ডাকসু নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ ভোট বর্জন, বিক্ষোভ

30

নানা অনিয়মের অভিযোগের মধ্যে অনুষ্ঠিত ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন বাতিলের দাবিতে আজ মঙ্গলবার বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে ভোট বর্জনকারী বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীরা। গতকাল সোমবার হলগুলোতে ভোটগ্রহণ শেষে গণনা চলার মধ্যে বিকাল ৫টায় উপাচার্য ভবনের সামনে সমাবেশে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন বাম সংগঠনগুলোর প্যানেলের ভিপি প্রার্থী লিটন নন্দী।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্যানেল, স্বতন্ত্র জোটের প্যানেল, স্বতন্ত্র অন্য প্রার্থী ও তাদের প্রতিনিধিরাও এই সমাবেশে ছিলেন। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার আগেই কারচুপির অভিযোগ তুলে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন ছাত্রলীগ বাদে অন্য প্রায় সব প্যানেলের প্রার্থীরা। এর মধ্যে কোটা আন্দোলনকারীদের বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দুই মোর্চ স্বাধিকার স্বতন্ত্র পরিষদ ও স্বতন্ত্র জোট এবং ছাত্র ফেডারেশন ও ছাত্রদল।
ছাত্র ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী বলেন, “নির্বাচন বর্জনকারী সব দলের ও প্যানেলের প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে বলছি, ফল বাতিল ও ভিসির পদত্যাগের দাবিতে মঙ্গলবার সকাল ১০টায় রাজু ভাস্কর্যে ক্লাস বর্জন করে বিক্ষোভ হবে। ডাকসু নির্বাচন যদি বাতিল করা না হয় তাহলে কর্মসূচি থাকবে।
সমাবেশের আগে প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে কারচুপি ও বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে অভিযোগ দিয়ে আসেন ভোট বর্জনকারী প্রার্থীরা। এরপর তারা উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন। সেখানে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করে ক্যাম্পাসে মিছিল করেন তারা। খবর বিডিনিউজের
এদিকে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ‘সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে’ ভোটগ্রহণ হয়েছে বলে দাবি করেছেন উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া’ এ নির্বাচন ‘উৎসবমুখর’ হয়েছে।
ভোটের সার্বিক পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আমাদের শিক্ষার্থীরা সুশৃঙ্খল এবং তাদের গণতন্ত্রের মূল্যবোধ রয়েছে। এটা দেখে আমি খুশি। তাদের এই মূল্যবোধ আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়। সামনের দিনগুলোতে এই ধারা অব্যাহত থাকবে।”
ভোটগ্রহণের একেবারে শেষ পর্যায়ে বেলা ১টার দিকে মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় বেশ কয়েকটি প্যানেল এবং ক্যাম্পাসে ছাত্র ধর্মঘটেরও ডাক দেয় তারা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, “ডাকসুর রীতিনীতি, গঠনতন্ত্র রয়েছে। তা মেনেই সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ডাকসু নির্বাচনে সোমবার সকাল ৮টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলে একযোগে ভোটগ্রহণ শুরুর কথা থাকলেও ব্যালট পেপার নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে রোকেয়া হল ও বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে ভোটগ্রহণ বিঘিœত হয়। এর মধ্যে কুয়েত মৈত্রী হলের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সেখানে ভোট শুরুর আগেই বস্তাভর্তি ব্যালট পেপার পাওয়া গেছে, যেগুলোতে ভোটের চিহ্ন দেওয়া ছিল। আর দুপুরে রোকেয়া হলে ভোটগ্রহণ কক্ষের পেছনে আরেকটি কক্ষে ব্যালট পেপার বোঝাই ট্রাংক পেলে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা কারচুপির অভিযোগ এনে তা ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
ডাকসু নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতে রোকেয়া হলে ‘নাটক’ হয়েছে দাবি করে পুরো প্রক্রিয়ায় জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়েছে ছাত্রলীগ। বাম সংগঠনগুলোর প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ছাত্র ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী, কোটা আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ভিপি প্রার্থী নুরুল হক নূর ও জিএস প্রার্থী রাশেদ খানকে মামলায় আসামি করা হবে বলে ছাত্রলীগ নেতারা জানিয়েছেন।
ডাকসু ও হল সংসদের নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ‘ষড়যন্ত্র’ করায় তাদের ছাত্রত্ব বাতিলের দাবিও তুলেছে সরকার সমর্থক সংগঠনটি।
ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বলেন, “লিটন, নুর, রাশেদের প্রার্থিতা বাতিল করতে হবে, তাদের স্থায়ী বহিষ্কার করতে হবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন ছিনতাইয়ের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।”
রোকেয়া হলে ট্রাংকে যে ব্যালট পেপার পাওয়া গেছে, তার সঙ্গে আসল ব্যালটের কোনো মিল নেই বলে দাবি করে গোলাম রাব্বানী বলেন, “রোকেয়া হলে সাদা কালো অফসেটের যে ব্যালট পেপার পাওয়া গেছে, তার সাথে অরিজিনাল ব্যালটের কোনো মিল নেই। ক্রস দেওয়া হয়েছে সেটারও কোনো মিল নেই।”
ছাত্রলীগের প্রার্থীদের ভোট দেওয়া ওই ব্যালট পেপার উদ্ধারের ঘটনায় কুয়েত মৈত্রী হলের ভারপ্রাপ্ত প্রাধ্যক্ষকে দায়িত্ব থেকে অপসারণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এনিয়ে রাব্বানী বলেন, “কর্তৃপক্ষ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে বিষয়ে আমাদের কোনো কথা নেই।”
ছাত্রদের ১৩টি হলে ভোটগ্রহণ নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই বলে দাবি করেন ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক।
এদিকে হাজী মুহাম্মদ মহসীন হলে ভোটারদের লাইন ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণ করছে বলে অভিযোগ করেছেন ভোটাররা। তাদের অভিযোগ, মহসীন হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সানির নেতৃত্বে ছাত্রলীগ ভোটারদের লাইন ‘নিয়ন্ত্রণ’ করায় অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী ভোট না দিয়ে ফিরে গেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভোটার বলেন, “ছাত্রলীগের অবস্থানের ভয়ে অনেকেই ভোট দিতে আসছে না। ছাত্রলীগ হলের প্রবেশমুখ থেকে ভোটার লাইন নিয়ন্ত্রণ করছে।”
এ বিষয়ে হলের রিটার্নিং অফিসারের কাছে অভিযোগ জানাতে এসে ছাত্রলীগের ধাওয়ার মুখে পড়েন প্রগতিশীল ছাত্র জোটের ভিপি পদপ্রার্থী ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী । তার অভিযোগ, মহসীন হলের গেইট দিয়ে ঢুকে হলের আবাসিক শিক্ষকদের বাসভবন এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি ‘হামলার শিকার’ হন।
ছাত্রলীগ নেতা সানি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, “কোনো নিয়ন্ত্রণ করছি না আমরা। হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরাই প্রবেশমুখে অবস্থান নিয়ে আছে।”
এদিকে শহীদুল্লাহ হলেও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রবেশে বাধা দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ছাত্রদল। ডাকসুর জিএস পদে ছাত্রদলের প্রার্থী আনিসুর রহমান খন্দকার অনীক বলেন, “১০ টার পর তাদের পরিচিত ব্যক্তিদের বারবার ঢুকতে দিচ্ছে। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের গেইট পার হয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না।”
অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শহীদুল্লাহ হলের প্রভোস্ট সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, “কাউকে বাধা দেওয়ার খবর পাইনি। তবে যতক্ষণ পর্যন্ত ভোটাররা লাইনে অপেক্ষা করবে, ততক্ষণ ভোট চলবে। কেন্দ্রের ভেতরে থাকা সবার ভোট নেওয়া হবে।”
গতকাল ভোট শেষে নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক আবদুল বাছির জানান, প্রতিটি কেন্দ্রে অপটিক্যাল মার্ক রিকগনিশন (ওএমআর) কাউন্টারে ভোট গণনা হবে। হল সংসদের ভোট হলেই ঘোষণা করা হবে। পরে সব কেন্দ্রের ফলাফল একীভূত করে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসুর ফলাফল দেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, এ নির্বাচনে মোট ভোটার ৪৩ হাজার ২৫৫ জন। তাদের মধ্যে ৫টি ছাত্রী হলের ভোট ১৬ হাজার ৩১২। ডাকসুতে ২৫ পদের বিপরীতে মোট প্রার্থী ২২৯ জন; ১৮টি হল সংসদে ১৩টি করে ২৩৪টি পদে বিরপরীতে প্রার্থী ৫০৯ জন। ডাকসুতে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকায় সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ২১ জন; তাদের সঙ্গে এই নির্বাচনে ১৪ জন সাধারণ সম্পাদক (জিএস) এবং ১৩ জন সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে লড়ছেন। ১২টি প্যানেলের বাইরে ভিপি পদে ৯ জন এবং জিএস পদে ২ জন স্বতন্ত্র হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন।