তৃতীয় শক্তি বনাম চতুর্থ শক্তি

65

লিটন দাশ গুপ্ত

শিরোনাম নিয়ে কিছু বিশ্লেষণের আগে প্রথমে বলে রাখি, যুদ্ধ মানে শত্রæর সাথে জীবন মরণ খেলা, যুদ্ধ মানে শক্তভাবে শত্রæ মোকাবেলা। যুদ্ধ এক প্রকার ধ্বংসের অংশ। তাই যুদ্ধ নয় আমরা শান্তি চাই। এবার আসি মূল কথায়, যে কথা শিরোনামে উল্লেখ করলাম, সামরিক শক্তিতে পৃথিবীর তৃতীয় শক্তি বনাম চতুর্থ শক্তি মুখোমুখির কথা। চীন এবং ভারত পরস্পর বৈরী প্রতিবেশী দুটি রাষ্ট্র। একটি বৃহত্তম সমাজতান্ত্রিক হিসাবে রাষ্ট্র অন্যটি বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গর্ববোধ করে থাকে। গত কয়েক বছর যাবৎ এই দুটি রাষ্ট্র বিভিন্নক্ষেত্রে একে অপরকে বিভিন্নভাবে সন্দেহ করে আসছে; যা কয়েকদিন আগে রক্তাক্তরূপ নেয়। কয়েকদশক পর দুইপক্ষে হতাহত হয় সৈন্য, যদিও চীন আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি। এই দুটি দেশের সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কেবল এশিয়া মহাদেশ নয় পুরো পৃথিবীতে বিভিন্নক্ষেত্রে অন্য সকল রাষ্ট্রের মধ্যে শীর্ষে অবস্থান। যেমন- পৃথিবীর সামরিক শক্তির দিক দিয়ে তৃতীয় শক্তিধর রাষ্ট্র হচ্ছে চীন, অন্যদিকে চতুর্থ শক্তিধর রাষ্ট্র ভারত। অর্থনীতির সমীক্ষা থেকে জানা যায়, বিশ্ব অর্থনৈতিক সূচকে আগামী ৩০ সালের মধ্যে চীনের অবস্থান ১ম আর ভারতের অবস্থান হবে ৩য়। জনসংখ্যার দিক দিয়ে প্রায় ১৪৫ কোটি লোকসংখ্যা নিয়ে পৃথিবীর সর্বাধিক জনবহুল দেশ চীন। অপরদিকে ১৩৫ কোটি লোকসংখ্যা নিয়ে দ্বিতীয় সর্বাধিক জনবহুল দেশ ভারত। আয়তন বিবেচনায় বর্তমান সময়ে পৃথিবীর ৪র্থ বৃহত্তম রাষ্ট্র চীন, অন্যদিকে ৭ম বৃহত্তম রাষ্ট্র ভারত। এইছাড়া বিভিন্ন সূচকে পৃথিবীর মানচিত্রে প্রায় কাছাকাছি এই দুইটি দেশের অবস্থান।
কয়দিন থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দেখছি, চীন ভারত যুদ্ধ হলে কার শক্তি বেশী, কার শক্তি কম, কে জয়ী হবে বা কে পরাজিত হতে পারে তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ। আমার উপরোক্ত দুটি দেশের তুলনামূলক তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন মানে এই দুটি দেশের শক্তির পার্থক্য বা জয় পরাজয়ের বিষয় নিয়ে কিছু ব্যক্ত বা বিশ্লেষণ করা নয়। এই দুটি দেশ যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে বাংলাদেশ তো বটেই পুরো এশিয়া এমনকি সমগ্র বিশ্বে এর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়বে, সেই বার্তাটি প্রেরণ করায় আজকের লেখার উদ্দেশ্য। এখানে তুলনামূলক তথ্য উপস্থাপনে আয়তনের দিকে চীন পৃথিবীর চতুর্থ আর ভারত সপ্তম বৃহত্তম রাষ্ট্রের কথা বলতে গিয়ে ‘বর্তমান সময়’ শব্দ যুগল ব্যবহার করেছি। এই শব্দযুগল ব্যবহারের কারণ হচ্ছে, দুটি দেশের মানচিত্র সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে বারে বারে পরিবর্তন এসেছে বা এরা মনেকরে সীমানারেখা পরিবর্তন হয়েছে। ’৪৭ সালের ভারত ভাগ হয়ে সংকুচিত হতে হয়েছে। ১৯১৪ সালে বৃটিশ কর্তৃক অঙ্কিত ম্যাকমোহন লাইন যেটা ভারত চীন বিভক্ত আইন স্বীকৃত সীমানা হলেও সেটি চীন মানতে চাইনা। চীন বলতে চাই ঐ সীমানার ফলে তারা সংকুচিত হয়ে গেছে! কারণ তারা মনে করে ভারতের অরুণাচল প্রদেশের একাংশ তাদের হবার কথা। অন্যদিকে বিরোধপূর্ণ কাশ্মীরের পাকিস্তান অংশের একাংশ চীনকে উপঢৌকন দেয়া হয়েছে। আবার ’৬২ সালে চীন ভারত যুদ্ধে ৩৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার লাদাখ অংশে দখলে নেয় চীন, যেটাকে আকসাই চীন নামকরণ করা হয়েছে। তার মানে চীন-ভারত সীমান্তে বার বার সংকোচন প্রসারণ ঘটেছে ঐ বিরোধপূর্ণ কাশ্মীর লাদাখ দুর্গম অঞ্চলে। এই অবস্থায় বিপজ্জনক এই অঞ্চলে ১৮-২০ হাজার ফুট উঁচু ঐ ভূমিতে, -৩২ ডিগ্রী (শীতকালে) হিমাঙ্কের নীচে শত প্রতিকূল পরিবেশে চীন ভারত পাকিস্তান তিন পারমানবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের সৈন্যরা মুখোমুখি থাকতে হয় সবসময়। তাই এটাকে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা জটিল বিরোধপূর্ণ স্থান ও কঠিন যুদ্ধক্ষেত্র বললেই অত্যুক্তি হবেনা।
বর্তমান সময়ে সমগ্র বিশ্বে বিভিন্ন দেশে চীন অর্থনৈতিক প্রভাব বা বলয় সৃষ্টি করে চলেছে। তবে তুলনামূলকভাবে সেই হিসাবে বন্ধু রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে পারেনি। যদিও ভারতের পাশ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোকে বিভিন্নভাবে আয়ত্বে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে চীন; এইক্ষেত্রে এই মুহূর্তে কিছুটা সফল হয়েছে বলা যেতে পারে। অন্যদিকে ভারত বিশ্ব অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখতে না পারলেও অধিকাংশক্ষেত্রে বন্ধু রাষ্ট্র তৈরীতে সক্ষম হয়েছে। যা বিভিন্নক্ষেত্রে কূটনৈতিক ভাবে গুরুত্ব বহন করে।
এখানে না বললে নয়, শুরুতেই এই দুটি রাষ্ট্রের তুলনামূলক তথ্য উপস্থাপনে সর্বক্ষেত্রে চীন এগিয়ে থাকলেও যুদ্ধক্ষেত্রে এই নয় যে খুব সহজেই ভারতকে ’৬২ সালের মত হারিয়ে জয়ী হয়ে যাবে। এই বিষয়ে উল্লেখ করতে হয়, এ বছর মার্চ মাসে হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের ‘বেলফার সেন্টার’ এর একদল সামরিক ও সমর বিশেষজ্ঞ দীর্ঘ এক গবেষণার মাধ্যমে উপস্থাপন করেছে, সীমান্ত যুদ্ধের শক্তিমত্তায় ভারত চীন থেকে অনেক এগিয়ে আছে। একই ভাবে গত বছরের শেষের দিকে ‘সেন্টার ফর নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি’ নামে একটি গবেষণা সংস্থাও প্রতিটি সেক্টরে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে পারদর্শিতা ও কৌশলগত ভাবে চীন অপেক্ষা ভারতকে এগিয়ে রেখেছে। তার মানে যুদ্ধ বাঁধলে দুই পক্ষের ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি হবে এতে কোন সন্দেহ নাই। তাই শান্তির বাণী দিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম।
আমাদের দেশের একাংশ মানুষের মধ্যে, ভারত পাকিস্তান চীন মায়ানমার বা নিকটবর্তী রাষ্ট্রসমূহের যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া নিয়ে বেশ কৌতুহল পরিলক্ষিত হয়। তাঁরা যুদ্ধের ময়দানকে খেলার মাঠ মনে করে। খেলার মাঠে যেমন অংশগ্রহণকারী দুই দলের পক্ষে-বিপক্ষে দর্শক বা সমর্থক থাকে। তারা যুদ্ধংদেহী রাষ্ট্রের প্রতি অনুরাগ বা বিরাগ প্রদর্শন করে থাকে বা পক্ষে বিপক্ষে সমর্থন প্রদান করে থাকে। ক্রীড়া প্রতিযোগিতা দুই পক্ষের মধুর সম্পর্কের মধ্যদিয়ে হয়, যা জয় পরাজয় আর ট্রফি বিনিময়। এতে থাকে বল ব্যাট, নেট গোলপোস্ট ইত্যাদি উপকরণ। অন্যদিকে যুদ্ধ মানে ধ্বংস। যুদ্ধে থাকে নিহত আহত মানুষের আর্তনাদ। বিধ্বংসী বিমান হামলা, ট্যাংক মিশাইল, সাবমেরিন, মর্টার ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপ ইত্যাদি। এমনকি প্রয়োগ হতে পারে নিরস্ত্র মানুষের উপর পারমানবিক অস্ত্র। বোমার আঘাতে ধ্বংস হতে পারে সম্পদ ও সভ্যতা। আর ভারত চীন স্বাভাবিক ছোটখাটো সীমান্ত যুদ্ধ হলে প্রাণ হারাবে শত শত হাজার হাজার মানুষ, আর ভয়াবহ যুদ্ধ হলে ছাড়িয়ে যাবে লাখো মানুষ এমনকি কোটি প্রাণ! কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, অতীতে পৃথিবীতে যে সকল যুদ্ধবিগ্রহ সংগঠিত হয়েছিল তার বেশীরভাগক্ষেত্রে যোগবিয়োগের হিসাবে লাভ-ক্ষতি বা ফলাফল কি এসেছে? আমরা জানি চীন ভারত শক্তিশালী এবং দায়িত্বশীল রাষ্ট্র। এই দুই দেশের রাষ্ট্র নায়ক নিশ্চয় অনুধাবন করতে সমর্থ হবে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে। শক্তিশালী রাষ্ট্রদুটি বুঝতে পারবে তাদের শক্তি হচ্ছে, তাদের শান্তি আর নিরাপত্তার গ্যারান্টি। মনে রাখতে হবে, মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া দুই শক্তিশালী দেশ পরস্পর চরম বিরোধী ও শত্রæ হবার সত্তে¡ও অতীতে কেউ কাউকে আক্রমণ করেনি, ভবিষ্যতেও যুদ্ধে জড়ানোর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সূক্ষœদৃষ্টিতে একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তাদের শক্তি তাদেরই শান্তি ও নিরাপত্তায় ব্যবহৃত হচ্ছে পরোক্ষ বা অদৃশ্যভাবে। বনের বাঘ-সিংহ যেমন পরস্পর শত্রæ ও শক্তিশালী হবার সত্তে¡ও, একে অপরকে আক্রমণ করেনা, এই রাষ্ট্র দুটির ক্ষেত্রেও ঠিক তাই! এই অবস্থায় বলতে চাই, যুদ্ধ নয় শান্তি এই সত্যকে উপলব্ধি করে, ভারত ও চীন তাদের নাগরিকদে মধ্যে শান্তির অমীয় বাণী বর্ষিত করবে এটাই আমার কামনা। একইসাথে বিশ্বমানব শান্তির অন্বেষণে, বিবেক সুবুদ্ধি ও সহনশীলতার বাতাবরণে উদ্ভাসিত হবে এটাই আমার প্রত্যাশা।

লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট