টেকসই উন্নয়নে চাই মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা

68

শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি ততই উন্নত। তাই একটা জাতিকে উন্নত হতে হলে সুশিক্ষাই শিক্ষিত হতে হবে। শিক্ষা বলতে বুঝায় মানুষের আচরণের কাক্সিক্ষত পরিবর্তন। ব্যাপক অর্থে শিক্ষা হচ্ছে সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন। সক্রেটিসের ভাষায়“শিক্ষা হলো মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ। সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই শিক্ষা। আর এই কঠিন কাজটি যিনি করেন তিনি হলেন শিক্ষক। বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে অবশ্যই মানসম্মত শিক্ষা অর্জনের জন্য সরকারের পাশাপাশি শিক্ষার সাথে জড়িত সংশ্লিষ্ট সবাইকে কার্যকারী পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে। বর্তমানে সরকার গুনগত ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। প্রাথমিক শিক্ষাই হলো জাতি গঠনের মূল ভিত্তি। তাই মান সম্মত শিক্ষা। বাস্তবায়ন করতে হলে প্রাথমিক শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষাকে মানসম্মত ও গুনগত পর্যায়ে নিতে হলে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে কিছু কার্যক্রম গ্রহন এবং বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার বয়সমীমা পাঁচ বছর থেকে এগারো বছর পর্যন্ত। বিদ্যালয়ের পাঠদান সময়সূচি ৯.১৫মি. থেকে ৪.১৫ মিনিট পর্যন্ত হওয়ায় শিশু শিক্ষার্থীরা ক্ষুধার তাড়নায় শ্রেণিকক্ষে মনোযোগী হতে পারে না এবং সর্বোপরি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে ফলে তারা বিদ্যালয় বিমুখ হয়ে যায় এবং প্রাথমিক শিক্ষাচক্র সমাপ্ত করার পূর্বেই ঝরে পড়ে। তাই শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ক্ষুধার তাড়নায় কোন শিক্ষার্থী যাতে বিদ্যালয় থেকে পালিয়ে না যায় এবং শ্রেণিকক্ষে অমনোযোগী হয়ে না পড়ে সে জন্য স্থানীয় বিত্তবান ব্যক্তিবর্গের আর্থিক সহযোগিতায় শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবার তথা মিড ডে মিল বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। বিদ্যালয়ের সময়সূচি পরিবর্তন করা গেলে ঝরে পড়া অনেকটা কমে যাবে। বিকাল ৪.১৫ মিনিটের পরিবর্তে ২.৩০ মিনিট অথবা ৩. ০০ টা পর্যন্ত করা যেতে পারে। গতানুগতিক পাঠদানে পরিবর্তে শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ব্যবহার করা প্রয়োজন। কারণ দেখা এবং শুনার মাধ্যমে যে শিখন তার স্থায়িত্ব বেশি হয়। সেই ক্ষেত্রে মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করলে শিশুরা মনোযোগী থাকে,তাদের শিখন স্থায়ী হয় এবং সর্বোপরি পাঠদান ফলপ্রসূ হবে। সরকার প্রায় প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইতিমধে ল্যাপটপ,প্রজেক্টর,স্ক্রীন সরবরাহ করেছে যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বিদ্যালয়ের প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে প্রজেক্টর স্থাপন করে পাঠদান করতে পারলে শিশু শিক্ষার্থীরা শ্রেণি কার্যক্রমে আগ্রহী হবে এবং প্রাথমিক শিক্ষার দ্রæত মানোন্নয়ন ঘটবে। বিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষককে আইসিটি প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে যেন তারা ডিজিটাল কন্টেন্ট প্রস্তুত ও ব্যবহার করে পাঠদান করতে পারে।
সরকার ইতিমধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উন্নয়ন প্রকল্পে উপবৃত্তি প্রকল্প পঁঞ্চাশ ভাগ থেকে শত ভাগে উন্নীত করায় এবং পৌরসভা ও সিটিকর্পোরেশনকে উপবৃত্তির আওতায় অন্তর্ভুক্ত করায় শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া উল্লেখযোগ্যহারে কমেছে, সেই সাথে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও বৃদ্ধি পেয়েছে সর্বোপরি প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটেছে। এরপর দুর্গম ,চর,হাওড়,পার্বত্য অঞ্চল,নদী ভাঙ্গন এলাকায় পিছিয়েপড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ নিরাময়মূলক ব্যবস্থা গ্রহন করা প্রয়োজন। প্রাথমিক বিদ্যালয় সমূহকে শিশুবান্ধব করে গড়ে তোলার জন্য নতুনত্ব বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া প্রয়োজন। সরকারি বরাদ্দের পাশাপাশি স্থানীয় অংশীজনের এবং বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সহায়তা নিয়ে প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ¯িøপার,দোলনা,ভারসাম্য স্থাপন,খেলনা এবং খেলাধুলার বিভিন্নসামগ্রী ও উপকরণ সরবরাহ করা প্রয়োজন। বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ সংস্কার করে খেলাধুলার উপযোগী করা,বিদ্যালয়গৃহ আকর্ষণীয়ভাবে সজ্জিতকরণ বিশেষকরে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিকক্ষটি আকর্ষণীয় ও বর্ণিল সাজে সজ্জিত করা প্রয়োজন যাতে শিশুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়। বর্তমানে শিশু শ্রেণিতে পাঁচ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরদের পাঠদান করা হয়। চার বছর বয়সী শিশুদের নিয়ে বিদ্যালয়ে নার্সারি শ্রেণি চালু করা যেতে পারে। স্থানীয় জনগণ জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে প্রাথমিক শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট করে এবং প্রয়োজনে তাদের সহযোগিতা নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিভিন্ন উদ্বুদ্ধকরণ সভা তথা মা ও অভিভাবক সমাবেশ,উঠান বৈঠক,কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা ও মেধা পুরস্কার ইত্যাদি আয়োজন করা প্রয়োজন।
গুণগত ও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের ফলে গড়ে উঠবে দক্ষ ও যোগ্য জনশক্তি এবং তাদের মাধ্যমে উন্নত ও সমৃদ্ধ হবে আমাদের এই দেশ। এই হোক সবার স্বপ্ন ও প্রত্যাশা।

লেখক: সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার
সীতাকুন্ড, চট্টগ্রাম