ডেঙ্গু নিয়ে লুকোছাপার কিছু নেই বললেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী

39

ডেঙ্গু নিয়ে ‘লুকোছাপার’ কিছু নেই মন্তব্য করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, কী ঘটছে তা জানাতে হবে যাতে সবাই সচেতন হতে পারে। কাউকে দোষারোপ না করে এই সংকট মোকাবেলায় কাজ করাকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। প্রাণঘাতী রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপের মধ্যে পরিবার নিয়ে বিদেশ সফরে যাওয়াসহ বিভিন্ন মন্তব্যের জন্য সমালোচনার মুখে পড়া স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, তারা ডেঙ্গু নিয়ে কিছু এড়িয়ে যেতে চাইছেন না, লুকানোর চেষ্টা করাও উচিত নয়। কার্পেটের তলে ময়লা লুকানো উচিত হবে না। কী ঘটছে, তা আমাদের জানাতে হবে যাতে সবাই সচেতন হতে পারে। খবর বিডিনিউজের
গত বছরের এই সময়ের তুলনায় হাসপাতালগুলোতে যখন তিনগুণ রোগী ভর্তি হচ্ছে তখন ঠিকমতো চিকিৎসা হচ্ছে কি না সে বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে জাহিদ মালেক প্রশ্ন করেছেন, ‘কীভাবে সবকিছু এত ভালোভাবে চলছে? নিশ্চয়ই কেউ নির্দেশনা দিচ্ছেন, কেউ তত্ত¡াবধান করছেন, কেউ একজন কাজ করছেন। এ বিষয়ে আপনাকে ভাবতে হবে।’
নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণ আমাদের কাজ নয়। এ বছর এডিস মশার বংশবিস্তার আগের তুলনায় ১২ গুণ হচ্ছে। আমাদের দায়িত্ব রোগীকে যথাযথ চিকিৎসা সেবা দেওয়া এবং আমরা তা দিয়ে যাচ্ছি। কোনো হাসপাতাল ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় গাফিলতি করেছে এমন কোনো একটি উদাহরণ আপনি আমাকে দিতে পারবেন? আমাদের সব হাসপাতালেই ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি রোগী। তারপরেও এই সঙ্কটে তারা অতিরিক্ত হাজার হাজার রোগীকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের চিকিৎসক, নার্স ও হাসপাতাল স্টাফরা কাজ করছে। কেউ ছুটি পাচ্ছে না।’
জুনের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় ডেঙ্গু দেখা দেওয়ার পর থেকেই জ্বর হলে এর টেস্টের জন্য হাসপাতালে ভিড় শুরু হলে বাড়তে থাকে কিটের দাম। পরে সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগের পরীক্ষা বিনামূল্যে করানোর ঘোষণার পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালেও পরীক্ষার ফি বেঁধে দেয় সরকার।
ডেঙ্গু শনাক্তে ঢাকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রক্তের এনএস১, সিবিসি, আইজিজি ও আইজিএম পরীক্ষাগুলো করাতে প্রতিটির জন্য এক থেকে দেড় হাজার টাকা লাগছিল। সরকারি এই সিদ্ধান্তের ফলে সেই খরচ অর্ধেকের নিচে নেমে আসে।
বর্তমানে কিট সঙ্কট নেই জানিয়ে জাহিদ মালেক বলেন, ‘ডেঙ্গু পরীক্ষা কিট থেকে শুরু করে আইভি স্যালাইন সবকিছুই ব্যবস্থা আমরা করেছি। এমনকি সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষা ফ্রি এবং বেসরকারি হাসপাতালে খরচ ৫০০ টাকা বেঁধে দিয়েছি। ইতোমধ্যে আমরা আট লাখ ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট আমদানি করেছি। সারা দেশে এই কিট সরবরাহ করার পরও অতিরিক্ত দুই লাখ কিট মজুদ রয়েছে। প্রতিদিন আরও কিট আসছে।’
ডেঙ্গু নিয়ে তার কিছু বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে ‘ভুলভাবে’ এসেছে বলেও দাবি করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘যখন আমি বলেছি (পরিস্থিতি) নিয়ন্ত্রণে আছে, আমি বুঝিয়েছি ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিয়ন্ত্রণে আছে। আমি এটা বোঝাতে চাইনি যে, মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। এটা বলার আমি কে? এটা তো সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব। আমি তা কীভাবে বলব? আমি বলেছি, চিকিৎসা সেবা নিয়ন্ত্রণে আছে।’
ডেঙ্গুর ভয়াবহতা যখন বাড়ছে, তখন সপরিবারে মালয়েশিয়া চলে গিয়েছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। পরে সমালোচনার মুখে সফর সংক্ষিপ্ত করেই দেশে ফিরতে হয় তাকে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিদেশ সফরে গিয়ে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন’ বলে অভিযোগ আসে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও বিএনপির পক্ষ থেকে। বিএনপি নেতারা তার পদত্যাগের দাবিও তুলেছিলেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও ডেঙ্গু মোকাবেলায় সমন্বয়হীনতার কথা বলেছিলেন। জাহিদ মালেক বলছেন, ‘মাত্র দুই দিন’ দেশের বাইরে ছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি ছাড়া কোনো মন্ত্রীই দেশের বাইরে যেতে পারেন না। অনেক ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে এবং তার জন্য কাউকে বাইরেও যেতে হতে পারে। কিন্তু আপনি যদি মনে করেন, আমার শারীরিক উপস্থিতি ছাড়া মন্ত্রণালয় স্থবির হয়ে যাবে তখন এটা একটা অপরাধ। তাহলে তো আপনি ডিজিটাল বাংলাদেশের অবমূল্যায়ন করছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপকভাবে ডিজিটাইজেশন হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘এখন আমি ঢাকায় আপনার সঙ্গে কথা বলছি। কক্সবাজারের অবস্থা কীভাবে জানব? কিন্তু আপনাকে আমি তা বলতে পারব। আমাদের সেই ব্যবস্থা আছে।’
সারা দেশের সব হাসপাতালে চিকিৎসকরা যথাসময়ে উপস্থিত হচ্ছেন কি না, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে নজরদারি করতে পারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ওই দুই দিন আমার জন্য কোনো কিছুই থেমে থাকেনি। সব কিছু ভালোভাবেই হয়েছে।’
সমালোচকদের উদ্দেশে জাহিদ মালেক বলেন, ‘যদি সাহায্য করতে না পারেন, তাহলে ক্ষতি করবেন না। বরং লোকজনের জন্য ভালো হবে যদি আপনি ধরিয়ে দেন কোথায় রোগীরা সেবা পাচ্ছে না। আপনি বলুন, কোথায় সমস্যা। আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেব।’
ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামালে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে জাহিদ মালেক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী লন্ডন থেকে সব সময়ই যোগাযোগ করেছেন। তিনি আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। বিনা খরচে চিকিৎসার নির্দেশনা তিনিই দিয়েছিলেন। বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষা খরচ নির্দিষ্ট করে দেওয়া তার পরামর্শেই। আমরা তার নির্দেশ মতোই কাজ করেছি।’
ঈদের ছুটি শুরু হওয়ায় ঘরমুখো মানুষের ঢাকার বাইরে যাওয়ার এই সময় সারা দেশে ডেঙ্গু রোগী আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর পরীক্ষা ও চিকিৎসার জন্য প্রতিটি জেলা হাসপাতালে ১০ লাখ টাকা এবং উপজেলা হাসপাতালে দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়াও দুই হাজার চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা পাওয়ার কথা জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘প্রশিক্ষিত ডাক্তারদের জেলা ও উপজেলায় পাঠানো হয়েছে। কোনো সমস্যা হলে তারা সরাসরি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন। আমরা এমনকি ঈদের দিনেও কাজ করছি।’
মন্ত্রী বলেন, ডেঙ্গু রোগী বেড়ে গেলে যাতে সামাল দেওয়া যায় সেজন্য ঢাকায় চারটি সরকারি হাসপাতালকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। এগুলো হল- শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ পঙ্গু হাসপাতালের নতুন ভবন এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। দেশের সব উপজেলা হাসপাতালে আলাদা ‘ডেঙ্গু কর্নার’ চালু করার নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি এরমধ্যে কিছু জেলা হাসপাতাল পরিদর্শনও করে এসেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
সরেজমিনে দেখে এসে তিনি বলেন, এখানকার ৯০ শতাংশ রোগীই ঢাকা ফেরত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, বছরের শুরু থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ৩৬ হাজার ৬৬৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন। এখন সারা দেশে মোট ৮ হাজার ৭৬৩ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এর মধ্যে ঢাকার ৪১টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ৫ হাজার ৪৬ জন। বাকি জেলাগুলোর বিভিন্ন হাসপাতালে মোট ৩ হাজার ৬৮৭ জন।
ডেঙ্গুর কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা না থাকলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, দ্রæত রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা শুরু করা গেলে এতে প্রাণহানির হার কমে ১ শতাংশের নিচে নেমে আসে।
ডেঙ্গু নিয়ে চলমান সঙ্কটের মধ্যে ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা নিয়েও বিভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে। সরকারি ভাষ্যে এ বছর ডেঙ্গুতে ২৯ জনের মৃত্যুর কথা বলা হলেও অন্তত ১০৬ জনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছে বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে হাসপাতালগুলোতে যে সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে, তার তুলনায় মৃতের সংখ্যা শূন্য দশমিক ৫ শতাংশের কাছাকাছি। আক্রান্ত রোগীর তুলনায় মৃতের সংখ্যা কম হলেও মন্ত্রীর ভাষ্য, একটি মৃত্যুও কাম্য নয়। অনেক রোগী দেরিতে হাসপাতালে আসার কারণে মারা গেছেন। যারা শুরুতেই হাসপাতালে এসেছেন এবং ডাক্তারের নির্দেশনা অনুসরণ করেছেন, তারা সুস্থ হয়ে ফিরেছেন।
ডেঙ্গু বিষয়ক পরামর্শ পেতে মন্ত্রণালয় থেকে ‘১৬২৬৩’ হটলাইন নম্বর চালু করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এডিস মশার বিস্তার রোধে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসা নির্ভর করে। তাই জনগণকে ডেঙ্গু নিয়ে সচেতনতার পাশাপাশি মশারি টাঙিয়ে ঘুমানোসহ মশা থেকে নিজেদের সুরক্ষায় ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ কীটতত্ত¡বিদ বি এন নাগপাল এডিসকে একটি ‘স্মার্ট মশা’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন, এ মশা দেয়ালে বসে না, টেবিল, বিছানা, সোফা, পর্দা ও ঝুলন্ত কাপড়ের নিচে অন্ধকারে লুকিয়ে থাকে। ডেঙ্গুর সব প্রজননস্থল ধ্বংস করার পরামর্শ দেন তিনি।