তরুণরা জীবনের লক্ষ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন কেন ?

145

ঢাকার একটি পত্রিকা ‘তরুণরা কী ভাবছেন’? শিরোনামে একটি জরিপ করেছে। সেখানে ১৫-৩০ বছর বয়সী এক হাজার ২০০ তরুণের মতামত নেয়া হয়েছে। পত্রিকাটি লিখেছে, ‘জাতিসংঘের সংজ্ঞায় যাদের বয়স ২৫-২৯ বছরের মধ্যে, তাদেরই তরুণ বলা হয়। বিশ্বব্যাপী এই তরুণের সংখ্যা ১৮০ কোটি। আবার ১৬ কোটির বেশি জনসংখ্যার বাংলাদেশে তরুণের সংখ্যা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। বাংলাদেশে নির্ভরশীল মানুষের তুলনায় কর্মক্ষম জনসংখ্যার পরিমাণ বেশি। এই সুবিধা থাকবে ২০৪০ সাল পর্যন্ত।
কেন জরিপ, কিভাবে জরিপ, শিরোনামে পত্রিকাটি আরো বলেছে, তরুণ অংশের চিন্তাভাবনা জীবন যাপন ভবিষ্যতের লক্ষ্য জানা বাংলাদেশের উন্নয়নের খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তরুণদের এই মনোভাব জানতে পত্রিকাটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ওআরজি কোয়েস্টের মাধ্যমে দ্বিতীয়বারের মতো একটি দীর্ঘমেয়াদী জরিপ চালায়। জরিপের ফল জানিয়ে পত্রিকাটি লিখেছে, প্রতি পাঁচ তরুণের চারজনই জীবনের লক্ষ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন। ওই প্রতিবেদনে জরিপের তথ্যকে বিশ্লেষণ করে উপস্থাপন করা হয়েছে। কেন তরুণদের এমন অবস্থা। সে ব্যাপারে তারা বিশেষজ্ঞ মতামত চেয়েছেন। প্রতিবেদকের ভাষ্য মতে, বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন এ দুরবস্থার কারণ তাদের সামনে এমন কোনো রোল মডেল নেই। যাদের অনুসরণ করে নিজেদের সমৃদ্ধ করা যায়। বিশেষজ্ঞরা এমন এক সময় রোল মডেলের অভাবের কথা বললেন, যখন সমাজে অসংখ্য জ্ঞানী, কর্তব্যসচেতন মানুষকে দেখা যাচ্ছে। এছাড়া মিডিয়ার কল্যাণে তারা জানতে পারছেন চলমান সময়ে আর কারা বাইরের বিশ্বে রয়েছেন। যাদের অনুসরণ করা যায়, নিকট অতীতের গ্রেট পারসনালিটিজ যারা এমন কি দূর অতীতের গ্রেট পারসোনালিটিজদেরও জানার সুযোগ এখন হচ্ছে। তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে তরুণদের সামনে রোল মডেলরা সদ্য উপস্থিত রয়েছেন। রোল মডেল প্রসঙ্গটি আমরা আরো একটু জেনে নিতে পারি। রোল মডেল নামে কিছু কোনো ভাষার ইতিহাসে পৃথিবীতে আগে হয়তো ছিল না। কিন্তু এ দ্বারা যে ভাব বা বাস্তবতা বোঝায়, এর আবহ পৃথিবীতে সব সময় বিদ্যমান ছিল। মার্কিন সমাজতাত্তি¡ক রবার্ট কিং মারটন রোল মডেল ধারণার উদ্ভাবক। ১৯১০ সালে তার জন্ম। তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন সমাজতত্ত¡কে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দেয়ার জন্য ১৯৯৪ সালে ন্যাশনাল মেডাল অব সায়েন্স পদক পান। ২০০৩ সালে তার মৃত্যু হয়।
রোল মডেল কথাটি চালু হয় ১৯৫০-এর দশকের পরে। তবে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এটি আমেরিকান শব্দকোষে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি এটি প্রতিদিনকার ব্যবহারে আসে। এই ধরুন, একজন ফজলে হোসেন আবেদ বা নোবেল লরিয়েট ডক্টর ইউনূস হয়ে উঠতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। রোল মডেল প্রসঙ্গটি আমরা নিজেরা যাচাই করে দেখতে পারি। আমাদের সংকট কোথায়, সেটি বোঝার চেষ্টা করতে পারি।
বাংলাদেশের তরুণদের সামনে এখন এমন অনেকে রয়েছেন। যাদের তারা অনুসরণ করতে পারেন। তাদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব যাদের কেউ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছেন। কারো কারো গন্ডি দেশের সীমানা পেরিয়েছে। আগেই বলেছি, আমাদের দেশেই রয়েছেন নোবেল বিজয়ী। রয়েছেন ব্রিটেনের নাইটহুড সম্মান পাওয়া ব্যক্তিত্ব। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে একটু ডাকাতে পারি। এ বিশ্ববিদ্যালয়কে এক সময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো। এখন অবশ্য আর কেউ একে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলেন না। তবে এর ছাত্র-শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এমন সব অভিযোগ আসছে; তা সাধারণের হজম করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটছে তা খুবই লজ্জাজনক। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্নমত পোষণের জন্য প্রতিবাদকারীদের নির্মমভাবে পেটানো হয়েছে। ডাকসুর ভিপি নুরুল হকের ওপর বর্বর হামলা চালানো হয়েছে। এর আগেও তার ওপর ৯ বার হামলা করা হয়েছে। ওই সব হামলার কোনোটির বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এখানে বিভিন্ন পক্ষের সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি প্রথম আলোকে দেয়া মন্তব্যে এক পক্ষের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন অপরপক্ষের পৃষ্ঠপোষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আ ক ম জামালউদ্দিন সম্পর্কে বলেছেন।, তিনি শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। অন্যদিকে ওই শিক্ষক এই সাধারণ সম্পাদক সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘আমিনুল-মামুনরা ছাত্র সমাজের কলঙ্ক। আর নিজের সংগঠনের ব্যাপারে এই শিক্ষক বলেন, এটি একটি ‘অ্যাকশন অর্গানাইজেশন’ তার বক্তব্যের সাথে সংগঠনটির কর্মকাণ্ডের দারুণ মিল রয়েছে। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকদের মধ্যে কয়েক দশক ধরে কেবল অধঃগমন দৃশ্যমান। ব্যতিক্রম যা আছে তা অপকাণ্ডের আড়ালে সব ঢাকা পড়ছে। সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদালয়কে অনুসরণীয় মনে করা হয়। দেশের বেশির ভাগ ছাত্র এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করতে চায়। সেই প্রতিষ্ঠানকে আমরা টেনে নিয়ে গেছি খাদের কিনারে। এ জন্য ছাত্র শিক্ষক একাই দায়ী নয়। এর সাথে দেশের বৃহত্তর রাজনীতির সংযোগ রয়েছে।
মার্কিন সমাজতাত্তি¡ক রবার্ট কিং মারটনের রোল মডেল ধারণার আমাদের দেশের বাস্তবতা কী? সেখানে অনেকে বলছেন রোল মডেল নেই। তারা কাউকে অনুসরণ করার মতো পাচ্ছেন না। বাস্তবে আমাদের সমাজে এমন অনেকে আছে, যারা অনুসরণীয় হতে পারেন। কারণ আমাদের সমাজে থাকা এসব বিশিষ্ট ব্যক্তি কোটি কোটি মানুষের জাগতিক সংকটের সুরাহা দিয়েছেন। অর্থনৈতিক সামাজিক মুক্তি দিয়েছেন। বৈষয়িক জীবনকে আপাতত শান্ত সুস্থির করতে পেরেছেন। প্রকৃত ব্যাপারটি এমন, আমাদের তরুণদের রোল মডেলদের অনুসরণ করতে দেয়া হচ্ছে না। কৌশলে তাদের মুখ এমন দিকে ফিরিয়ে রাখা হয়েছে। যা জাগতিক জীবনে কোনো অভীষ্টে পৌঁছতে পথ দেখাবে না। নাকি আমাদের তরুণরা নিজেরাই সামনে কোনো রোল মডেল রাখতে চান না। সোজা কথায় তারা কী রোল মডেল বিমুখ। বিশেষ করে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এই মডেল সব সময় বিদ্যমান। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী অবতাররা এ রোল মডেল। ইহুদিরা ছোট একটি ধর্মীয় গোষ্ঠি হলেও ইবরাহিম ধারার প্রথম ধর্মীয় গোষ্ঠি হিসেবে নিজেদের দাবি করে। তারা আসমানি কিতাব তওরাতের দাবিদার। সেখানে আছে মুসা আ. এর কথা। এই কিংবদন্তি একজন অনুসরণীয় আদর্শ। তবে ইহুদিরা যদি তাদের অনুসরণ করতেন তাহলে ফিলিস্তিনিরা কোনোভাবে বাস্তুচ্যুত হতেন না নিজ গৃহ থেকে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সম্প্রদায় খ্রিস্টান। ২২০ কোটি মানুষ এ ধর্মের অনুসারী। তাদের কাছে রয়েছেন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব ঈসা আ. ইনজিলে তার চরিত্র নিখুঁতভাবে চিত্রিত আছে। তারা যদি ঈসা আ. তথা ইনজিলের অনুসারী হতেন। এই ধর্মের অনুসারী আমেরিকা ব্রিটেন নির্বিচারে বিশ্বের দেশে দেশে অনাচার করতে পারতেন না। মুসা আ. ও ঈসা আ. এর ধারাবাহিকতার মু (সা.)-এর আগমন। তার উপস্থাপনা কেমন ছিল তা অবিকৃত অবস্থায় আমাদের কাছে বিদ্যমান রয়েছে। আমরাই নিজেদের ‘মুসলিম’ দাবি করছি। নিজেদের মুহাম্মদ সা.-এর অনুসারী দাবি করছি। তা হলে আমাদের মধ্যেও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বোর অভাব নেই। তাদের অনুসরণ করতে যে যোগ্যতা দরকার সেটি অর্জন করতে পারছে না মানবতা। আমরা তরুণদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার বানাচ্ছি। অন্যদিকে, ধুরন্ধর রাষ্ট্রগুলো ভোগবিলাস ও চাহিদাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে অনুসরণীয় চরিত্রগুলো সামনে আসতে পারছে না।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট