ড. আনিসুজ্জামান নিভে গেল বাংলার জ্যোতিষ্ক নক্ষত্র

45

লায়ন ডা. বরুণ কুমার আচার্য

সব প্রতিভাবান মানুষই অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র। অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানও স্বতন্ত্র ছিলেন। তাঁর মতো গুণধর প্রতিভাবান ব্যক্তি দ্বিতীয় আরেকজনকে আমরা আর পাবো না। জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান ছিলেন দেশের জ্ঞান, মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও অসা¤প্রদায়িক চেতনার অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। এই বরেণ্য শিক্ষাবিদ ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রæয়ারি অবিভক্ত ভারতের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। দেশভাগের পর তাঁরা এখানে চলে আসেন। তাঁর পিতা এ টি এম মোয়াজ্জেম ছিলেন সুখ্যাত হোমিও চিকিৎসক। মা সৈয়দা খাতুন গৃহিণী হলেও তাঁর লেখালেখির হাত ছিল। পিতামহ শেখ আবদুর রহিম ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক। আনিসুজ্জামান ছিলেন পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ। সংসার জীবনে তিনি ছিলেন দুই কন্যা ও এক ছেলে সন্তানের জনক। তাঁর সহধর্মিণী সিদ্দিকা জামান। কলকাতার পার্ক সার্কাস হাইস্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন আনিসুজ্জামান। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই পড়েছেন। দেশভাগের পর তিনি খুলনা জিলা স্কুলে এবং তারপর ঢাকায় প্রিয়নাথ হাইস্কুলে (বর্তমানে নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) পড়েন। ১৯৫১ সালে প্রিয়নাথ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ¯œাতক এবং ১৯৫৭ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে ¯œাতকোত্তর লাভ করেন। পরে তিনি “ইংরেজি আমলে বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারা (১৭৫৭-১৯১৮)” শীর্ষক গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়াও ১৯৫৬ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইয়ং বেঙ্গল ও সমকাল” বিষয়ে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা দিয়ে ১৯৫৯ সালে। এরপর ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে গিয়ে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন “বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি”র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং যুদ্ধকালে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যুক্ত হন। মূলত ষাটের দশক থেকে তিনি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সক্রিয় ছিলেন এবং এদেশের সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের একজন আদি প্রবক্তাও ছিলেন। সংস্কৃতিকে তিনি গতিশীল চিন্তা ও সামাজিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখতেন। সেজন্য শিক্ষার সংস্কৃতি পুনরুদ্ধার ও প্রয়োগে তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ১৯৭২ সালের ড. কুদরত-এ-খুদাকে প্রধান করে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে তিনি কমনওয়েলথ একাডেমী স্ট্যাপ ফেলো হিসেবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফিুকান স্টাডিজে গবেষণা করেন এবং ১৯৮৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দেন। ড. আনিসুজ্জামান ২০০৩ সালে অবসর গ্রহণের পর সংখ্যাতিরিক্ত শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হন। ২০১৮ সালের ১৯ জুন সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেন। সর্বশেষ তিনি বাংলা একাডেমির সভাপতির দাযিত্ব পালন করছিলেন। এছাড়াও তিনি যুক্ত ছিলেন সাহিত্য পত্রিকা “কালি ও কলম” এর সঙ্গে। যদিও তাঁর পেশাগত জীবন কেটেছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায়, কিন্তু তাঁর অনুরাগীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গÐির মধ্যে সীমিত ছিল না। দেশের সীমানায় ভেতরে ও বাইরে নানান মহলে ছড়িয়ে আছে তাঁর অনুরাগীরা। আনিসুজ্জামানের উদারতা, রুচি, সংযম ও পরমতসহিষ্ণুতা বিচিত্র মত ও পথের মানুষকে তাঁর বন্ধু ও শুভার্থী করে তুলেছিলেন। তিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থে অজাতশত্রæ। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান নিজেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, গবেষণা আর পেশাগত জীবনের মধ্যেই নিজেকে সীমিত রাখেননি; একই মনোযোগ দিয়েছেন সমাজের আহŸানে, বায়ান্নার রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। স্বাধীনতার পর স্বৈরাচারবিরোধী গণ-আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সামনের কাতারে। তিনি সাক্ষ্য দিয়েছেন যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক আদালতে। অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান ছিলেন অমায়িক, সজ্জন ও বন্ধুবৎসল। খ্যাতি ও পান্ডিত্যের কোনো অহমিকা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি অনায়াসে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে মিশে যেতে পারতেন। জাতির যেকোনো সংকটে, সৃষ্টিশীল ও মননধর্মী উদ্যোগে, সাংস্কৃতিক আয়োজনে, এমনকি সুহৃদদের ঘরোয়া অনুষ্ঠানেও যাঁর উপস্থিতি ছিল প্রায়শই। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান দেশ-বিদেশের অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। তিনি ১৯৮৫ সালে একুশে পদক, ২০১৫ সালে স্বাধীনতা পদক, ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ পদকে ভূষিত করে। এছাড়াও তিনি দুবার আনন্দবাজার পত্রিকার আনন্দ পুরস্কার, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-লিট, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী পদকসহ দেশ-বিদেশে অনেক পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। বেশ কিছুদিন থেকে তিনি কিডনি, ফুসফুস, উচ্চ রক্তচাপসহ বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। অবশেষে ১৪ মে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকাল ৪টা ৫৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলা একাডেমির এক অনুষ্ঠানে তিনি তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, “বাংলার এ মাটিতে আমি জন্মগ্রহণ করিনি, তবে এ মাটিই যেন শেষ আশ্রয় হয় এ আমার প্রার্থনা।” তাঁর শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। তাঁর মরদেহ জাতীয় পতাকায় আবৃত করে গার্ড অব অনার প্রদানের পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আজিমপুর কবরস্থানে তাঁর বাবার কবরের পাশেই তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়েছে। বাংলার এই উজ্জ্বল নক্ষত্রের জীবনধারা আমাদের সামাজিক ও রাজনৈকি ইতিহাস রচনা করার জন্য একটি মূল্যবান অনুকরণ। ড. আনিসুজ্জামান যে শূন্যতা রেখে গেলেন তা যেন একজন মাত্র ব্যক্তির নয়। তাঁর জীবনকর্ম ও গবেষণার কাছে বাঙালি নিজের আত্ম-অনুসন্ধানের জন্য ফিরে আসবে। তাঁর মতো ব্যক্তিত্বকে হারিয়ে যে শূন্যতার সৃষ্টি হলো তা পূরণ হওয়ার নয়। জাতির প্রতিটি নাগরিকের মতো আমরাও শোকাহত তাঁর মৃত্যুতে। তাঁর স্মৃতি প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করছি। পরপারে ভালো থাকুন এই কামনা করছি।
তথ্যসূত্র: ইটারনেট ও সমসাময়িক পত্র-পত্রিকা।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও মরমী গবেষক