ঠেগামুখ স্থলবন্দর চালু হলে লাভবান হবে বাংলাদেশ ভারত

98

ঠেগামুখ স্থলবন্দর কবে নাগাদ চালু হতে যাচ্ছে, তা এখনও অনিশ্চিত। তবে বন্দরটি চালু হলে লাভবান হবে ভারত বাংলাদেশ উভয়ে। মূলত তারই লক্ষ্যে স্থলবন্দরটি চালুর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত। এর মধ্য দিয়ে সম্প্রসারিত হবে বাণিজ্যিক সুবিধা। এমনটাই আশাবাদ সরকারের উচ্চমহল থেকে শুরু করে তৃণমূল মানুষের সবার মনে। সম্প্রতি সরাসরি সরেজমিন ঠেগামুখ পরিদর্শনকালে আলাপ হয়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সীমান্তরক্ষী বিশেষজ্ঞ, প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ তৃণমূলের জনগণের সঙ্গে। তারা সবাই স্থলবন্দরটি চালুর অপেক্ষায়। কিন্তু কবে নাগাদ তা চালু করা হবে কিংবা আদৌ হচ্ছে কি না, তার সঠিক তথ্য জানেন না। তারা বলছেন, বন্দরটি চালু হলে দ্রুত পাল্টে যাবে এলাকার অর্থনৈতিক চালচিত্র। এলাাবাসীর জীবনমান বেড়ে বদলে যাবে তাদের ভাগ্য। অর্থনৈতিক উপার্জন বাড়বে বাংলাদেশের।
ঠেগামুখ বাংলাদেশের রাঙামাটি পার্বত্য জেলার বরকল উপজেলার ভূষণছড়া ইউনিয়ন এবং ভারতের মিজোরামের সীমান্ত এলাকায়। রাঙামাটি শহর থেকে নৌপথে প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দুরত্বে অবস্থিত বরকল উপজেলার ভূষনছড়া ইউনিয়নের এ ঠেগামূখ। ওপারে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের দেমাগ্রি এলাকা। দু’দেশের একমাত্র সীমানা হচ্ছে ভারতের লুসাই পাহাড় থেকে উৎপত্তি কর্ণফুলী নদী। এ নদী দিয়ে উভয় দেশের লোকজন চলাচল করেন নিজ নিজ দেশের পতাকার উড়িয়ে। একই নদীতে মাছ শিকার করেন দু’দেশের জেলে। আবার সীমান্তের উভয় পাড়ে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী হচ্ছেন বেশিরভাগ চাকমা সম্প্রদায়ের। তাদের মধ্যে ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি মিল। অনেকের মধ্যে বিয়ের মাধ্যমে তৈরি হয় নতুন আত্মীয়তার বন্ধন।
পার্বত্য সীমান্তবর্তী উভয় পাড়ের মানুষের হৃদয়ের বন্ধনের প্রতি শ্রদ্ধা রয়েছে বিজিবি-বিএসএফ উভয়ের। স্বভাবতই সীমান্ত পাহারায় কখনও কখনও যান্ত্রিকতার চেয়ে হৃদয়বৃত্তিকেই প্রাধান্য দেন তারা। আবার বিজিবি ও বিএসএফ’এর মধ্যে সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ রাখতে প্রায় সময় আয়োজন করা হয় প্রীতি ভলিবল খেলা ও পতাকা বৈঠক। ঠেগামুখে একটি বাজার রয়েছে। এ বাজারকে কেন্দ্র করে রয়েছে দুই শতাধিক পরিবারের বসবাস। তবে বাজারের চার পাশে বসবাস করছে চাকমা সম্প্রদায়ের লোকজন। সূত্রে জানা যায়, দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণে ঠেগামুখ স্থলবন্দর চালুর বিষয়ে ভারতের প্রস্তাবে সম্মত হয় বাংলাদেশ। এরই মধ্যে নীতিগত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে উভয় দেশ।
তবে কবে নাগাদ স্থলবন্দরটি চালু হচ্ছে তা এখনও অনিশ্চিত। ভারতের পক্ষে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ প্রায় শেষের দিকে। এ নিয়ে এগোচ্ছে বাংলাদেশও। এ বিষয়ে সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সাবেক সভাপতি এমপি ফজলে করিম চৌধুরী বলেন, ঠেগামুখ স্থলবন্দরটি চালুর বিষয়ে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। স্থলবন্দরটি চালু করা গেলে ভারত বাংলাদেশ উভয়ে লাভবান হবে। উভয় দেশের মানুষের বাণিজ্যিক সুবিধা তৈরি হবে। এতে দ্রুত পাল্টে যাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক অবস্থার। অপর দিকে জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশিদ বলেন, ঠেগামুখ স্থলবন্দর চালু নিয়ে কার্যক্রম তেমন কিছুই জানেন না। তবে বিগত জেলা প্রশাসক সামসুল আরেফিন প্রাথমিক ভাবে মন্ত্রনালয়ে এব্যাপারে একটি রিপোর্ট পাঠিয়েছেন মর্মে ফাইলটি দেখেছি। শুনেছি এরই মধ্যে জরিপ সম্পন্ন হয়েছে।রাঙামাটি জেলার জুরাছড়ি বিলাইছড়ি রাজস্থরী হয়ে চট্টগ্রাম-ঠেগামুখ সড়ক নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন।
সড়কটির নির্মাণ শেষ হলে পাহাড়ের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বৈপ্লিক পরিবর্তনের পাশাপাশি সেখানকার আর্থ-সামাজিক অবস্থারও আমুল পরিবর্তন আসবে। এদিকে ঢাকা স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, এ ব্যাপারে তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের অনুমতি চেয়ে চিঠি লিখলে এ চিঠির জবাব এখনো পায়নি স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষ যার কারণে ঠেগামুখ স্থলবন্দরটি চালু করার কাজ এখনো সম্ভব হয়নি। যদি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এ ব্যাপারে দ্রুত সম্মতি দেয় তা হলে কাজ চালু করা হবে।
বিজিবির (বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ) বরকল জোন কমান্ডার জানান, ঠেগামুখ স্থলবন্দরটি চালু হলে এলাকার অর্থনৈতিক চালচিত্র দ্রুত পাল্টে যাবে। বাণিজ্যিক সুবিধা বেশী পাবে বাংলাদেশের মানুষ। স্থানীয় লোকজনের সবক্ষেত্রে জীবনযাত্রার মান বাড়বে। গড়ে উঠবে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ। বর্তমানে সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার রয়েছে। এখন বিওপি বেড়েছে। রাঙামাটি জেলার ১৭০ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা সম্পূর্ণ রক্ষিত। স্থলবন্দরটি চালু হলে সীমান্ত নিরাপত্তায় কোনো সমস্যা হবে না। ছোটহরিণার ভারপ্রাপ্ত জোন কমান্ডার মেজর কামরুজ্জামান জানান, ঠেগামুখ স্থলবন্দরটি দ্রুত চালুর বিষয়ে কিছুদিন আগেও ভারতের একটি ডেলিগেশন টীম সফর করে গেছে। আরেকটি টীম আসবে।
স্থলবন্দরটির চালুর ব্যাপারে কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সবকিছুর সার্ভে চলছে। সরেজমিন পরিদর্শনকালে সরাসরি আলাপ হয় ঠেগামুখ বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি কামিনী চাকমার সঙ্গে। তিনি বলেন, ঠেগামুখে স্থলবন্দর হবে শুনছি-কিন্তু কবে চালু হবে তা জানা নেই। স্থলবন্দরটি চালু হলে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের বাণিজ্য সুবিধা বাড়বে। কিন্তু তাতে যেন স্থানীয় জনগণের সুবিধা অগ্রধিকার পায়, তা বিবেচনায় রাখতে হবে। তা ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকরা যাতে ন্যায্য পাওনা পায় তাও নিশ্চিত করতে হবে। আমাদেরকে কী সুবিধা দেয়া হবে তা স্পষ্ট করে দিতে হবে। ভূষণছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদ মামুন জানান, ঠেগামুখ স্থলবন্দরটির চালু নিয়ে কাজ চলমান রয়েছে। এটি চালু হলে স্থানীয় জনগণ সবাই লাভবান হবে। বাণিজ্যিক সম্প্রসারণের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজস্বসহ অর্থনৈতিক আয় বাড়বে।
বিজিবির ঠেগামুখ ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক শাহাদাত ও উপ-ক্যাম্প অধিনায়ক মাসুদ জানান, সীমান্ত এলাকায় দু’দেশের মানুষ সৌহার্দ্য ও শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন। দু’দেশের মানুষের মধ্যে অপ্রীতিকর তেমন কিছুই ঘটে না। সীমান্ত অপরাধ প্রতিরোধে বিজিবি-বিএসএফ উভয়ে সব সময় সর্বোচ্চ সতর্কতায় রয়েছে। সূত্রে জানা যায়, ভারতের সেভেন সিষ্টারখ্যাত সাতটি রাজ্যে বাংলাদেশী পণ্যের বিপুল চাহিদা রয়েছে। প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ভোগ্যপণ্য, ইট, সিমেন্ট, সার, কসমেটিক্সসহ বিভিন্ন পণ্য এসব রাজ্যে রফতানি হয়। সেভেন সিস্টারের বাজার ধরতে এবং পারস্পরিক বাণিজ্য সুবিধা বাড়াতে ঠেগামুখ স্থলবন্দর স্থাপন হলে অর্থনৈতিকভাবে গড়ে উঠবে বিশাল সুবিধা। এদিকে ঠেগামুখ স্থলবন্দর বাস্তবায়নে প্রক্রিয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার। নির্মিত হতে চলেছে চট্টগ্রাাম সমুদ্র বন্দর হতে বরকলের ঠেগামুখ পর্যন্ত ৩২৭ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সংযোগ সড়ক। পাশাপাশি উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে নৌপথ সংস্কারের।