ডিসির আপত্তি সত্ত্বেও ভিজিল্যান্স টিমে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী!

55

চলমান জেএসসি পরীক্ষা তদারকি করতে মোট ৫০ সদস্যের ১০টি ‘ভিজিল্যান্স টিম’ গঠন করেছে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড। টিমের সদস্যদের প্রায় অর্ধেকই শিক্ষাবোর্ডের সাংগঠনিক কাঠামো অনুসারে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। তাছাড়া এসব কর্মচারীর বেশিরভাগই সিবিএ রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত ও বিভিন্ন অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্ত। পরিদর্শক দলে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী রাখা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন খোদ জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন। এমনকি জেলা প্রশাসকের অনুরোধ অগ্রাহ্য করে প্রথম দিনের জেএসসি পরীক্ষা পরিদর্শনে ছিলেন এসব কর্মচারী। বিষয়টি মর্যদাহানিকর বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষক নেতারা।
তারপরও পরিদর্শক দলে তাদের রাখা নিয়ে অনড় চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর শাহেদা ইসলাম। এছাড়াও এসব কর্মচারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা বলে দাবি করেছেন তিনি।
উল্লেখ্য, মন্ত্রণালয়ের কোনো নির্দেশনা না থাকলেও আন্তঃশিক্ষাবোর্ডের সিদ্ধান্তের বলে এই পরিদর্শক দল গঠন করে শিক্ষাবোর্ড। প্রতিজন পরিদর্শক পান ৭শ টাকা সম্মানি। প্রতি ‘পাবলিক’ পরীক্ষায় প্রায় ৩ লাখ টাকা খরচ করা হয়। একেতো মন্ত্রণালয়ের সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই, তার উপর জেলা প্রশাসন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা সুষ্ঠু পরীক্ষা পরিচালনা তদারকি করেন। তাহলে প্রতিবছর তিনটি পাবলিক পরীক্ষায় প্রায় ৯ লাখ টাকা কেন তছরূপ করা হবে ?
এমন প্রশ্ন তুলেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। অভিযোগ রয়েছে, প্রথম দিকে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের নিয়ে ছোট পরিসরে পরিদর্শক দল গঠন করা হলেও সিবিএ নেতাদের চাওয়াকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ক্রমেই বড় হয়েছে এই পরিদর্শক দলের পরিধি।
গতকাল শনিবার থেকে শুরু হওয়া জেএসসি পরীক্ষা সফল করতে ১০টি ‘পরিদর্শক দল’ গঠন করেছে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড। প্রতি দলে রয়েছেন ৫ জন সদস্য। প্রায় প্রতিটি দলে একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা, দুইজন দ্বিতীয় শ্রেণি ও দুইজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী রয়েছেন। এসব পরিদর্শক প্রশাসনকে সাথে নিয়ে সুষ্ঠু পরীক্ষা পরিচালনার তদারকি করেন। গত ২২ অক্টোবর চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের এক অফিস আদেশে দেখা যায়, গঠিত ১০টি টিমের ২০ জনই তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। তাদের অনেকে আবার সিবিএ রাজনীতির সাথে জড়িত। অভিযোগ রয়েছে, এসব প্রভাবশালী তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী শিক্ষকদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করেন। টাকা ছাড়া কোনো ফাইল নড়াচড়া করতে দেন না। এমনকি তাদের কাছে অসহায় ভূমিকা পালন করতে হয় শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তাদেরও! শিক্ষাবোর্ডের পরিদর্শক দলের সদস্য হয়ে কেন্দ্রে গিয়ে শিক্ষকদের সামনে ‘শো অফ’ করবে। তারপর শিক্ষাবোর্ডে আসলে খবরদারি করে চাঁদাবাজি করবে। এটাই তাদের মূল কৌশল।
এদিকে পরিদর্শক দলে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (ফেডারেশন) চট্টগ্রাম জেলার যুগ্ম সম্পাদক নুর মোহাম্মদ। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, আমরা যখন শিক্ষাবোর্ডে প্রতিষ্ঠানের কাজে যাই, তখন এসব সেকশন অফিসারদের টেবিলে পাওয়া যায়। তাদের সাথে কথা বলা দায় হয়ে উঠে। বরঞ্চ মাঝে মাঝে মনে হয় কর্মকর্তারা তাদের কাছে জিম্মি। এখন তারাই পরিদর্শক দলে । বিষয়টি রীতিমত আমাদের জন্য মর্যদাহানিকর। এমন সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহŸান জানান তিনি। এছাড়াও বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি (বাকসিস) চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের চৌধুরী বলেন, শিক্ষকরা বেঁচে আছেন মর্যদা নিয়ে। এখন যদি সেটা নিয়েও টানাটানি করা হয়, তাহলে তারা যাবে কোথায়? বিতর্কিতদের নিয়ে কেন এমন পরিদর্শক দল করা হবে? শিক্ষাবোর্ড যদি শিক্ষকদের প্রতি আস্থা হারায়, তাহলে কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হয়ে যাবে। যারা অফিসে ক্লার্কের কাজ করেন, তারা কিভাবে পরীক্ষা পরিদর্শন করবেন? এমন প্রশ্নই জুড়ে দেন এই শিক্ষক নেতা।
অফিস আদেশ সূত্রে জানা গেছে, জেএসসি পরীক্ষা পরিদর্শক দলে থাকা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা হলেন, সেকশন অফিসার জসিম উদ্দিন, আতিকুর রহমান, ইমাম হোসেন পাটোওয়ারী, কুতুব উদ্দিন নুরী, ফারজানা আফরোজ, মোহাম্মদ লোকমান হোসেন, বিমল কান্তি চাকমা, মো. জাহাঙ্গীর, রিপন বড়–য়া, সোমা দাশ, সরোয়ার কায়সার, সেলিম উল্লাহ আজাদ, আবু তাহের নিজামী, জামশেদুল আলম, মোহাম্মদ হাছান, স্টেনোগ্রাফার মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, অডিটর মো. লোকমান হোসেন, মো. ইমাম হোসেন, হিসাব রক্ষক মো. মশিউর রহমান ও গাজী আবদুল কাইয়ুম।
চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের অর্গানোগ্রাম অনুসারে দ্বিতীয় শ্রেণিতে রয়েছেন, সহকারী সচিব ৪ জন, সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ৫ জন, সহকারী কলেজ পরিদর্শক ২ জন, সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক ৪ জন, সহকারী হিসাব রক্ষণ অফিসার ২ জন, নিরাপত্তা অফিসার ১ জন, সহকারী ক্রীডা অফিসার ১ জন, সহকারী প্রকৌশলী ১ জন, সহকারী গ্রন্থাগারিক ১ জন, গণসংযোগ অফিসার ১ জন, সহকারী মূল্যায়ন অফিসার ১ জন, একান্ত সচিব ১ জন, কম্পিউটার অপারেটর ২ জন সহ মোটি ২৬টি পদ। এছাড়াও তৃতীয় শ্রেণির পদ রয়েছে ২২০টি। যার মধ্যে সেকশন অফিসার, হিসাব রক্ষক, অডিটর ও স্টেনোগ্রাফার রয়েছে।
তবে তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা দাবি করে শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর শাহেদা ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, দেশের সকল শিক্ষাবোর্ড এমন ভিজিল্যান্স টিম করে। আমরাও একইভাবে করেছি। তিনি উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, আপনারা না জেনে কেনো প্রশ্ন করেন? আমি এসব না জেনে তো বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিব না।
বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন বলেন, প্রথমত ভিজিল্যান্স টিম গঠনে মন্ত্রণালয়ের কোনো এখতিয়ার নেই। শিক্ষাবোর্ডের আন্তঃশিক্ষাবোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুসারে এই টিম গঠন করা হয়। তবে সেখানে তৃতীয় ও দ্বিতীয় শ্রেণির কাউকে না রাখার জন্য শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করেছিলাম। তারপরও তিনি শনিবারের প্রথম পরীক্ষায় সবাইকে পাঠিয়েছেন। বিষয়টি আমরা মন্ত্রণালয়ে জানাবো।