ডিপফেক

53

চিন্তা করুন তো। অন্যান্য দিনগুলোর মতোই স্বাভাবিকভাবে আপনার দিন চলছিল। হঠাৎ একদিন কাছের একজন মানুষ ইন্টারনেটে আপনাকে একটি ভিডিও পাঠায়। যেখানে আপনাকে দেখা যাচ্ছে আপনি কাউকে উদ্দেশ্য করে খারাপ গালি-গালাজ করছেন। ভিডিওটি দেখার পর তো আপনার মাথায় রীতিমতো আকাশ ভেঙে পড়ল আপনি নিশ্চিত যে আপনি কখনই এ ধরনের ভিডিও রেকর্ড করেননি এবং এ ধরনের খারাপ কথাও বলেননি কিন্তু ভিডিওর মানুষটি দেখতে অবিকল আপনার মতো। চোখ, নাক, হাসি, গলার স্বর হুবহু এক। আপনি নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছেন না এখন মানুষকে কীভাবে বিশ্বাস করাবেন? আপনার আপনজনেরাই বা কীভাবে নেবে এটি? ইন্টারনেটের মাধ্যমে এই ভিডিও চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। যাকে উদ্দেশ্য করে আপনাকে গালি-গালাজ করতে দেখা গেছে তিনি বড় মাপের একজন। এখন আপনার নিরাপত্তা হুমকির মুখে। সাইবার আইনে মামলাও হতে পারে। পরিবার ও সমাজে আপনি মুখ দেখাতে পারছেন না অথচ এখানে আপনার কোনো দোষই নেই। আপনার সাথে যে ব্যাপারটি ঘটেছিল সেটিকে প্রযুক্তির ভাষায় বলা হয় ডিপফেক।
আমরা জানি স্থির ছবিতে সফটওয়্যারের মাধ্যমে কারসাজি করে একজনের চেহারা পরিবর্তন করে অন্যজনের চেহারা মিলিয়ে দেয়া যায় কিন্তু ভিডিওতে সেটি মোটামুটি অসম্ভব ছিল। বর্তমানে মেশিন লার্নিং প্রযুক্তির কথা হয়ত আপনারা শুনে থাকেবেন। এই মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি ব্যবহার করেই আসলে ডিপফেক বানানো হয়ে থাকে। এখন সবার মনে যে প্রশ্নগুলো ঘুরছে সেগুলো হলো ডিপফেক নামের কারণ কী আর কীভাবেই এটি কাজ করে।
প্রথমেই বলি ডিপফেক বলতে নকল ভিডিও বা অডিওকে বোঝায় যা আপাতদৃষ্টিতে দেখতে আসল মনে হলেও তা মোটেও আসল নয়। ডিপফেক নামটির মাঝেই এর সংজ্ঞা যুক্ত রয়েছে। ডিপ মানে গভীর এবং ফেক মানে নকল অর্থাৎ ডিপফেক বলতে এমন কিছুকে বোঝায় যা খুবই গভীরভাবে নকল করা হয়েছে। মেশিন লার্নিং হলো ডিপফেক ভিডিও বানানোর মূল হাতিয়ার কিন্তু আমি যে বারবার মেশিন লার্নিং বলছি আসলে কী সেটা? আপনারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স সম্পর্কে জেনে থাকবেন। সোফিয়া নামের রোবটটিকে নিশ্চয়ই সবাই দেখেছেন। মানুষের মতো সে আচরণ করে। তাকে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হলে সে তার উত্তর দিতে পারে। কোন প্রশ্নের উত্তরে মুখের ভঙ্গিমা কী রকম হবে অর্থাৎ হেসে উত্তর দিতে হবে না রাগ করে সেটি সে জানে। এই যে সে নিজে থেকে একাই এই কাজটি করে সেটিই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আর তাকে এটি করার জন্য প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে এমন একটা অ্যালগরিদম করে দেয়া হয় যাতে সে নিজেই পরিবেশ এবং পূর্বের ঘটনা থেকে শিখতে পারে আর এটাকেই বলা হয় মেশিন লার্নিং।
মেশিন লার্নিংয়ের একটি কৌশলের নাম ‘জেনারেল অ্যাডভারসেরিয়াল নেটওয়ার্ক’ (এঅঘ)। এর মাধ্যমে প্রথমে একজন ব্যক্তির বিভিন্ন অভিব্যক্তির হাজারখানেক ছবি সংগ্রহ করা হয়। এরপর সেই ছবিগুলো মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে প্রক্রিয়া করে তার মুখের সব ধরনের অভিব্যক্তির একটি সিমুলেশন তৈরি করা যায় এবং সফটওয়্যার ব্যবহার করে ভিডিও বানানো হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নতির ফলে কারো গলার আওয়াজও হুবহু নকল করা সম্ভব। আমাদের দৃষ্টিসীমার পর্যায়কাল ০.১ সেকেন্ড অর্থাৎ ১০০ মিলি সেকেন্ডের কম সময়ে ঘটে যাওয়া কোনো দৃশ্য আমাদের চোখে ধরা পড়বে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি করা ভিডিওগুলোতে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটে এর থেকেও কম সময়ে। তাই খালি চোখে আসল-নকলের যাচাই করা সম্ভব হয় না। এসব ভিডিও ও অডিও নানাভাবে প্রক্রিয়া করে এমন একটি নকল ভিডিও তৈরি করা হয় যা শনাক্ত করা অনেক কঠিন। বর্তমানে সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যেকোনো কিছু ভাইরাল হতে সময় লাগে না, সত্যি-মিথ্যা প্রমাণ করার সময় পর্যন্ত পাওয়া যায় না। তাই এর মাধ্যমে গুজব ছড়ানোর আশঙ্কা বেশি।
২০১৮ সালের মে মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যায় তিনি বেলজিয়ামের নাগরিকদের সেই দেশের জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যু নিয়ে খুবই খারাপ ভাষায় কথা বলছেন। বেলজিয়ামের জনগণ মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন আচরণের তীব্র প্রতিবাদ করেন। তারা টুইটারে প্রেসিডেন্ট ও আমেরিকার বিপক্ষে কথা বলতে থাকে। এভাবে এক অশান্ত ও বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পরে অবশ্য জানতে পারা যায় যে এটি একটি বেলজিয়ান রাজনৈতিক দলের কাজ। তারা একটি প্রোডাকশন স্টুডিওর সাহায্য নিয়ে এই নকল ভিডিও তৈরি করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করা যাতে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে বেলজিয়ান সরকার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়। ডিপফেকের মাধ্যমে সবচেয়ে হুমকির মুখে রয়েছেন সেলিব্রেটি ও রাজনীতিবিদগণ। ব্যক্তিকে হেয় করতে পর্নোগ্রাফিতেও ডিপফেকের ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি ভবিষ্যতে খুবই ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে কারণ মেশিন লার্নিং প্রযুক্তির যত উন্নতি হবে সাইবার ক্রিমিনালরাও তত আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে ডিপফেকের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে পারবে। তবে সুখবর এটা যে ফেসবুক ও বিভিন্ন কোম্পানি ডিপফেক ভিডিও শনাক্তকরণের ব্যাপারে কাজ করছে। আশা করি খুব শীঘ্রই আসল ও নকল ভিডিও শনাক্তকরণ সফটওয়্যার আসবে। তাই কোনো কিছু দেখলেই সত্যি-মিথ্যা যাচাই না করে গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকুন।