‘ডোর টু ডোর’ পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম অনিয়মে ভরা

142

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ১০ নং উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্ন সুপারভাইজার হারুনর রশীদ। তাকে সচিবালয়ের মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন সুপারভাইজার হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান করা হয়। যদিও পরিচ্ছন্ন সুপারভাইজার হওয়ার জন্য যোগ্যতা আবশ্যক এইচএসসি পাস।
তিনি সেবক পদের জন্য যে আবেদন করেছিলেন, সেখানে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ আছে অষ্টম শ্রেণি পাস। ১৯৯৯ সালে তিনি দাখিল পাস করেছেন মর্মে সনদ দাখিল করেন সিটি কর্পোরেশনের কাছে। কিন্তু ১৯৯৮ সালে তিনি নবম শ্রেণিতে পড়েন বলে লিখিতভাবে জানান রায়পুর ইউনিয়ন বহুমুখি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, ১৯৯৯ সালে কীভাবে তিনি দাখিল পাস করেন?
শুধু হারুনর রশীদ নন, এরকম আরও ‘গোঁজামিলে’ ভরপুর চসিকের ‘ডোর টু ডোর’ পরিচ্ছন্ন শ্রমিকদের ব্যক্তিগত নথি ও পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াতে। গত ১৮ অগাস্ট চসিকের সচিবালয় শাখার এক আদেশে পরিচ্ছন্ন বিভাগে ‘ডোর টু ডোর’ এ কর্মরত শ্রমিকদের যাচাই-বাছাই এর জন্য তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে ছিলেন সংস্থাটির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মুফিদুল আলম, অতিরিক্ত প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির চৌধুরী, উপ-প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মো. মোরশেদুল আলম চৌধুরী। গতকাল তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে এখনও তদন্ত প্রতিবেদন পাননি বলে জানিয়েছেন চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন এখনও পড়িনি। তাই মন্তব্য করছি না। কারো বিরুদ্ধে কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের আমলে ২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় দুটি শর্তে দুই হাজার দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে পরিচ্ছন্নকর্মী নিয়োগ দেওয়ার অনুমতি প্রদান করে। শর্ত দুইটি হল, নিয়োজিত শ্রমিকদের পরিচ্ছন্ন বিভাগের কাজ ভিন্ন অন্য কোন কাজে নিয়োজিত করা যাবে না এবং দৈনিক ভিত্তিতে কর্মরত সকল শ্রমিকের তথ্য ও অনুমোদনকৃত শ্রমিকের তথ্য নিয়োগ প্রদানের এক মাসের নির্দিষ্ট ছকানুসারে জমা দিতে হবে। কিন্তু দুইটি শর্তই মানেনি সিটি কর্পোরেশন।
দুই হাজার শ্রমিকের জায়গায় নিয়োগ দিয়েছে ২ হাজার ৬৫ জন এবং এখনও পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ে শ্রমিকদের তথ্য জমা দেয়নি সিটি কর্পোরেশন। এমনকি সংস্থাটির নিজের কাছেও নিয়োগকৃত শ্রমিকদের ছবিসহ পূর্ণাঙ্গ তালিকা নেই। তবে প্রতিমাসে দুই কোটি টাকারও বেশি বেতন গোণা হতো শুধুমাত্র শ্রমিকদের সংখ্যা উল্লেখ করেই। তাছাড়া মাসপ্রতি প্রদেয় বেতনের মোট টাকায়ও নেই সামাঞ্জস্য।
মাসের পর মাস পরিচ্ছন্ন কর্মীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যার বিপরীতে তদন্তদলকে কোন সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেনি পরিচ্ছন্ন বিভাগ। তবে সাবেক মেয়রের মৌখিক নির্দেশের কথা বলেই সব ধরনের অসচ্ছতার দায় সেরেছেন পরিচ্ছন্ন বিভাগের দায়িত্বশীলরা। এমনটাই জানা গেছে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে থেকে।
সরকারি সংস্থায় নিয়োগের ক্ষেত্রে যা নিয়ম রয়েছে তার কোনটাই মানা হয়নি ডোর টু ডোর পরিচ্ছন্নকর্মীদের নিয়োগের সময়। নিয়ম রক্ষার একটি বিজ্ঞাপন দিয়ে দায় সেরেছে সংস্থাটি। এমনকি বিজ্ঞাপনটিতে উল্লেখিত শর্তাবলী কোনটাই মানার প্রমাণ পায়নি তদন্ত কর্মকর্তারা।
তদন্ত দলটি সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে ১১টি সুপারিশ করেছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হল পরিচ্ছন্ন বিভাগের কোন শ্রমিক অন্যকোন বিভাগে নিয়োজিত থাকলে, তাকে অবিলম্বে প্রত্যাহার করে পরিচ্ছন্ন বিভাগে নিয়োজিত রাখা উচিত, জরুরি ভিত্তিতে মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত ফরমেটে শ্রমিকদের যাবতীয় তথ্যাদি সংরক্ষণ করতে হবে, পরিচ্ছন্ন বিভাগে পরীক্ষামূলকভাবে ৪/৫টি ওয়ার্ডে আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগ করা যায়। এতে সফল হলে পর্যায়ক্রমে বাকী ওয়ার্ডগুলোতে একই প্রক্রিয়ায় শ্রমিক নিয়োগ করা যায়, শ্রমিকদের সময়মত কাজে উপস্থিতি নিশ্চিতকরণে ডিজিটাল হাজিরা ব্যবস্থা চালু করতে হবে এবং একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর তাদের বদলীর ব্যবস্থা করতে হবে।
শ্রমিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাই করা দরকার। উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিকে সেবক হিসেবে নিয়োগ না করাই উত্তম, ‘ব্যবস্থা নিন’ এ দুটো অস্পষ্ট । এই দুটো শব্দের ভিত্তিতে কোন বিভাগ কর্তৃক কাউকে চাকরিতে নিয়োগ করা বা বদলি করা বা চাকরি থেকে অপসারণ করা হলে পুরো প্রশাসনের চেইন-অব-কমান্ড ভেঙে পড়বে। সচিবালয় শাখা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রশ্রয় পাবে।
এজন্য সকল কার্যক্রম নথিতে উপস্থাপন করে সচিবালয় শাখার মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে, অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগ জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করা উচিত। কোনভাবেই পরিচ্ছন্ন বিভাগ কর্তৃক যাতে আর শ্রমিক নিয়োগ করা না হয়, এ মর্মে একটি প্রশাসনিক আদেশ জারি করা দরকার এবং পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াকে যাচাই-বাছাই করে পুনর্বিন্যাস করে মন্ত্রণালয়ের অনুশাসন মোতাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বরাবরে একটি প্রতিবেদন প্রেরণ করা উচিত বলে মনে করছে তদন্ত দল।
বিষয়গুলো নিয়ে তদন্ত কমিটির উপ-প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মো. মোরশেদুল আলম চৌধুরী কোন অনিয়ম পাওয়া যায়নি বলে জানান। তদন্ত কমিটি যেসব কাগজপত্র চেয়েছে সব দিয়েছি। সাবেক মেয়রের নির্দেশনা অনুসারে সব হয়েছে। এখানে কোন অনিয়ম হয়নি বলে জানান এই কর্মকর্তা।