তিন আলোচিত হত্যাকান্ডের কূলকিনারাহীন তদন্ত

52

প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দিতে হত্যাকান্ডের বিবরণ এবং ঘটনাস্থল থেকে আলামত জব্দের পরও নগরীতে সংঘটিত অন্তত তিনটি আলোচিত হত্যা মামলা কিনারাহীন তদন্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তারা নানা কৌশলে রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে দাবি করলেও অনেকটা আঁতুরঘরেই থমকে আছে মামলার তদন্ত। মামলার বাদীপক্ষের কেউ কেউ হতাশা প্রকাশ করলেও তদন্ত কর্মকর্তারা হাল ছাড়ছেন না।
সাধারণ্যে ব্যাপক আলোচনার ঝড় তোলা চাঞ্চল্যকর এই তিনটি হত্যা মামলা হল, শিকলবাহার ভেল্লাপাড়া ব্রিজ এলাকায় শ্যামলী পরিবহণের বাসচালক জালাল উদ্দিন, চকবাজারের তেলিপট্টি এলাকায় নার্সিং কলেজের শিক্ষিকা অঞ্জলী দেবী এবং বাকলিয়া ল্যান্ডমার্ক আবাসিক এলাকায় শয়নকক্ষের খাটের উপর স্কুলছাত্রী ইলহাম বিনতে নাসিরকে ধারালো ছুরি দিয়ে জবাই করে হত্যা মামলা। এর মধ্যে বাসচালক জালাল উদ্দিন হত্যাকান্ডে সংশ্লিষ্টতা নিয়ে অভিযোগের তীর প্রশিক্ষিত বাহিনীর দিকে। ঘাতক দলের সদস্যরা নিজেদের ডিবি পুলিশ পরিচয় দেয়ার পাশাপাশি ডিবি তাদের হাতে অস্ত্র, হাতকড়া ও ওয়্যারলেস সেট ছিল বলে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দু’জন সাক্ষী আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন। তবে, নগর পুলিশ ও র‌্যাবের পক্ষ থেকে ঘটনার দিন উল্লেখিত সময়ে তাদের কোনও টিম সেখানে অভিযান পরিচালনা করেনি বলে জানানো হয়েছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, গত ২২ এপ্রিল রাতে কর্ণফুলীর শিকলবাহা ভেল্লাপাড়া ব্রিজ এলাকায় শ্যামলী পরিবহনের বাসচালক জালাল উদ্দিনের কাছে ইয়াবা আছে দাবি করে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে পিটিয়ে আহত করা হয়। গুরুতর অবস্থায় তাকে চমেক হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন। সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নিহত ব্যক্তির শরীরের পিঠ, কোমর, হাঁটু ও হাতের কবজিতে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
এ ঘটনায় নিহত বাসচালকের ছোট ভাই জুয়েল হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে নগরীর কর্ণফুলী থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, ডিবি পুলিশ পরিচয়ে গাড়িতে ওঠা লোকজনের হাতে অস্ত্র, হাতকড়া ও ওয়্যারলেস সেট ছিল। হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ২৪ এপ্রিল সন্ধ্যা থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারসহ ৮৮টি রুটে বাস ধর্মঘট পালন করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। ঘটনার শুরু থেকে মামলাটি তদন্ত করছে নগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বাসটির সুপারভাইজার আজিম উদ্দিন ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় এক ব্যক্তি গত ২৬ এপ্রিল মহানগর হাকিম শফি উদ্দিনের আদালতে সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তারা বলেন, কক্সবাজার থেকে যাত্রী নিয়ে গাজীপুরগামী বাসটি রাত সাড়ে ১১টার দিকে শিকলবাহা ভেল্লাপাড়া ব্রিজ এলাকায় পৌঁছালে চারজন লোক ডিবি পুলিশ পরিচয়ে গাড়িটি থামান। তাদের হাতে অস্ত্র, হাতকড়া, ওয়্যারলেস ও টর্চলাইট ছিল। বাসে উঠে তারা চালক জালালকে বলেন, তার কাছে ইয়াবা আছে। এরপর বাসচালককে হাতকড়া পরিয়ে বাস থেকে মারধর করতে করতেই নামানো হয়। একটি মাইক্রোবাসে চড়ে ওই ব্যক্তিরা ঘটনাস্থলে আসেন। মাইক্রোবাস থেকে নেমেই তারা বাসটিকে থামার সঙ্কেত দেন। মাইক্রোবাসের পেছনে একটি জিপগাড়ি ও একটি প্রাইভেট কারও ছিল। সবকটি গাড়ি একসঙ্গে ছিল।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক আফতাব হোসেন বলেন, ইতিমধ্যে দুজন সাক্ষী আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ফুটেজ পর্যালোচনার পাশাপাশি নানা সূত্র থেকে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে, ডিবি পুলিশের কোনও টিম সেদিন ঘটনাস্থলে না থাকার ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হয়েছি।
নার্সিং কলেজের শিক্ষিকা অঞ্জলী হত্যা মামলা ঃ ২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি শীতের সকালে কর্মস্থলের উদ্দেশে বাসা থেকে বেরিয়ে কয়েক কদম এগুতেই নগরীর চকবাজার তেলিপট্টির মোড় এলাকায় মুখোশধারী সশস্ত্র চার যুবকের হামলার শিকার হন নার্সিং কলেজের জ্যেষ্ঠ শিক্ষিকা অঞ্জলী দেবী। ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার ঘাঁড়, মাথা ও পিঠসহ শরীরের বিভিন্নস্থানে এলোপাথারি কোপানো হয়। গুরুতর অবস্থায় তাকে চমেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আধঘন্টা পর তিনি মারা যান। ওইদিন বিকালেই তার স্বামী ডা. রাজেন্দ্র চৌধুরী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনার পর পাঁচলাইশ থানা পুলিশের পাশাপাশি নগর গোয়েন্দা শাখার তৎকালীন সহকারী কমিশনার (এসি) জাহাঙ্গীর আলমও তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেন। পুলিশ কর্মকর্তারা প্রত্যক্ষদর্শী ও কর্মস্থলের সহকর্মীসহ বিভিন্নজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কিলিং মিশনে ক’জন ছিল তা নিশ্চিত হতে পারলেও খুনিদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করতে পারেন নি। এমনকি কী কারণে এ হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে সেই রহস্যও উদঘাটিত হয়নি। এখনও গোয়েন্দা শাখাই মামলাটি তদন্ত করছে।
মামলার বাদী ও নিহত শিক্ষকার স্বামী ডা. রাজেন্দ্র চৌধুরী বলেন, ‘হত্যাকান্ডের পর পুলিশ কর্মকর্তারা এসে আমাদের কাছে যা জানতে চেয়েছে, আমরা সব তাদের খুলে বলেছি। এরপর তারা কী কারণে এতদিনেও খুনিদের শনাক্ত কিংবা গ্রেপ্তার করতে পারল না জানিনা। মনে হয়, এ দেশে আমরা খুনের শিকার হলেও কোনও বিচার হবে না। এমনকি কারা, কী কারণে খুন করেছে তাও জানা যাবে না।’
বাকলিয়ায় স্কুলছাত্রী ইলহাম বিনতে নাসির হত্যা মামলা ঃ নগরীর বাকলিয়া ল্যান্ডমার্ক আবাসিক এলাকার এমএস লায়লা ভবনের ছয়তলায় দুই মেয়ে ইলহাম বিনতে নাসির ও জারিন বিনতে নাসিরকে নিয়ে থাকতেন মা নাসরিন আক্তার খুশবু। স্বামী মো. নাসির প্রবাসী। গত বছরের ২৭ জুন সকাল আটটায় ছোট মেয়ে জারিনকে স্কুলে পৌঁছে দিতে বাসা থেকে বের হন তিনি। বাসায় ফিরে দেখেন বিছানায় বড় মেয়ের গলাকাটা রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। এ সময় তার চিৎকার শুনে এগিয়ে আসেন পাশের ফ্ল্যাটে থাকা তার ছোট জা-এর ভাই শিক্ষানবিশ আইনজীবী রিজুয়ান কবির রাজু। তিনি এসে ইলহামকে উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালে নিয়ে যান। ঘটনার দু’দিন পর বিদেশ থেকে ফিরে আসেন ইলহামের বাবা নাসির। তিনি বাকলিয়া থানায় মামলা দায়ের করেন। এর পর সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে রিজুয়ান কবির রাজুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। কিন্তু তিনি হত্যাকান্ডে নিজের সম্পৃক্ততা কিংবা দায় স্বীকার করেন নি। পরে জামিনে কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। শুরুতে ডিবি পুলিশ তদন্ত করলেও গত বছরের ২৬ জুলাই মামলাটি তদন্তের জন্য সিআইডিতে পাঠানো হয়।
মামলার সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক স্বপন কান্তি বড়–য়া পূর্বদেশকে বলেন, ইলহামের খুনি এখনও আমাদের সন্দেহের তালিকাতেই রয়েছে। উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ এখনও হাতে না আসায় কাউকে সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা যাচ্ছে না। তবে বিভিন্ন সূত্রে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে আমরা খুনির ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছি।