টেকসই শিক্ষার অগ্রযাত্রায় হাতে-কলমে বিজ্ঞান শিক্ষা

364

মানুষের জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ সৃষ্টিই হল শিক্ষা। আর যে শিক্ষা বর্তমান প্রজন্মকে ভবিষ্যতে টিকে থাকার জন্য সহায়তা করবে সেটিই হল টেকসই শিক্ষা। আর এই টেকসই শিক্ষার ভিতকে যদি সুদৃঢ় করতে হয় তবে প্রথম প্রয়োজন হবে আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে জীবনঘনিষ্ঠ বিভিন্ন বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত করে একবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তাদের উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। এ লক্ষ্যে সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর আলোকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২ প্রণয়ন করেছেন। এই শিক্ষানীতিতে বিজ্ঞান শিক্ষার বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে কেননা বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার ব্যতীত জাতীয় উন্নয়ন কিংবা ২০৩০ নাগাদ আমাদের এসডিজি অর্জনের যে স্বপ্ন তা পূরণ কোন ক্রমেই সম্ভব নয়। ২০১০ সালের আগে বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায় মফস্বলের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল নিতান্তই কম যা আমাদের জন্য ছিল হতাশাজনক। তখন আমাদের মাধ্যমিক পর্যায়ে ৬ষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিজ্ঞানে ব্যবহারিক দিকটার উপর তেমন কোন গুরুত্ব দেয়া হতনা। আমরা যারা বিজ্ঞান শিক্ষক ছিলাম তাঁরা মনে করতাম শুধু নবম ও দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিষয়ের ব্যবহারিক দিকটাকে গুরুত্ব দিলে চলবে। বর্তমানে এই ধারণাকে পরিবর্তন করে ২০১২ সালের শিক্ষাক্রম বিস্তরণে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত বিজ্ঞান বিষয়ে ব্যবহারিক ও তত্ত্বীয় বিষয়সমূহ এমনভাবে সমন্বয় করা হয়েছে, যাতে উভয়ই কার্যক্রম সমূহ সুষম সমন্বয়ের মাধ্যমে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর শিখন শেখানো কার্যক্রমের নতুন ভিত তৈরীর পথকে প্রশস্থ করেছে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাত্ত্বিক ধারণার সাথে সাথে হাতে-কলমে কাজ করার পারদর্শিতা অর্জনে সক্ষম হচ্ছে। এ লক্ষ্যে শিক্ষাক্রমের এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে সর্বাগ্রে প্রয়োজন শিক্ষকগনকে প্রস্তুত করার জন্য ব্যাপক প্রশিক্ষণ। তারই ধারাবাহিকতার আলোকে ২০১৪ সালে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সেসিপের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণিতে পাঠদানকারী ৯১,৪০০ জন বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষককে প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ প্রশিক্ষনের আওতায় প্রথম পর্যায়ে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৫৫,০১৭ জন বিজ্ঞান শিক্ষকের প্রশিক্ষণ সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
এমতাবস্থায় ২য় পর্যায়ে প্রশিক্ষণবিহীন বিজ্ঞান বিষয়ে পাঠদানরত বাকী শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ সারা দেশব্যাপী সাম্প্রতিক সময়ে সম্পন্ন হয়েছে। ২০১৬ সালের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের ফলপ্রসূতা ও কার্যকারিতা যাচাইয়ের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং জাতীয় পরামর্শক পর্যায়ক্রমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নমুনা স্কুল নির্বাচন করে বিজ্ঞান বিষয়ের শ্রেণি কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে। পর্যবেক্ষণ ও পরিদর্শনে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাক্ষাৎকার থেকে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তে প্রতীয়মান হয় যে, এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান শিক্ষায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে যার ফলশ্রুতিতে এখন মাধ্যমিক বিদ্যালয় সমূহে নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা আনুপাতিক হারে বেড়ে চলেছে যা আমাদের টেকসই শিক্ষায় আশাব্যঞ্জক প্রভাব ফেলবে বলে আমি মনে করি। এ প্রশিক্ষণের ম্যানুয়েলটিতে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিমূর্ত ধারণাকে আমাদের পরিবেশের চারপাশের পরিত্যক্ত ও সহজলভ্য বস্তুকে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে মূর্ত ধারণায় এনে পাঠ্যবিষয়কে কিভাবে সহজে শিক্ষার্থীর কাছে বোধগম্য করা যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা হয়েছে। যেমন বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ধারণা সম্পর্কিত একটি বিমূর্ত বিষয়কে শিক্ষার্থীদের কাছে মূর্ত হিসেবে আত্মস্থ করানোর জন্য সহজলভ্য উপকরণ হিসেবে দুইটি কাঁচের গ্লাস, পলিথিন পেপার, পানি এবং সুঁতা ব্যবহার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে দুইটি গ্লাসে পানি ভর্তি করে প্রথমে থার্মোমিটারের সাহায্যে উভয় গ্লাসের প্রাথমিক তাপমাত্রা নিয়ে একটি গ্লাসের মুখ পলিথিন পেপার দিয়ে মুড়িয়ে কিছুক্ষণ রোদ্রে রেখে দেয়ার পর যখন গ্লাসটিকে শিক্ষার্থীদের সামনে এনে মুখ থেকে পলিথিন পেপার খুলে থার্মোমিটারের সাহায্যে তাপমাত্রা পরিমাপ করা হয় তখন দেখা যায় যে, তাপমাত্রা আগের থেকে অনেক বেড়ে যায়।
এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের এটাই বোঝানো হয়েছে যে, সূর্যের তাপ পলিথিন পেপার ভেদ করে পানিতে প্রবেশ করেছে ঠিকই, কিন্তু ভিতর থেকে বাইরে আসতে না পারায় পানির তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন এই পরীক্ষাটিকে যদি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সাথে তুলনা করি তবে দেখতে পাই আমাদের বনজ সম্পদ ধ্বংস, কার্বন ডাই অক্সাইডের আধিক্য ইত্যাদি কারণে বায়ুমন্ডলের যে ওজন স্তর আছে সেই স্তরের ক্ষতির কারণে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মিগুলোকে সঠিকভাবে শোষণ করতে পাচ্ছে না যার ফলশ্রুতিতে এই পৃথিবী প্রতিনিয়ত উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থী বিষয়টিকে অনুধাবন করে পরিবেশ সংরক্ষণে গাছপালার ভূমিকা যে অপরিহার্য তা উপলদ্ধি করে নিজের অস্তিত্বে টিকে রাখার জন্য গাছপালা রোপনে উদ্বুদ্ধ হয়ে টেকসই শিক্ষার মত বাস্তব সম্মত শিক্ষা অর্জন করবে বলে আমি মনে করি। এভাবে ৬ষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিজ্ঞান বই থেকে ২৫টি জীবন ঘনিষ্ট বিষয়ের পাঠ সমূহ বাছাই করে প্রকৃতি প্রাপ্ত বিভিন্ন পরিত্যক্ত বস্তু ও সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে কিভাবে পাঠকে শিক্ষার্থীদের কাছে সহজে বোধগম্য করা যায় এ বিষয়ে ম্যানুয়েলে বিজ্ঞান শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এই ম্যানুয়েলের আর একটি গুরুত্বপূর্ন দিক হল সিমুলেশন পদ্ধতিতে পাঠ দান। সিমুলেশন শব্দের অর্থ ভান করা। অর্থাৎ প্রশিক্ষণার্থীদের নিকট থেকে একজন প্রশিক্ষনার্থী শিক্ষক হিসেবে এবং বাকী প্রশিক্ষনার্থীরা শিক্ষার্থীর ভূমিকায় অবতীর্ন হয়ে বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক যেভাবে শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ নেন ঠিক সেভাবে প্রকৃতিপ্রাপ্ত সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে শ্রেণিকার্যক্রমে অংশগ্রহন করবেন। দুইজন প্রশিক্ষনার্থী পরিদর্শকের ভূমিকায় অংশ নেবেন এবং এ শ্রেণি কার্যক্রমের সবল ও দূর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করে কিভাবে এ শ্রেণিকার্যক্রমকে আরো উন্নত করা যায় সেক্ষেত্রে তাঁরা প্রয়োজনীয় মতামত প্রকাশ করবেন।
এভাবে পর্যায়ক্রমে প্রত্যেক প্রশিক্ষনার্থী শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ নেবেন। এই শ্রেণি কার্যক্রম পর্যবেক্ষন করতে গিয়ে একজন মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে আমি দেখেছি প্রথম প্রথম অনেক শিক্ষক মেধাবী হওয়া সত্তে¡ও পর্যাপ্ত শিখন শেখানো কার্যবলীতে অনভিজ্ঞতার কারণে তিনি তাঁর পাঠদান প্রক্রিয়াকে শিক্ষার্থীদের কাছে সঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করাতে পারছেন না। কিন্তু ম্যানুয়েলের প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনার আলোকে প্রথম দুই একজন প্রশিক্ষনার্থীর শ্রেণী কার্যক্রম অনুসরণ করে বাকীরা যখন পর্যায়ক্রমে শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ নেন তখন কেমন যেন মনে হয় এক যাদুকরী শক্তির ছোঁয়ায় তাঁদের শ্রেণি কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের কাছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও আনন্দময় হয়ে শিখন শেখানো কার্যবলীতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের নতুন দিক উন্মোচিত হচ্ছে। এই নতুন দিকের সন্ধান শিক্ষক শিক্ষার্থীর মধ্যে একটি সেতু বন্ধন সৃষ্টির মাধ্যমে আগামী প্রজন্ম একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় টিকে থাকতে পারবে এটি আমি দৃঢ় বিশ্বাস রাখি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সেসিপের অর্থায়নে সারাদেশে জাতীয় কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আমাদের চট্টগ্রামেও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা চট্টগ্রাম অঞ্চলের মাননীয় পরিচালক ও বিশিষ্ট শিক্ষক বন্ধু মান্যবর প্রফেসর প্রদীপ চক্রবর্ত্তী মহোদয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে, প্রশিক্ষন সমন্বয়ক ও মাননীয় উপ-পরিচালক বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক ড. গাজী গোলাম মওলা স্যারের দক্ষ সমন্বয়ে এবং মাননীয় সহকারি পরিচালক জনাব মোশাররফ হোসেন স্যারের অক্লান্ত পরিশ্রম ও জনাব সাজেদা আক্তার লিলি ম্যাডাম, জনাব কামরুন্নাহার বিউটি ম্যাডাম ও সর্বোপরি আমার কক্ষের দুইজন মাস্টার ট্রেইনার যথাক্রমে জনাব মো: তৈয়ব স্যার ও জনাব সুজন চাকমা স্যারের সহযোগিতায় এই প্রশিক্ষনের গুরুত্বপূর্ন দিকগুলো যদি একজন শিক্ষক স্ব স্ব বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীদের জীবনে বাস্তব প্রতিফলন ঘটান তখন ঐ শিক্ষার্থী এদেশের একজন দক্ষ মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে ওঠে ২০৩০ সাল নাগাদ আমাদের এসডিজি অর্জনের যে স্বপ্ন তা বাস্তবে পূরণ হবে আমি আপনাদের কাছে এই প্রত্যাশা করছি। পরিশেষে বিজ্ঞান শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত এই প্রশিক্ষণ সারাদেশ ব্যাপী আয়োজনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় সহ সেসিপের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।