তাপমাত্রার পারদ চড়ছে আসছে ঘূর্ণিঝড়

73

ফাল্গুনের বিদায়বেলায় তাপমাত্রার পারদ ক্রমান্বয়ে চড়তে থাকায় ধরণীও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এরই মধ্যে দেশের সবক’টি অঞ্চলের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার পারদ তিরিশ ডিগ্রির ঘর ছাড়িয়ে গেছে। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড ও টেকনাফে দেশের সর্বোচ্চ ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। চলতি মার্চেই তা চল্লিশের ঘরে গিয়ে ঠেকার আভাসও রয়েছে। মাসের একেবারে শেষদিকে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাতজনিত কারণে রয়েছে আকস্মিক বন্যার শঙ্কা।
অপরদিকে, আগামি এপ্রিল ও মে মাসে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট একাধিক নিম্নচাপ থেকে অন্তত দু’টি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে। একই সময়ে দেশের ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহও বয়ে যেতে পারে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তিন মাস (মার্চ, এপ্রিল ও মে) মেয়াদী পূর্বাভাসে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। তিন মাসের দীর্ঘমেয়াদী এই পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, মার্চে সামগ্রিকভাবে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের আলামতই বিদ্যমান রয়েছে। দিনের তাপমাত্রা এ মাসে স্বাভাবিক (৩৪-৩৬ ডিগ্রি) অপেক্ষা সামান্য কম থাকার সম্ভাবনা আছে। তবে মাসের শেষের দিকে দেশের পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ওপর দিয়ে একটি মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। এ মাসে রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য বেশি থাকতে পারে। মাসের শেষ সপ্তাহে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাতজনিত কারণে আকস্মিক বন্যার শঙ্কা রয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। তারপরের এপ্রিল মাসের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এ মাসে দেশে স্বাভাবিক থেকে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে। পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দু’টি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে একটি রূপ নিতে পারে ঘূর্ণিঝড়ে। পুরো মাসজুড়ে দেশের উত্তর থেকে মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত দুই থেকে তিনদিন বজ্রপাতসহ মাঝারি থেকে তীব্র কালবৈশাখী অথবা বজ্রঝড় এবং দেশের অন্যত্র চার থেকে পাঁচদিন হালকা থেকে মাঝারি কালবৈশাখী বা বজ্রঝড় হতে পারে। পাশাপাশি দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং অন্যত্র এক থেকে দু’টি মৃদু বা মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।
সর্বশেষ মে মাসের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এ মাসে দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের লক্ষ্যণই বিদ্যমান রয়েছে। একই সময়ে বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দু’টি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে একটি রূপ নিতে পারে ঘূর্ণিঝড়ে। মে মাসজুড়ে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে দুই থেকে তিনদিন মাঝারি থেকে তীব্র কালবৈশাখী এবং দেশের অন্যত্র তিন থেকে চারদিন হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার কালবৈশাখী ঝড় হতে পারে। পাশাপাশি দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এক থেকে দু’টি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং অন্যত্র দুই থেকে তিনটি মৃদু বা মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান আবহাওয়ার সম্ভাব্য গতিপ্রকৃতিকে স্বাভাবিক উল্লেখ করে বলেন, এবার যথাসময়েই কালবৈশাখী মৌসুম শুরু হয়েছে। ফাল্গুনের শেষপক্ষে এসে প্রকৃতিতে নানা পরিবর্তন সূচিত হয়। ঋতু-পরিক্রমায় প্রকৃতির এই পালাবদল স্বাভাবিক। ফাল্গুনের বিদায়ের দিন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে বাড়তে থাকে তাপমাত্রাও। তারপর ধারাবাহিকভাবে দমকা হাওয়া, শিলাবৃষ্টি, কালবৈশাখী ও ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়ে থাকে।
অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার জন্য প্রচারিত আবহাওয়ার দৃশ্যপটে বলা হয়েছে, পশ্চিমা লঘুচাপের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। আর পূর্বাভাসে বলা হয়, রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং খুলনা, ময়মনসিংহ ও ঢাকা বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ী দমকা বা ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া, দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানতঃ শুষ্ক থাকতে পারে। দেশের পশ্চিমাঞ্চলে দিনের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস এবং অন্যত্র অপরিবর্তিত থাকতে পারে। সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে। পরবর্তী আটচল্লিশ ঘন্টা বা দু’দিনের আবহাওয়ার অবস্থায় বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে। আর বর্ধিত পাঁচদিনের আবহাওয়ার অবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এর আগে গত ৩ মার্চ ভোরে এবারের মৌসুমের প্রথম শিলাবৃষ্টির দেখা মেলে। ওইদিন ভোরের আলো না ফুটতেই মাদারীপুরের শিবচর, ফরিদপুর ও চাঁদপুরে কয়েক মিনিট স্থায়ী শিলাবৃষ্টি হয়েছে। এতে আমের মুকুল ও ফসলের ক্ষেতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পরদিন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সাত জেলার ওপর দিয়ে কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যায়। চট্টগ্রাম বিভাগের চাঁদপুরে শিলাবৃষ্টির দেখা মিললেও সদরসহ অধিকাংশ এলাকায় এখনও কালবৈশাখী ঝড়ে আক্রান্ত হয়নি। বরং এখানকার উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতেই গত কয়েকদিন ধরে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হচ্ছে। শিলাবৃষ্টির পরদিন অর্থাৎ গত ৪ মার্চ রাতে ঢাকা ছাড়াও ফরিদপুর, মাদারীপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইলসহ আশপাশের এলাকার ওপর দিয়ে মৌসুমের প্রথম কালবৈশাখী ঝড় আঘাত হানে। এসময় কোথাও ঝড়ো বাতাসের গতি, আবার কোথাও বৃষ্টির দাপট বেশি ছিল।
প্রকৃতিবিশারদদের মতে, নামে বৈশাখ যুক্ত থাকলেও শীতের বিদায়ের পর ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, সমগ্র পূর্ব এবং উত্তরপূর্ব ভারতে যে ঝড় বয়ে যায় তাই কালবৈশাখী। বাংলা বর্ষের শুরুতে মানে বৈশাখ মাসে এ ঝড় তুলনামূলকভাবে বেশি হয় বলেই এ ঝড় কালবৈশাখী নামে পরিচিত লাভ করেছে। কালবৈশাখীর আসল নাম ‘নর-ওয়েস্টার’। অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে এই ঝড় ধেয়ে আসে বলে একে বলে ‘নর-ওয়েস্টার’। তাই বলে কালবৈশাখী শুধুমাত্র বৈশাখ মাসেই (১৫ এপ্রিল থেকে ১৫ মে পর্যন্ত) দেখা যাবে- এমনটি নয়। কালবৈশাখী এবং সাধারণ ঝড়ের মধ্যে পার্থক্য বিচার করার কিছু মাপকাঠি রয়েছে। মোটা দাগে বলা যায়, ঝড়ের গতিবেগ ঘন্টার ৫০ কিলোমিটারের বেশি এবং স্থায়ীত্ব অন্তত একমিনিট হলে সেটাই কালবৈশাখী ঝড়।
উল্লেখ্য, এশিয়া অঞ্চলের আবহাওয়াবিদরা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রাকে তীব্র তাপপ্রবাহ, ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মাঝারি এবং ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মৃদু তাপপ্রবাহ হিসেবে গণনা করেন।