তুচ্ছ ঘটনায়ও পড়ছে লাশ

67

অস্থিরতা ও অসহিষ্ণুতার বাড়বাড়ন্ত সময়ে তুচ্ছ ঘটনায়ও লাশ পড়ছে। সামান্য তর্কাতর্কি কিংবা মনোমালিন্য থেকে বৈষয়িক স্বার্থের দ্ব›দ্ব পরিণতি লাভ করছে নৃশংস হত্যাকান্ডে। শুধুমাত্র চলতি এপ্রিল মাসের সর্বশেষ ১৯ দিনে নগরী ও জেলার বিভিন্ন স্থানে লাশ পড়েছে দুই নারীসহ ১৭ জনের। এর মধ্যে অন্তত ১৩টি ঘটনাই খুনের। বাকি চারটি আইন-শৃংখলা বাহিনীর সাথে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’। সর্বশেষ গত ২৩ এপ্রিল দিবাগত রাতে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ পরিচয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে শিকলবাহা ব্রিজ এলাকায় শ্যামলী পরিবহণের এক চালককে বাস থেকে নামিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। হাতকড়া পরিয়ে বাস থেকে নামিয়ে পেটানোর পর জালাল উদ্দিন (৪৮) নামের ওই বাসচালককে পুনরায় বাসে তুলে দেয় ৮/১০ জনের খুনিচক্র। সিএমপির কর্ণফুলী থানায় মামলা হলেও কারা এ হত্যাকান্ডে জড়িত পুলিশ এখনও তা নিশ্চিত হতে পারেনি। এর বাইরে পারিবারিক কলহ কিংবা ব্যক্তি পর্যায়ে সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে অস্থিরতার জেরেও রক্ত ঝরছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সা¤প্রতিককালে সমাজে অস্থিরতার সাথে পাল্লা দিয়ে উদ্বেগজনক হারে এ ধরনের হত্যাকান্ডের ঘটনা বাড়ছে। নীতি-নৈতিকতার অধঃপতন বেশ চোখে পড়ার মত। পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতা নিত্যনৈমিত্তিক মামুলি ব্যাপারে পরিণত হচ্ছে। কেমন যেন আলগা হয়ে যাচ্ছে চিরন্তন পারিবারিক সম্পর্কের বাঁধন। খসে পড়ছে স্নেহ-মায়া-মমতা-প্রীতি-শ্রদ্ধা ও নির্ভরতার অকৃত্রিম অনুভূতিগুলো। কোনও কোনও ঘটনা তো আপনজনের সংজ্ঞাই বদলে দিতে চাইছে। সন্তানের হাতে অভিভাবক কিংবা ভাইয়ের হাতে ভাই খুনের ঘটনাও ঘটছে প্রকাশ্য দিবালোকে। স্বজনের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে পরিচিতজনের হাত।
কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন এসব খুনোখুনির পেছনে সর্বত্র এক ধরনের বেপরোয়া মনোভাব বাড়বাড়ন্ত হয়ে উঠছে বলে মনে করেন। তিনি বলেন, প্রভাবশালী পরিচয়ে অত্যাচারের মাত্রা সমাজের সহ্য করার বা শুষে নেয়ার ক্ষমতা অতিক্রম করে গেছে। সমাজ নিজেও নানা অন্যায় ও অপরাধের সাথে আপস করে এর প্রতিকারের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠান, ঘর থেকে সমাজ একযোগে পতনের গভীর খাদের দিকে চলেছে। ব্যক্তির বিবেক বা নীতিবোধ খড়কুটোর মত উড়ে যাচ্ছে সম্মিলিত অপরাধশক্তির কাছে। মানুষ ও সমাজের এই ডুবে মরার বাস্তবতা অপ্রত্যাশিত হলেও অনভিপ্রেত নয়। আমাদের সমাজ চর্চা করা ভুলে যাচ্ছে। আমরা একদিকে ফলাফলের ভিত্তিতে মেধায় ও উচ্চশিক্ষায় সফল মানুষে দেশ ছেয়ে যেতে দেখছি আর অন্যদিকে নৈতিকতার বলে উন্নত চরিত্রের মানুষের আকালও দেখছি সর্বত্র। ফলে এ সমাজ নৈতিকতার কোনও ভিত্ দাঁড় করাতে পারছে না। ক্রমেই পরিস্থিতি এমন হচ্ছে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। একটা অবিশ্বাস ও ভয়ের সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করার মত বাস্তবতা থাকছে না। এটা ভয়ঙ্কর।
চলতি মাসের অপরাধ পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ৫ এপ্রিল থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত মহানগরী ও জেলায় লাশ পড়েছে দুই গৃহবধূসহ ১৯ জনের। এরমধ্যে অন্তত ১৩টি খুনের ঘটনা। বাকি চারটি ঘটনা পুলিশের সাথে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’র। একেকটি খুনের ঘটনার ধরণও শিউরে উঠার মত। গত ১২ এপ্রিল প্রাইভেট কারের চালককে খুন করে লাশ সাগরে ফেলতে যাওয়ার পথে রাত সাড়ে দশটার দিকে উত্তর কাট্টলীর ঈশান মহাজন রোডে ঘোষ পাড়ার একটি কমিউনিটি সেন্টারের সামনে জনতার হাতে ধরা পড়েন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ দু’জন। খুনের শিকার কার চালক নুরুল কবির (২৫) সীতাকুন্ডের বাসিন্দা। ঘটনাস্থল থেকে আটক দুজন হলেন, মীর হোসেন নিশান (২১) ও মো. ইমন (২০)।
তারা দু’জনসহ চার বন্ধু মিলে যাত্রীবেশে সীতাকুন্ড থেকে চট্টগ্রাম শহর পর্যন্ত একটি প্রাইভেট কার (চট্টমেট্রো-১২-৫০২৬) ভাড়া করেন। পথিমধ্যে পরিকল্পনা অনুযায়ী চালককে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। এরপর চালকের লাশ পেছনের সিটে এনে যাত্রীর মত করে দু’জনের মাঝখানে বসিয়ে তারা শহরের দিকে এগুতে থাকেন। পরিকল্পনা ছিল ভাটিয়ারি দিয়ে টোল রোড হয়ে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের দিকে এসে চালকের লাশ সাগরে ফেলে দেবেন। কিন্তু পথ ভুলে টোল রোডের পরিবর্তে তারা ঢুকে পড়ে উত্তর কাট্টলী ঈশান মহাজন রোডে। তুলনামূলক সরু ওই সড়কের ঘোষ পাড়া এলাকায় উল্টোদিক থেকে আসা গাড়িকে সাইড দেয়ার জন্য প্রাইভেট কারটি ব্যাক দিতে গিয়ে একটি চাকা নালায় পড়ে যায়। এসময় কারের পেছনের সিটে যাত্রীর মত করে বসিয়ে রাখা চালকের লাশটি হেলে পড়ে। আর তাতেই সেখানে উপস্থিত স্থানীয় কয়েকজনের দৃষ্টি আটকে যায়। তারা কারের দিকে আসতে থাকলে অমনি ছিনতাইকারীদের দুজন নেমে দৌড়ে পালিয়ে যায়। বাকি দু’জনকে ধরে আকবর শাহ থানা পুলিশে খবর দেয়া হয়। গত ১৫ এপ্রিল ফটিকছড়ি ভূজপুরের মহানগর গ্রামে ডাকাতি শেষে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে প্রবাসীর স্ত্রী মামনি দে (২৪) কে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ডাকাতদের চিনে ফেলায় প্রাণ কেড়ে নেয়া হয় ওই গৃহবধূর। এ ঘটনায় সানি দে, চয়ন দে ও জয় দে নামে যে তিনজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে তারাও একই গ্রামের বাসিন্দা এবং পরস্পরের পূর্বপরিচিত। গত ৬ এপ্রিল দিবাগত রাত একটার দিকে নগরীর বাকলিয়া থানাধীন খালপাড় এলাকায় লোকমান হোসেন জনি (৩৫) নামে এক যুবককে গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়। নিহত লোকমান হোসেন নগরীর গোলপাহাড় এলাকায় পানের দোকান করতেন। এলাকার কিশোর বয়সী ছোট ভাইদের মধ্যে তুচ্ছ বিষয়ে সৃষ্ট বিরোধ মীমাংসা করতে গিয়ে প্রতিপক্ষের হাতে খুন হন তিনি। জনি হত্যাকন্ডের দুদিন পর পুলিশ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ফটিকছড়ির জাফতনগর এলাকা থেকে মামলার প্রধান আসামি মো. সাইফুল (২৮) এবং জিয়া উদ্দিন (২৭) নামে দু’জনকে গ্রেপ্তার করে। এরপর জিজ্ঞাসাবাদে সাইফুলের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত ৯ এপ্রিল ভোর রাতে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে গেলে কল্পলোক আবাসিক এলাকায় ৫ নম্বর ব্রিকফিল্ড কবরস্থানের পাশে পুলিশের সাথে সন্ত্রাসীদের কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। পরে ঘটনাস্থল থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সাইফুলকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। একইভাবে গত ১৮ এপ্রিল হামজারবাগ হিলভিউ আবাসিকের ব্যাংক কলোনি এলাকায় দিনদুপুরে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে ফরহাদ হোসেন নামে পূর্বপরিচিত একজনের ধারালো ছুরির আঘাতে গুরুতর আহত হন স্থানীয় বাসিন্দা প্রাইভেট কারের চালক শাহাদাত হোসেন মৃধা। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। হত্যকান্ডের কয়েকঘন্টা পর পুলিশ অভিযুক্ত ফরহাদকে তার মায়ের সহযোগিতায় গ্রেপ্তার করেছে। তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে গত ১৬ এপ্রিল দিবাগত রাতে চন্দনাইশের এলাহাবাদে রফিকুল ইসলাম নামে এক পিকআপ চালককে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সড়কে ধাক্কা লেগে গ্লাস ভাঙা নিয়ে স্থানীয় আরেক পিকআপ চালকের সাথে আগের দিন কথা কাটাকাটি হয় রফিকুলের। বিবাদ মিটিয়ে রাতে বাড়ি ফেরার পথে অপর পক্ষ তার ওপর অতর্কিতে হামলা চালালে ঘটনাস্থলেই তিনি নিহত হন। তার আগের দিন অর্থাৎ ১৫ এপ্রিল দিবাগত রাতে বাঁশখালী উপজেলার সরল ইউনিয়নে বিবদমান স্থানীয় দুটি পক্ষের বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষের গুলিতে আবুল কালাম (৪০) নামে একজন নিহত হন। তিনি ওই এলাকার কবির আহমদের ছেলে। গত ৭ এপ্রিল রাত সাড়ে এগারোটার দিকে নগরীর বক্সিরহাটের এলাকায় সড়কের পাশ থেকে উৎপল দে (৩০) নামে এক স্বর্ণ কারিগরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত উৎপল নগরীর প্রাচীন স্বর্ণ ব্যবসায়ী দানু মিয়া সওদাগর এন্ড সন্স’র কারিগর হিসেবে কাজ করতেন। উদ্ধারের সময় লাশের দুই হাত ভাঙা এবং বাম হাতে আঘাতের দাগ ছাড়াও গলায় গামছা পেঁচানো ছিল। তবে, তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে ময়না তদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষায় রয়েছে পুলিশ। এছাড়া, গত ১১ এপ্রিল উপকূলীয় বাঁশখালী উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়নের চেমটখালী এলাকায় র‌্যাবের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে দেলোয়ার হোসেন (৩৫) নামে একজন নিহত হয়েছে। তিনি একই ইউনিয়নের খুদুকখালী এলাকার নুরুল আলমের ছেলে। র‌্যাবের দাবি, ডজনখানেক মামলার আসামি দেলোয়ার একজন পেশাদার ডাকাত। তাকে গ্রেপ্তারে অভিযানে গেলে র‌্যাবকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়। র‌্যাবও পাল্টা গুলি বিনিময় করে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থালেই নিহত হন দেলোয়ার। ঘটনাস্থল থেকে র‌্যাব একটি বিদেশি রিভলবার, চারটি দেশি অস্ত্র ও ২২টি কার্তুজ উদ্ধার করে। গত ২২ এপ্রিল বিকালে নগরীর আছদগঞ্জের অপরাধপ্রবণ কলাবাগিচা এলাকায় পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন মো. ওয়াসিম (৩৫) নামে একজন। পুলিশের দাবি, ওয়াসিম ১৪ মামলার আসামি ও তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। তাকে গ্রেপ্তার করতে গেলে এ বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। একইদিন গভীর রাতে নগরীর ডবলমুরিং থানার আগ্রাবাদ জাম্বুরি মাঠের পাশে পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে যুবলীগ নামধারী মো. জাবেদ ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এ ঘটনায় ডবলমুরিং থানার ওসি সদীপ কুমার দাশসহ চার পুলিশ সদস্য আহত এবংঘটনাস্থল থেকে কয়েকটি অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়েছে বলে দাবি পুলিশের। নিহত জাবেদ পাহাড়তলী বাজারে ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা মহিউদ্দিন সোহেল হত্যা মামলার আসামি। এছাড়া, পুলিশের এক উপ-পরিদর্শকের বাসা থেকে খোয়া যাওয়া অস্ত্র নিয়েই তিনি অপরাধকর্ম করে বেড়াতেন বলে পুলিশের অভিযোগ।
স্বজনের রক্তে রঞ্জিত আপনজনের হাত ঃ গত ১৭ এপ্রিল চান্দগাঁও থানাধীন খড়মপাড়া ওসমান হাজীর বাড়িতে ছোট ভাই মুন্নার ছুরিকাঘাতে নিহত হন তার আপন বড়ভাই মোহাম্মদ সাজু (২৮)। তারা ওই এলাকার ছিদ্দিক আহমদের ছেলে। ঘটনার পরদিন বিকেলে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মুন্না জানিয়েছেন, সাজুর কাছে থাকা ইয়াবা ফেরত চাইলে তিনি সেবন করে ফেলার কথা জানায়। এ নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে মুন্না তার কাছে থাকা টিপ ছুরি দিয়ে সাজুকে আঘাত করে। এতেই তার মৃত্যু হয়। গত ১৪ এপ্রিল বর্ষবরণের দিন নগরীর কাজির দেউড়িতে মাদকাসক্ত ছেলে রবিন বড়ুয়া খোকনের ছুরিকাঘাতে খুন হন পিতা রঞ্জন বড়ুয়া। চাহিদামত টাকা না পেয়ে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে পিতার পেটে ছুরি চালিয়ে পরপারে পাঠিয়ে দেন ছেলে রবিন। গত ৫ এপ্রিল পারিবারিক কলহের জেরে মীরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ থানার পশ্চিম অলীনগর গ্রামের মহাজনপাড়ায় স্বামীর কোদালের কোপে প্রাণ হারান স্ত্রী নূর বানু (৪০)। ঘটনার পর ঘাতক স্বামী আব্দুল মান্নান (৪৫) কে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন প্রতিবেশিরা।