তদন্ত কমিটির ২০ দফা সুপারিশ

22

বুড়িগঙ্গার নদীতে লঞ্চ দুর্ঘটনায় প্রাণহানির পেছনে নয়টি কারণ চিহ্নিত করে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে ২০ দফা সুপারিশ করেছে নৌ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। ঢাকা সদরঘাটের কাছে নৌযানের বার্থিং বন্ধ করা, খেয়াঘাট সরিয়ে নেওয়া, ভয়েজ ডিক্লারেশন বাধ্যতামূলক করা, নৌযানের গতি সীমা নির্ধারণ, পুরনো ধাঁচের লঞ্চ তুলে দেওয়া, লঞ্চে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত টিকেট বিক্রি বন্ধ করা এবং শাস্তি বাড়িয়ে নৌ আইন যুগোপযোগী করার সুপারিশ রয়েছে সেখানে।
তবে ময়ূর-২ লঞ্চের ধাক্কায় এমএল মর্নিং সান বুড়িগঙ্গায় ডুবে যাওয়ার ওই ঘটনা তদন্ত করে তদন্ত কমিটি কার কি দায় পেয়েছে, তা প্রকাশ করেননি নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। ওই প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘এরজন্য কে কে দায়ী তা এখন প্রকাশ করছি না। তবে তদন্ত কমিটি বিশটি সুপারিশ দিয়েছে’।
গত ২৯ জুন মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে যাত্রী নিয়ে সদরঘাটের দিকে আসছিল ছোট আকারের লঞ্চ এমএল মর্নিং বার্ড। শ্যামবাজারের কাছে বুড়িগঙ্গা নদীতে ময়ূর-২ নামের আরেকটি বড় লঞ্চের ধাক্কায় সেটি ডুবে যায়। দুই দিনের তল্লাশি অভিযানে মোট ৩৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
ওই ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) মো. রফিকুল ইসলাম খানকে আহŸায়ক এবং বিআইডবিøউটিএর পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা) মো. রফিকুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। এছাড়া ‘অবহেলাজনিত মৃত্যু’ ঘটানোর অভিযোগ এনে ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক, মাস্টারসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করে নৌ পুলিশ।
দুর্ঘটনার পর সদরঘাটের একটি সিসি ক্যামেরার ভিডিও দেখে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সেদিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ঘটনার যে ধরন, তাতে তার মনে হয়েছে এটা ‘পরিকল্পিত এবং হত্যাকাসবড।’
সেই প্রসঙ্গ টেনে সোমবারের সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে আমি বলেছিলাম এটি হত্যাকান্ড এবং এখনও দেখলে আবারও বলব হত্যাকষশবপসবড। যেহেতু অবহেলাজনিত কারণে দুর্ঘটনার অভিযোগ এনে একটি মামলা করা হয়েছে, তদন্তে যদি হত্যাকান্ড প্রমাণিত হয়, তাহলে সেটা অবশ্যই ৩০২ ধারায় (হত্যা মামলা) আসবে।
ভবিষ্যতে নৌ দুর্ঘটনা এড়াতে তদন্ত কমিটি যে ২০ দফা সুপারিশ করেছে, সংবাদ সম্মেলনে সেগুলো পড়ে শোনান নৌ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন। ব�. সদরঘাট থেকে ভাটিতে সাত থেকে আট কিলোমিটার এবং উজানে তিন থেকে চার কিলোমিটার অংশে বার্থিং উঠিয়ে দিতে হবে। ওই অংশে পন্টুন ছাড়া কোথাও নৌযান নোঙ্গর করে রাখা যাবে না। নদীর ওই অংশ থেকে পর্যায়ক্রমে শিপইয়ার্ড ও ডকইয়ার্ড উঠিয়ে দিতে হবে।
২. সদরঘাট টার্মিনালের আশপাশে কোনো খেয়াঘাট রাখা যাবে না। ওয়াইজঘাটের উজানে খেয়াঘাট স্থানান্তর করা যেতে পারে।
৩. লঞ্চের সামনে, পেছনে, মাস্টার ব্রিজে, ইঞ্জিন রুমে, ডেকে সিসিটিভি ক্যামেরা বসাতে হবে। মাস্টারের দেখার সুবিধার জন্য ব্যাক ক্যামেরার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া লঞ্চে পর্যায়ক্রমে ওয়াকি-টকি ব্যবহার চালু করতে হবে।
৪. লঞ্চ বা জাহাজ ঘাট ত্যাগ করার আগেই ভয়েজ ডিক্লারেশন দাখিল বাধ্যতামূলক করতে হবে। লঞ্চে কতজন যাত্রী বহন করা হচ্ছে, ডেক সাইডে এবং ইঞ্জিনে কারা কারা কর্মরত, তা ভয়েজ ডিক্লারেশনে উল্লেখ করতে হবে।
৫. ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চলাচল বন্ধ করতে হবে। প্রত্যেক লঞ্চে জীবন রক্ষাকারী লাইফ জ্যাকেট ও লাইফ বয় রাখতে হবে।
৬. সকল নদীপথে বিভিন্ন নৌযানের গতি সীমা নির্ধারণ করে দিতে হবে। ঢাকা সদরঘাটে নৌযানের গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য টাওয়ার স্থাপন ও সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে।
৭. লঞ্চে মেকানিকাল স্টিয়ারিংয়ের পরিবর্তে ইলেট্রো হাইড্রলিক স্টিয়ারিং প্রবর্তন করার উদ্যোগ নিতে হবে।
৮. যাত্রীবাহী লঞ্চে মেইন ইঞ্জিনে লোকাল কন্ট্রোল সিস্টেমের পরিবর্তে ব্রিজ কন্ট্রোল সিস্টেম চালুর ব্যবস্থা নিতে হবে পর্যায়ক্রমে।
৯. ‘সাংকেন ডেক’ লঞ্চ পর্যায়ক্রমে উঠিয়ে দিতে হবে। প্রশস্ত ও ব্যস্ত নদীতে এ ধরনের নৌযান চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রশস্ত ও ব্যস্ত নদীতে যথাযথ সনদধারী মাস্টার ও ড্রাইভার ছাড়া নৌযান পরিচালনা করা যাবে না। ডিসপেনসেশন সনদের প্রথা বাতিল করতে হবে।
১০. যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ করে শিশু, নারী, বয়স্ক যাত্রীদের ওঠা-নামার সুবিধার্থে গ্যাংওয়ে বা ব্রিজ স্থাপন করতে হবে নৌযানে।
১১. সদরঘাটে পন্টুনের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।
১২. সার্ভের সময় নৌযানের নিরাপত্তা সরঞ্জাম ও অন্যান্য বিষয় দেখার জন্য পরিদর্শন কার্যক্রম আরও জোরদার এবং নির্বাহী ম্যাজিস্টেট ও মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে।
১৩. লঞ্চে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত টিকেট বিক্রি বন্ধ করতে হবে। টিকেট দেখানো ছাড়া কোনো যাত্রীকে লঞ্চে উঠতে দেওয়া যাবে না। অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের সুযোগ বন্ধ করার জন্য কেবিন সংখ্যা ও ডেকের যাত্রীর সংখ্যা নির্ধারণ করে দিয়ে ও কল টিকেট অনলাইনে বিক্রির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
১৪. নৌ আইন অমান্যকারীদের শাস্তির মেয়াদ ও জরিমানার পরিমাণ সুযোপযোগী করে আইন সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
১৫. নৌ কর্মীদের প্রশিক্ষণ ফলপ্রসূ করার জন্য বিআইডবিøউটিএ কে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। নৌযানের ফিটনেস ও নৌকর্মীদের যোগ্যতা সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে নৌপরিবহন অধিদপ্তরকে আরও কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। সার্ভে সনদ প্রদানকারী সংস্থা নৌপরিবহন অধিদপ্তরে সার্ভেয়ারের সংখ্যা এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে।
১৬. ডেক অ্যান্ড ইঞ্জিন পারসোনেল ট্রেইনিং সেন্টারের সংখ্যা বাড়াতে হবে। দেশে বর্তমানে প্রায় ১৪ হাজার নিবন্ধিত জাহাজ ছাড়াও অনিবন্ধিত অসংখ্য জাহাজ রয়েছে। এসব জাহাজে গড়ে কমপক্ষে ২ জন মাস্টার ও ২ জন ইঞ্জিন চালক নিয়োগ করতে হলে প্রায় ৫৬ হাজার প্রশিক্ষিত জনবল দরকার। শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে জাহাজে নিয়োগ করতে পারলে দুর্ঘটনা কিছুটা কমতে পারে। এ ধরনের ট্রেইনিং সেন্টারের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি উপস্থিতি দৃশ্যমান করতে হবে।
১৭. নৌ দ্র্ঘুটনার কারণ উদঘাটনের জন্য দায়ী মাস্টার, ইঞ্জিন ড্রাইভারদের সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা নিতে হবে। নৌ দুর্ঘটনা ও নৌযান সংক্রান্ত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধ ও আসামি গ্রেপ্তারের জন্য সদরঘাটে নৌপুলিশের জনবল সংখ্যা ৯ জন থেকে বাড়িয়ে কমপক্ষে ২৫ জন করতে হবে।
১৮. নৌযান ও নৌকর্মীদের চলাচল ও অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার জন্য নৌযান ও নৌকর্মীদের ডেটাবেজ তৈরি এবং ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করার উদ্যোগ নিতে হবে।
১৯. নৌ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার আনুনিকায়ন করতে হবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরকে যথাযথ কারিগরি সুবিধা দিতে হবে। সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
২০. নৌ দুর্ঘটনা নিয়ে গবেষণার বিষয়ে একটি প্রতিষ্ঠান করা যেতে পারে।
তদন্ত কমিটি এ দুর্ঘটনার কারণ চিহ্নিত করে ৯টি মতামত দিয়েছে জানিয়ে সচিব মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন বলেন, ‘ময়ূর-২ লঞ্চের ধাক্কায় মর্নিং বার্ড ডুবে গেছে এটা নিশ্চিত। তবে যেহেতু এ ঘটনায় মামলা হয়েছে, তাই দায়ী কে তা তদন্ত করে বের করা হবে’। খবর বিডিনিউজের