তারা অমানবিক মেধাবী !

74

অনেকেই বলেন, বুয়েটে শুধু মেধাবীরাই ভর্তির সুযোগ পেয়ে থাকেন। জানি না, তাঁরা কোন পরিসংখ্যায় এমন কথা বলেন! আর মেধাবী কাকে বলে-এটিও ‘মেধাবী’ বলা ওইসব মানুষগুলো স্পষ্ট করেননি। তবে, আবহমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে- শুধু মেধাবীই নয়, অমানবিক মেধাবীও একই সুযোগ পেয়ে আসছে সেই দীর্ঘদিন ধরে।
২০১৩ সালের ৯ এপ্রিল চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ও নজরুল ইসলাম হলের ২২৪ নম্বর কক্ষের ছাত্র আরিফ রায়হান দ্বীপকে। তাঁর অপরাধ সে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী।
দ্বীপের অপরাধ, শাহবাগ আন্দোলনের প্রথম পোস্টার রচনা করলেন কেন! দ্বীপের অপরাধ ছিল, ‘এই পথে আজ জীবন দিব, রক্তের বদলা ফাঁসি নেব’-এই স্লোগান নিজ হাতে লিখে শাহবাগ আন্দোলনের প্রাক্কালে রাস্তায় নেমে এসে কেন প্লেকার্ড জাতির সামনে তুলে ধরেছিল! দ্বীপের অপরাধ, দ্বীপ ছাত্রলীগের যুগ্ম আহবায়ক ছিল! দ্বীপের অপরাধ, দ্বীপ মৌলবাদগোষ্ঠী হেফাজতের বিরুদ্ধে লিখত, দ্বীপ স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে লিখত!


ব্যস! এই লেখালেখির কারণে, মতের অমিল হওয়ায় তথাকথিত হেফাজত নামক মৌলবাদী সংগঠনের সমর্থক বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মেজবাহ নামক ‘অমানবিক মেধাবী’ ছাত্রটি আরিফ রায়হান দ্বীপকে বুয়েট ক্যাম্পাসে হত্যার উদ্দেশ্যে নির্মমভাবে কুপিয়ে পালিয়ে যায়।
দুই মাস জীবন-মরণ যুদ্ধ শেষে মৃত্যুর কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে দ্বীপ এ পৃথিবী থেকে চিরতরের জন্য চলে যায়। এখন ছাত্রলীগ নামধারী তথাকথিত যে নেতারা আবরার ফাহাদ নামক শিক্ষার্থীর ফেসবুকের স্ট্যাটাস এবং ওই স্ট্যাটাসের আলোচনা-সমালোচনা কিংবা মতের অমিল হওয়ায় (এই পর্যন্ত মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্য) রুম থেকে ডেকে নিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করল; তারাও প্রতিক্রিয়াশীল ‘অমানবিক মেধাবী’।
তাহলে বলতে হবে, বুয়েটে শুধু মেধাবীরাই ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে না, অমানবিক মেধাবীরাও সমান সুযোগ নিয়ে একটি হত্যার মধ্য দিয়ে কয়েকটি স্বপ¦কে হত্যা করছে, হত্যা করছে সত্যিকারের মেধাবীদের। দ্বীপের মত ছাত্রকে নির্মমভাবে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা কোনও মানবিক মেধাবী ছাত্রের কাজ হতে পারে না। আবরার ফাহাদের মত শিক্ষার্থীকে ভোঁতা ও শক্ত কিছু একটা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করাও কোনও মানবিক মূল্যবোধ ছাত্রের কাজ হতে পারে না। তারা অমানবিক মেধাবী। তারা শুধু বুয়েট বিদ্যাপীঠের নয়, তারা মেধাবী ও মানবিক মূল্যবোধ শিক্ষার্থীর জন্য ভয়ঙ্কর শত্রু।
মূল কথা হচ্ছে, নষ্ট রাজনীতির ছত্রছায়ায় আমাদের শিক্ষার্থীরা মেধাধী হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে মানবিক-এর আগে ‘অ’ যুক্ত হয়ে বেড়ে উঠছে। কারণ, সিনিয়রদের রেখে যাওয়া অপসংস্কৃতিকে তারাও সংস্কৃতি মনে করে সেটা প্রয়োগ করার চেষ্টা করছে।
আমাদের অনেকের নিশ্চয় মনে আছে, ডাকসুর দুইবারের ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্নাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে লাশের রাজনীতি করতে চেয়েছিল। সেই অডিও রেকর্ড আজও কানে বাজে। নোংরা রাজনীতির জন্য, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোল গড়ে তোলার জন্য, শেখ হাসিনার সরকার উৎখাত করার জন্য একটি লাশের বড্ড প্রয়োজন ছিল! সেটি কোন মা’র সন্তান সেটি আমাদের এইসব রাজনীতিবিদদের দেখার বিষয় নয়। ওই লাশটি কোন বাবা’র পরিশ্রমের স্বপ্ন-এটিও আমাদের দেশের একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতাদের বিবেচনার বিষয় নয়। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে একটি লাশ চাই! একটি লাশের মিছিল করতে হবে বলে…!
ছাত্রলীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী আজ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে না-এটা নিশ্চিত। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দর্শন তাদের গবেষণার বিষয় বলে মনে করে না। কারণ, এই ছাত্রলীগকে কতিপয় সিনিয়র নেতারা নষ্ট করে দিয়ে গেছে। কতিপয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর মনোজগতেও আজ ‘সাম্প্রদায়িক’ বা ‘প্রতিক্রিয়াশীলতা’ বিরাজ করছে। ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা’ আর ‘মানবিক মূল্যবোধ’ থেকে ছাত্রলীগের কতিপয় নেতাকর্মী অনেকটাই দূরে সরে গেছে। তা না হলে, মৌলবাদগোষ্ঠীর হেফাজতকর্মী দ্বীপের ক্ষেত্রে যা করেছে, ছাত্রলীগের কর্মী হয়ে তা কখনোই করার কথা নয়। এরা আর যাই হোক, নামধারী ছাত্রলীগ হলেও এরা সত্যিকার অর্থে মূলধারার ছাত্রলীগের নেতাকর্মী নয়। ছাত্রলীগের ইতিহাস-ঐতিহ্য আর আদর্শের সাথে শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার কর্মকাÐ; ছাত্রলীগে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছে, ছাত্রলীগকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে!
আমাদের আরেকটি বড় সমস্যা, বিচারপ্রক্রিয়া। প্রতিটি হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দ্রæত বিচার ট্রাইব্যুনালে খুনের সাথে সম্পৃক্ত অপরাধীদের দৃষ্টান্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে আমাদের বছরের পর বছর লেগে যায়। এখানে আমাদের আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। প্রতিটি অপরাধের কঠোর শাস্তি নিশ্চিতকরণে সময় অপচয় কিংবা ব্যর্থ হলে, এই ধরনের হত্যার শিকার হয়তো আমার, আপনার, আমাদের কারো না কারো সন্তানের নাম যুক্ত হতে সময়ের ব্যাপার মাত্র।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)