তারা কবিতার জন্য হাস্যকর কি না আমি জানি না

120

কবির গতিবিধি সর্বব্যাপিত, অর্থবোধক। দূরদর্শি, পশ্চাৎ বিচারি। একই সাথে অন্তরস্থ ধ্যানও বহুমাত্রিক পূর্বপরে নানা ব্যঞ্জনা ও উৎপ্রেক্ষায় উপস্থাপিত হয়। বর্তমানকে এসবের মধ্যদিয়ে নাড়া দেন। পানি যেভাবে নাড়া দিলে ঢেউ তৈরি হয়, আবার কিছুক্ষণ পর তা মিলিয়ে যায়, মিলিয়ে গেলেও তার মধ্য দিয়ে যেমন একটি পরিবর্র্তন সূচিত হয়। কবির নাড়াও তেমনই। চিন্তার প্রহেলিকায় সময় নড়ে উঠে। নানান দোদুল্যমানতায় হইচই পড়ে। একটা সময় পর আবার তা জীবনের অনুসঙ্গ করে নেয় মানুষ। এ কারণেই কবিরা অসাধারণ। গণমানুষ নন, তবে গণমানুষের। ফলে কোনো দেশ বা জাতি কবিকে একক করে বাঁধতে পারে না। যেহেতু কবি গণমুখি। দেশ বা জাতি ও জাত-ব্যক্তি স্থানিক। সেহেতু কবি প্রতুল ভাবনার পুরোধা নন।
মানুষ যেভাবে ভাবে কবি সেভাবে ভাবেন না বলেই, ভাবতে চান না বলেই এমনটা হয়। যেমন: ‘অনেক পথ হেঁটে এলাম’ যদি কোনো সাধারণের কথা হয়। তবে শুধু তা পথে আসার কথা হয়। সরল ভাবে। কবি যখন বলেন তখন তা দূরঅণীত ও দূরভবিষ্যের কথাও হতে পারে। তা হয় জীবনের অনেক পথ পাড়ি দেয়ার ইঙ্গিত। তার আলাপ যায় আরও পাড়ি দেয়ার দিকে। সে হাঁটা পথে অণীত ও ভবিষ্যের সবরকম ঘটনাপ্রবাহের কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়ার কথা হয়। অণীতকে কষ্টদায়ক বলা হতে পারে। ভবিষ্যের কণ্ঠকাকিণ্যের কথাও হতে পারে।
আজ পর্যন্ত যা হয়েছে, চিন্তার ব্যাকরণ তৈরি হয়নি, ধারণা তৈরি হয়েছে। সুনির্দিষ্ট করা যায়নি। কবির চিন্তা মূলু এমনই, বাঁধা পড়ে গেলে কবিতা শেষ হয়ে যেতে পারে। তখন কবি নিজে নিজে শিক্ষক হয়ে ওঠবেন, এটা হওয়া ক্ষতিকর। তিনি কবি, যিনি কর্মে নিয়ম ও জ্ঞানে মহান হওয়ার ভাবনা থেকে দূরত্বে অবস্থান করেন।
কবি ও কবিতা কী এবং কী নয়, তা কেবল ভাষাগত মাধুর্য্যতা দ্বারা নিরূপণ করা হয়। ভাষায় রূপক-নন্দনশৈলী দ্বারা মন কতটা আলোড়িত, তার বিচার করা হয়। দূরদর্শনের একটা প্রকট রূপ দেখা হয়। আকারও বিশ্লেষ্য হচ্ছে, নানান ধরণও। কিন্তু কথা হচ্ছে, তাতে কোনো সীমায় পৌঁছানো যাচ্ছে না। এখানে যা কথা বলা হচ্ছে, তার বাইরের এবং গুরুত্ববহ একটি বিষয় হচ্ছে গুণ। এটা কবির ক্ষেত্রে একরকম, কবিতার ক্ষেত্রে অন্যরকম। তবে এখানে কোনো গুণেরই উপযুক্ততা নেই। কবির চেয়ে কবিতা অনেক বেশি মুখ্য। কবিতা কী হবে কী হবে না, তার থেকে বড় ব্যাপার হলো, কবি কোনোভাবেই কোনো যাপিত অংশের মুখপাত্র নন, চাই তা হোক বড় কোনো শক্তি বা মহৎ কোনো আদর্শ।
দৃশ্যত কবি পোস্টারে দৃশ্যমান, কবিতাও। তার কোষের প্রতি দৃষ্টি প্রসারিত হয় না। (কোষ হচ্ছে আত্মার পাঁচটি আবরণের তৃতীয়টি)। যদি একটি নির্মিত সম্পূর্ণ দেয়ালের দৃশ্যে স্ত‚প-স্ত‚প বালির কতা চিন্তায় আনা যায়, তবে কবিতা ও কবির ভেতর বিচ্ছিন্ন কোষের একত্রিত সমষ্টি থেকে আলাদা-আলাদা প্রতীক নির্ণয় করা কেনো সম্ভব হয় না! এটা দূরদৃষ্টি সম্পর্কিত সমস্যা। অর্র্থাৎ মনের দৃষ্টিক্রিয়া আর মনোময় দৃষ্টিক্রিয়ার মত ব্যাপারগুলো বুঝতে না পারার সমস্যা।
কবিতা দগদগে। চাপ ও ছাপে কবিতা ধূসর হয় না। কবিতার রঙই ধূসর। অকবিতার রঙ স্পষ্ট কালো, তা স্পষ্ট দেখাও যায়। সে কারণে প্রকৃত কবিতার রঙ-রূপ সবাই দেখতে পায় না। যারা চিন্তায় করিৎকর্মা তারাই মূলু কবিতার গুণগ্রাহী। তবে তারাও কবিতার সর্বআকার দেখেন না। কবির আকারও অনেকটা তা-ই। অবশ্য সাধারণে কবি শব্দের একটি তাৎপর্য ভাবা হয়। তবে তার সুনির্দিষ্টতা নেই, এটাই প্রকৃত ঠিক। তারা এ ভাবনা যদিও অবচেতনে ভাবেন। কিন্তু এটা তাদের মনগঠিত হলেও এটার একটি তাৎপর্য তাদের কাছে আছে।
এ যাবত কবি ও কবিতা নিয়ে যা কিছু বলা হয়েছে, আক্ষরিকভাবে, তার সবই ভুল বলা যায় কিনা জানি না। যদি হয়, এ ভুলেরও কোনো প্রমাণ নেই। এটা প্রমাণ সাপেক্ষ বিষয়ও নয়। এটা কবিতার মতোই আবছায়া। এভাবে ধরে আপাতত এগুনো যায়। কবিতা এক নিরক্ষর অনুভ‚তিপ্রবণ বিষয় হতে পারে। নাও হতে পারে। তবে, একটি বিষয় আপাতত স্পষ্ট যে, যা লেখা হয় তা কবিতা হিসেবে ধরে নিলে আমরা কবিতার দিকে অগ্রসর হতে পারি। প্রান্তে নাই-বা পৌঁছালাম। এও মনে হয় যে, কবিতার প্রান্তে না-পৌঁছানোই সবচেয়ে ভালো। তাতে কবিতা বলতে যা বুঝাতে চাওয়া হয়, কবির কাছে তা আর থাকবে বলে মনে হয় না। বাঁধা পড়ে যাবে। একরকম মনোবৈকল্য তৈরি হতে পারে।
কবিতার ব্যাপারটা কি? বাস্তবভাবে তা কেউ জানে না বা জানবে না। আত্মার মত। কোথায় থেকে আসে, আবার কোথায় যায় কেউ জানে না। কবিতা কোথায় থেকে শুরু হয়, আবার কোথায় গিয়ে থামে কবিও জানেন না। সূতরাং আত্মা ও কবিতার এক আত্মীয় সম্পর্ক আছে। কিন্তু কবিতা কী তা উৎঘাটিত হয় না। হবেও না। না-হওয়াটা কবিতার জন্য মঙ্গলজনক। এতে কবিতার আয়ূ দীর্ঘায়ূ হবে বলে মনে হয়।
কবিতা কি? জবাব অনেকে অনেকভাবে দেয়। কোনটাই যথার্থ ধারণ করি না, একেবারে অস্বীকারও করি না। এটি একটি অনির্ধারিত এবং অণল কল্পনা হতে পারে। এমনও হতে পারে, যা কখনো হয়নি অথবা কখনো হবেও না। অনেকে নন্দন নিয়ে ভাবেন। নন্দন কবিতার আলোচিত বিষয়। কিন্তু অণটা আরাধ্য নয়, যুটা আলোচিত হয়। আবহ মাত্র। এমন আবহ আরও অনেক আছে। অনির্ধারিত যাপনই কবিতা হতে পারে, ক‚ন্য থেকে ক‚ন্যের দিকে ধাবমান এক নৈশচর। যেখানে কাছ দেখা যায় না, দূরও দেখা যায় না।
ধারণায় ভাবনার ভেতর দিয়ে কবিতা চলে। এভাবে চলাই ভালো। ভাবনার ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলছে। কোনো লক্ষ্যমাত্রার দিকে এগুচ্ছে না। এটা খুবই আনন্দের। তার মূল নেই, প্রান্ত নেই। সে আছে কি নেই, তাও জানা নেই। স্থাবর কোনো রেখা নেই। কিন্তু সে আসে। কবির উপর ভর করে। কবিকে নাড়া দেয়, কবিতার ভেতর দিয়ে পাঠককে নাড়া দেয়। তার বাইরে যাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে, তারা কবিতার জন্য হাস্যকর কিনা আমি জানি না। কবিতা ধারণার বাইরের বিষয় নয়, তার অস্থিত্ব আছে অথবা নাই। হতে পারে, এ কারণে কবিতা শুধু কল্পনাও নয়। বাস্তবতার খুব কাছে নিকটজনের মত তার অবস্থান হয়ত আছে।
বাস্তবভাবে মানুষ যা কিছু বলে, সেগুলো সত্য মানাটা মানুষের জন্য স্ববিরোধী, সীমাবদ্ধতা। সেটা যদিও কেউ স্বীকার করবে না। সে নিজেকে নিজেই যদি ভাবে সে বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারে। তবে মানুষের সব স্ববিরোধী, চরম মিথ্যা ও প্রতারণামূলক দেখা যায়। মন, ধ্যান, বাসনা বা আকাক্সক্ষা, প্রাণ যা কাছে কিন্তু অচ্চুত অবস্থানে থাকে, তাকেই সে বাস্তব মনে করে। এগুলোর অস্থিত্ব কোথায় প্রমাণিত? দেহকে মানুষ পাত্তা দেয় না। অথচ দেহ দৃশ্যমান। এ কথার অবতারণা এ কারণেই যে, কয়টি লাইন পড়ে কবিতা বুঝতে চেষ্টা করা বা লিখে কবিস্বভাবী হওয়ার প্রদর্শন করা, যে কারো জন্য সহজ, ব্যাপার উপলব্ধি সহজ নয় কেবল। দৃশ্যত শরীর পাঠ করা যু সহজ, অদৃশ্য মন-প্রাণ-আকাক্সক্ষা পাঠ করা ততটাই কঠিন। কঠিনকে সহজের স্থলে, সহজকে কঠিনের স্থলে রেখে আমরা বোধের সীমাবদ্ধতা নিয়ে পথ চলছি।