ট করে ক্রিকের মাঝখানে আমাদের বোট থেমে গেল। আশে-পাশের একসাথে ছাড়া বোটগুলো শিস বাজিয়ে আমাদের অতিক্রম করে চলে যাচ্ছে। মাঝি অনেক কসরৎ করেও যখন বোটটা স্টার্ট করতে ব্যর্থ হল তখন উদ্বিগ্ন যাত্রীদের চোখে পড়লো অন্য একটা বোট এসে দঁড়ি দিয়ে বেঁধে আমাদের বোটটা টেনে টেনে ওপারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ওয়াহিদের হাবরা যাত্রা অলক্ষুণে হওয়ায় আবারো কুত্তা রাশির প্রসঙ্গ এলো। বোট থেকে নেমেই ওয়াহিদ বলল, নাদিম ভাই এই রাশি নিয়ে আর কত ভুগতে হবে ? এটার কী কোন সমাধান নেই ? আমি ওয়াহিদের ইঙ্গিত বুঝতে পারলেও সেদিন কোন জবাব দিইনি। আমার কিছু বন্ধু আছে যাদের ভালো লাগা মন্দ লাগা, রুচি, আদর্শ ও মানসিকতা আমার সাথে শতভাগ সামঞ্জস্যপ‚র্ণ। ওয়াহিদউল আলম তাদের একজন। ওয়াহিদের সবচেয়ে ভালো গুণ ছিল ওয়াহিদ সাহিত্যানুরাগী, বাংলার সাথে সাথে উর্দু শায়ের, গজল খুব পছন্দ করে। রেডিও ফোর নামে একটা হিন্দি এফ এম চ্যানেল ছিল। সকালের দিকে সেখানে একটি মজার অনুষ্ঠান হতো যাতে টেলিফোনের মাধ্যমে শ্রোতারা সরাসরি যুক্ত হতে পারতো। সেখানে যেকোনো একটা শব্দ বলা হতো এবং প্রশ্ন রাখা হতো কোন ভাষায় এটাকে কী বলা হয়। তারপর লটারির মাধ্যমে সঠিক উত্তর দাতাদেরকে পুরস্কৃত করা হতো বলে রেডিওতে প্রচার করা হতো। আমিও নিয়মিত ওই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে লাগলাম। একটা শব্দের উত্তরে লটারিতে সঠিক উত্তরদাতা হিসেবে আমার জন্য একটি টোস্টার পুরস্কার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। কয়েকবার যোগাযোগ করলে প্রতিবারই বলা হয়, এখনো আপনার পুরস্কার পৌঁছেনি ? আচ্ছা আমি আজই অফিসকে জানাচ্ছি। রেডিওর পুরস্কার আর কেউ পেয়েছে কিনা জানি না। আমি তো কুত্তা রাশির জাতক। আমি পাইনি।

লেখক : প্রবাসী সাংবাদিক