ডাস্টবিন

198

পশ্চিম গুজরা গ্রামে বৃক্ষরোপণ অভিযান হবে। তাই নিয়ে চলছে গ্রামের শিশু-কিশোর সংগঠন সংঘসাথী’র আনন্দ আয়োজন। গ্রামের শিশু-কিশোরদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। কে কোন গাছ নেবে? কোন গাছ কোথায় লাগাবে? গাছগুলোকে কীভাবে পরিচর্যা করবে? এ নিয়ে জল্পনা কল্পনা চলছে ক’দিন ধরে।
অনুষ্ঠানটি হবে স্থানীয় কালী মন্দিরে। কোনো সভাপতি, প্রধান অতিথি থাকবে না। থাকবে না কোনো প্রটৌকল, না কোনো সিডিউল। বড়দের দায়িত্ব গাছের চারা সংগ্রহ করে এনে দেওয়া। তারপরে অনুষ্ঠান করা। চারা বিতরণ থেকে পারা লাগানোর পরামর্শ এসব শিশু-কিশোররা করবে। এ ধরণের ভিন্ন অথচ সাহসী আয়োজনে সংঘসাথীর ক্ষুদে সদস্য শোভন, শম্পা, রিপন, মাধুরী, লিমা, অর্নব, অন্তুু, লিকন, লতা, লিপি সবাই উঠে পড়ে লেগেছে।
অনুষ্ঠান কী হবে? কেমন হবে? এসব নিয়ে সবাই ক্লাবের কর্ণধার রন’দার কাছে পরামর্শ নিচ্ছে। রন’দাও নিয়মিত পরামর্শ সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এমনকি কীভাবে উপস্থাপনা করবে, কী বলবে এসব নিয়ে রিহার্সেলও হয়েছে। তাছাড়া ছেলে-মেয়েরা কীভাবে যেন জানতে পেরেছে রন’দার অফিসে একজন বিদেশী অতিথি এসেছেন। অনুষ্ঠানের দিন উনাকে গ্রামে নিয়ে আসবেন রন’দা। অষ্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশে এসেছেন। তার নাম ক্যাথরিন। তাতে সকলের মনে বাড়তি একটা আনন্দ কাজ করছে।
ক্যাথরিন এলো। অনেক সুন্দর ক্যাথরিন। লম্বা, ফর্সা। সোনালী চুল। ছেলেমেয়েদের এমন আনন্দ আয়োজন দেখে ক্যাথরিনও খুব খুশি। বোঝা যাচ্ছে সে খুব উপভোগ করছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের এমন একটি প্রত্যন্ত গ্রামে আসতে পেরে সেও আনন্দিত। কী সুন্দর মায়াময় প্রকৃতি। চারিদিকে সবুজের সমারোহ।
মন্দিরের নাটমঞ্চে ছেলেমেয়েদের নিয়ে গোল করে সবার সাথে মাদুর পেতে বসেছেন ক্যাথরিন। গ্রামের অনেকে দেখতে এসেছে। বয়ষ্করাও এসেছেন। এই গ্রামে কোনো বিদেশীকে খুব একটা দেখা যায়নি। ক্যাথরিন আসার সময় সকলের জন্য অনেকগুলো চকোলেট, চুইংগাম, ক্যাটবেরি নিয়ে এসেছেন। আগে থেকে স্থানীয় প্রাইমারি স্কুল এবং হাই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের খবর দেওয়া হয়েছে। তারা সবাই এসেছে।
সংঘসাথীর পক্ষ থেকে সকলের হাতে ক্যাথরিনকে দিয়ে চারা বিতরন করা হচ্ছে। বাচ্চাদের হাতে হাতে ক্যাথরিন চারা দিচ্ছে। সাথে চকোলেট চুইংগাম। সে নিজেও মাঝে মধ্যে একটা একটা মুখে দিচ্ছে। একটা বিষয় সবাই খেয়াল করলো, সে যে চকোলেট চুইংগাম খাচ্ছে আর ফয়েলগুলো তার পকেটে পুড়ে রাখছেন। কোথাও ফেলছেন না। শুধু তাই নয়, ছেলেমেয়েরা চকোলেট চুইংগাম খেয়ে খোসাগুলো যেখানে সেখানে ফেলছে, আর ক্যাথরিন তা এক এক করে কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে রাখছেন। মন্দিরের আশেপাশে যেখানে যেটা চোখে পড়ছে তাই কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে ভরছেন। অনেকে ভাবলো, এই বিদেশী পাগল না কি? অনেকে মুখ টিপে হাসলো।
একসময় রন’দার কানের কাছে মুখ নিয়ে ক্যাথরিন জিজ্ঞাসা করলো,
– এখানে কোনো ডাস্টবিন আছে কি?
রন’দা বুঝিয়ে বললো,
– এটা গ্রাম। আর গ্রামে কোনো ডাস্টবিন থাকে না।
– শহরে?
– হুম। শহরে আছে।
– কিন্তু তোমাদের শহরে ডাস্টবিন থাকলেও রাস্তাঘাটে এতো ময়লা কেন? ডাস্টবিন অনেকে ব্যবহার করে না।
– তুমি ঠিকই বলেছো। এখানে অনেকে ময়লা আবর্জনা নির্দ্দিষ্ট ডাস্টবিনে না ফেলে যেখানে সেখানে ফেলে, যা আমাদের করা মোটেও উচিত নয়।
কিন্তু তোমরা কি জানো, এটা স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর?
– তাও জানি। এও জানি, ভবিষ্যতে এই অভ্যাস চলতে থাকলে স্বাস্থ্য সমস্যা আরও মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হবে।
– কিন্তু এখন থেকে এই অভ্যাসের পরিবর্তন দরকার। তা না হলে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ তৈরি করা মুশকিল হয়ে পড়বে। তোমরা নিজেরাই একটু সচেতন হলে, একটু চেষ্টা করলে একটি সুন্দর স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ গড়ে তুলতে পারো।
– তুমি ঠিকই বলেছো ক্যাথরিন। কিন্তু তোমার পকেটের ময়লাগুলো কি করবে? তুমি ইচ্ছে করলে রাস্তার একপাশে ঝোপের মধ্যে ফেলে দিতে পারো।
ক্যাথরিনের কাছে রন’দার কথাটা মোটেও ভালো লাগেনি। তা মুখের ভাব দেখে একটুও বুঝতে অসুবিধা হয়নি রন’দার। তবুও খুব ভদ্রভাবে ক্যাথরিন বললো, না ওগুলো আমি শহরে নিয়ে গিয়ে ডাস্টবিনে ফেলবো। তা যদি না পারি আমার হোটেলে ডাস্টবিন আছে। ওখানে ফেলে দেবো।
এবার ক্যাথরিনকে কিছু বলতে হবে। শোভন দাড়িয়ে ক্যাথরিনকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করলো। ক্যাথরিন দাঁড়িয়ে শিশু-কিশোরসহ উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললো, তোমরা যেমন গাছ লাগিয়ে পরিবেশ সুন্দর করার চেষ্টা করছো, তেমনি সেই পরিবেশ রক্ষা করার দায়িত্বও তোমাদের। গ্রাম আর শহরকে কখনও আলাদা করে দেখা ঠিক নয়। যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলা গ্রাম এবং শহর দুটোর জন্যই ক্ষতিকর। আশা করি তোমাদের হাতে গড়া পরিবেশ তোমরা নিজেরাই ভালোমতো রক্ষা করতে চেষ্টা করবে। এই তোমাদের প্রতি আমার অনুরোধ থাকলো। তোমরা সবাই ভালো থেকো।
সবশেষে তোমাদের একটা প্রশ্ন করবো। ছেলেমেয়েরা সবাই বলে ওঠলো, কী প্রশ্ন? আচ্ছা বলোতো, ময়লা আবর্জনা তোমরা কোথায় ফেলবে? সবাই চিৎকার করে উত্তর দিলো, ডাস্টবিনে।
ধন্যবাদ তোমাদের সবাইকে।