টেন্ডারবাজসহ দাপুটে নেতারা আত্মগোপনে

345

টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাসী, জুয়াড়ি, চাঁদাবাজ ও ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিজ দলেই শুরু করেছেন শুদ্ধি অভিযান। নিয়মিত অভিযান চলছে অপকর্মে জড়িতদের সাম্রাজ্যে। ইতোমধ্যে ক্যাসিনো ইস্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গনে বড়ধরনের ধাক্কা দেয়া হয়েছে। যার বড় প্রভাবটা পড়েছে যুবলীগে। ঢাকায় কয়েকজন যুবলীগ নেতা রাতারাতি হিরো থেকে জিরো হয়েছেন। সরকারের কঠোর এই মনোভাবে রাজধানীর মতো চট্টগ্রামের সরকারি দপ্তর, পাড়া-গলিতে দাপিয়ে বেড়ানো টেন্ডারবাজ ও কিশোর গ্যাং লিডাররা এখন আত্মগোপনে। টেন্ডার নিয়ন্ত্রণের ‘অভয়ারণ্যে’ পরিণত হওয়া রেলের বিতর্কিত ঠিকাদাররাও এখন আড়ালে আছেন। তবে বিতর্কিত টেন্ডারবাজ ও গ্যাং লিডারদের হয়ে সবধরনের কর্মকান্ডে আধিপত্য বিস্তার করছেন তাদের অনুসারীরা।
র‌্যাব-৭ এর সহকারী পরিচালক মো. মাসুকুর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, ‘মাদক, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স। কেউ সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করে রেহাই পাবে না। র‌্যাব নিজেদের মূলনীতিতে অবিচল। যেখানেই আইনশৃঙ্খলা বিগহন ঘটে কিংবা ঘটার আশঙ্কা আছে সেখানেই র‌্যাবের উপস্থিতি থাকবে।’
জানা যায়, ঢাকায় ক্যাসিনো বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হুঙ্কারের পর জুয়ার আসর বসা চট্টগ্রামের বিভিন্ন ক্লাবে অভিযান চালানো হয়। চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও দখলবাজিসহ নানা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও বাণিজ্যের সাথে জড়িত থাকা টিনুকে গত ২২ সেপ্টেম্বর অস্ত্র ও গুলিসহ গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। রাজনৈতিক পদে না থাকলেও যুবলীগ নেতা পরিচয়ে চকবাজার, পাঁচলাইশ, মুরাদপুর, দেওয়ানবাজার এলাকায় নানা অপরাধে যুক্ত ছিলেন টিনু। গত ১৩ অক্টোবর নগরের আগ্রাবাদ ওয়ার্ড ট্রেড সেন্টারের সামনে র‌্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে যুবলীগ কর্মী খোরশেদ আহমেদ নিহত হন। র‌্যাব জানায়, খোরশেদের বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র আইন, চাঁদাবাজিসহ আটটি মামলা রয়েছে। খোরশেদ মোগলটুলী, আগ্রাবাদ ও আশপাশের এলাকায় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এই দুই ঘটনার পর আস্কারা পেয়ে বেপরোয়া হওয়া নেতারা গা ঢাকা দিতে শুরু করেন। এরমধ্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পাঁচজন কাউন্সিলরও আছেন। যারা দোর্দন্ড প্রতাপে নিজ এলাকা নিয়ন্ত্রণ, জায়গা দখল, চাঁদাবাজি ও কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দিতেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রেল অঙ্গনে টেন্ডার মানেই কেন্দ্রীয় যুবলীগের উপ-অর্থ সম্পাদক হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর ও যুবলীগ নেতা সাইফুল আলম লিমনের দাপট কারো অজানা নয়। টেন্ডার ইস্যু ও রাজনীতিতে এই দুই নেতার মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক হলেও অভিন্ন নীতি দুজনের। ক্যাসিনো ইস্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত হওয়ার আগেই বিদেশে যান যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর। পরে অবস্থা বেগতিক দেখে দেশে ফিরেননি আর। দেশে থাকতে দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা করতেন বাবর। আরেক দাপটশালী যুবলীগ নেতা সাইফুল আলম লিমনও গা ঢাকা দিয়েছেন। বাবর অ্যান্ড ব্রাদার্স, মেসার্স গড়াই করপোরেশন, মেসার্স আফরোজা এন্টারপ্রাইজের নামে কাজ নিয়ে রেলের একছত্র ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন বাবর ও লিমন। বর্তমানে মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে বাবরের অনুসারীরা কিছুটা পিছু হটলেও লিমনের অনুসারী হিসেবে রেলে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছেন ফরিদ, রবিউল, জিতু নামের কয়েকজন। নগর যুবলীগের আহব্বায়ক কমিটির সদস্য শহিদুল ইসলাম শামীমের বিরুদ্ধে রেলওয়ের টেন্ডারবাজির অভিযোগ আছে। ঠিকাদার হিসেবে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর যাবতীয় কাজের একছত্র নিয়ন্ত্রণে আছেন যুবলীগ নেতা পরিচয়দানকারী ইকবাল হোসেন। শামীম ও ইকবালকেও প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না এখন।
রেলওয়ের দুইজন ঠিকাদার জানান, ‘বাবর-লিমনের দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে নতুন একটি চক্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তারা ভিন্ন কৌশলে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছেন। এছাড়াও নতুন কিছু ঠিকাদারও রেলের কাজে মনোনিবেশ করেছেন।
যারা ইতোমধ্যে ভাগিয়ে নিয়েছেন বেশ কয়েকটি বড় কাজ। তবে এসব ঠিকাদারকে সামনে রেখে পেছন থেকে ইন্ধন যুগিয়ে যাচ্ছেন শীর্ষ ঠিকাদাররাই।’
দীর্ঘদিন ধরে রেলওয়ে ঠিকাদার সমিতির সভাপতি হিসেবে পাহাড়তলীর কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন হিরণ ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর দায়িত্বে ছিলেন। সম্প্রতি সংগঠনের নেতৃত্বে পরিবর্তন এসেছে। সভাপতির দায়িত্বে নুরুল হক মজুমদার ও সাধারণ সম্পাদক মো. নওফেল। এতে বাবর-লিমনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ম্যানেজ করেই এ সংগঠনের নেতারা প্রকৌশল বিভাগের সকল টেন্ডার ভাগভাটোয়ারা করেন। তবে রেলের টেন্ডারবাজদের বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে বলেও জানা যায়। রেলওয়ের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে জানতে রেলওয়ে ঠিকাদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. নওফেলকে বেশ কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। পরে মুঠোফোনে ম্যাসেজ দিলেও তিনি সাড়া দেননি।
পূর্বাঞ্চল রেলে টেন্ডারবাজি বন্ধ হয়েছে জানিয়ে প্রধান প্রকৌশলী মো. সবুক্তগীন পূর্বদেশকে বলেন, ‘এখন পূর্বাঞ্চল রেলের প্রকৌশল বিভাগের পরিস্থিতি অনেক ভালো। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ সরকারের অনুকূলে আছে। সবধরনের নিয়মনীতি অনুসরণ করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আমি যোগদানের পর থেকে কেউ আমার উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি। পারবেও না।’
রেল ছাড়াও স্বাস্থ্য বিভাগ, শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, গণপূর্ত বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডে যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নামধারী কয়েকজন নেতা টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেন। এতদিন ধরে এসব সরকারি অফিসে ঠিকাদারে ভরপুর থাকলেও এখন আনাগোনা কমেছে। আড়ালে থেকেই ঠিকাদারির নিয়ন্ত্রণ করছেন দাপটশালী ঠিকাদাররা। যারা রাজনৈতিকভাবেই বিভিন্ন পদে আসীন আছেন।
বায়েজিদের ত্রাস হিসেবে পরিচিত আবু মো. মহিউদ্দিন, দিদার গা ঢাকা দিয়েছেন। এই দুইজন পলিটেকনিক্যাল কলেজ রাজনীতিতে একটি পক্ষের নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নাসিরাবাদ শিল্পাঞ্চলে চাঁদাবাজি, জায়গা দখলের সাথে যুক্ত মহিউদ্দিনের গ্রæপ। সম্প্রতি পানি জসীম নামে তাদের এক সহযোগী গ্রেপ্তারের পর বন্দুকযুদ্ধে আহত হয়েছেন। এছাড়াও বহদ্দারহাটে এসরারুল হকের দাপট সবার জানা। গত ৫ এপ্রিল চান্দগাঁও থানার ফরিদার পাড়া এলাকায় চাঁদা চেয়ে না পেয়ে আমজাদ হোসেনের পা ড্রিল মেশিনে ফুটো করে দেন এসরালের অনুসারীরা। তার বিরুদ্ধে জায়গা দখল, চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে। নগরের দুই নাম্বার গেট, জিইসি, আল ফালাহ গলিতে বেশ দাপট যুবলীগ নেতা সোলাইমান বাদশার। বাদশা এসব এলাকায় কিশোর গ্যাং লিডার হিসেবেও পরিচিত। অভিযান শুরুর পর এসব নেতার কাউকেই প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। এতদিন ধরে যুবলীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের কমিটি গঠনের খবরে চট্টগ্রামের বিতর্কিত নেতারা মাঠে-ময়দানে সরব থাকলেও এখন তাদের সাড়া মিলছে না। অনেকেই দেশে থাকলেও কর্মীদের ফোন ধরেন না। অনেকেই ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে নিরব ভূমিকা পালন করছেন। নগর যুবলীগের আহব্বায়ক কমিটির বেশ কয়েকজন নেতাও শুদ্ধি অভিযানে ছিটকে পড়তে পারেন এমন শঙ্কায় দিনযাপন করছেন।
জানতে চাইলে নগর যুবলীগের আহবায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু পূর্বদেশকে বলেন, ‘কোনো সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজের সংগঠনে ঠাঁই হবে না। সাংগঠনিকভাবে পদপ্রত্যাশী যারা ছিলেন তারা মাঠেই আছেন। যারা ভিন্নপন্থায়, ভিন্ন উপায়ে পদ পেতে চেয়েছিলেন তারা আত্মগোপনে চলে গেছেন।’