টার্গেট কোরবানির পশুর হাট সক্রিয় জালনোট চক্র

70

কোরবানির পশুর হাটকে টার্গেট করে জালনোট চক্রের সদস্যরা ছড়িয়ে পড়েছে নগরী ও গ্রামে। প্রতিটি হাটেই তাদের আসা যাওয়া। সুযোগ বুঝেই জালনোট কাজে লাগায় তারা। গত ১৫ দিনে ২০ লক্ষ টাকার জাল নোট উদ্ধার ও ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। সর্বশেষ গতকাল ফটিকছড়ি থেকে এ চক্রের এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এবারের ঈদে অর্ধশত কোটি টাকা বাজারে ছাড়ার টার্গেট নিয়েছে বলে স্বীকার করেছে গ্রেপ্তারকৃতরা।
এদিকে জালনোট তৈরি ও বাজারজাতরোধে মাঠে তৎপর রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিশেষ করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র‌্যাব) এই বিষয়ে তৎপর রয়েছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিটি পশুরহাটে জাল নোট চিহ্নিতকরণে বুথ বসানোর জন্য তফসিলি ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে।
গত ১৫ দিনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৫ জনকে। তাদের মধ্যে রয়েছেন আমিনুর রহমান, মনিরুল ইসলাম, মহসিন মোল্লা, সাহেদুল আলম, খান মিয়া, শামসুল আলম, দুলাল মিয়া, সাজু খান। এ চক্রের দলনেতা খান বলে জানিয়েছে গ্রেপ্তারকৃতরা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতি বছর দুই ঈদে জালনোট চক্র সক্রিয় হয়ে উঠে। সারাদেশে জাল বিস্তার করে তারা। এবারের কোরবানির ঈদও এর ব্যতিক্রম নয়। ঈদকে কেন্দ্র করে জালনোট তৈরিতে মেতে উঠেছে একাধিক অপরাধী চক্র। প্রতারণার মাধ্যমে টাকা লুটে নিতে কোটি কোটি টাকার জালনোট তৈরি করে বাজার রমরমা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তারা।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গ্রেপ্তারকৃতরা জানিয়েছে, দেশজুড়ে তাদের ১০ থেকে ১৫টি চক্র রয়েছে। মূল চক্র ঢাকা ও চট্টগ্রামে। একটি চক্র ঢাকায় জালনোট তৈরি করে চট্টগ্রামে পাঠায়। অপর একটি চক্র সরাসরি চট্টগ্রামেই তৈরি করে। তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দু’শতাধিক বাজারজাতকারী। তারা কৌশলে বাজারে জাল নোট সরবরাহ করে। এর বিনিময়ে কমিশন পায়।
গ্রেপ্তারকৃতরা পুলিশকে জানিয়েছে, দু’ভাবে তাদের হাতে জাল নোট আসে। প্রথমত ঢাকা থেকে, দ্বিতীয়ত চট্টগ্রামেই তৈরি হয়। তারা ৫শ ও ১ হাজার টাকার জাল নোট তৈরি করতে একাধিক কারখানা গড়ে তুলেছে। তৈরি করার সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে কম্পিউটার বা লেপটপ, দামি কাগজ, প্রিন্টার মেশিন। আসল নোট থেকে ছাপ দিয়ে হুবহু জাল নোট তৈরি করে তারা।
প্রশাসনের তথ্যমতে, এ কারবারে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হলেও ৮০ শতাংশই জামিনে মুক্তি পেয়ে পরবর্তী সময়ে আবারও নিয়োজিত হচ্ছে জাল নোটের ব্যবসায়। ঈদ এলেই তাদের সিন্ডিকেট সারাদেশে সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিভিন্নভাগে বিভক্ত হয়ে জাল নোটের কারবার করছে বেশ কিছু অসাধু চক্র।
জেলা পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা বলেন, জাল নোট চক্র যাতে বাজারে কোনভাবেই জাল নোট ছড়াতে না পারে, সেজন্য নজরদারি রয়েছে। প্রতিটি পশুরহাটে পুলিশ নজরদারি করবে।
পুলিশ সূত্র ও অনুসন্ধানে জানা যায়, মূল হোতাদের কাছ থেকে ৬০ ভাগ কমিশনে জাল নোট কিনে নেয় চক্রটি। অর্থাৎ মূল চক্রের কাছ থেকে ৫শ টাকার নোট ২শ টাকায় ও ১ হাজার টাকার জাল নোট বিক্রি হয় ৩শ টাকায় কিনে নেয় তারা।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মোস্তাইন হোসাইন বলেন, জাল নোট চক্রকে ধরতে আমরা জাল বিস্তার করেছি। ঈদে চক্রটি সক্রিয় হয়ে উঠে। এবারও যে সক্রিয় হয়েছে, তার খবর আমাদের কাছে রয়েছে। গোয়েন্দারা সতর্ক রয়েছে। বাজারেও গোয়েন্দারা আছে। নজর রাখছে ক্রেতা বিক্রেতার ওপর। এরই মধ্যে কয়েকজনকে ধরা হয়েছে। চক্রের সন্ধানও মিলেছে।
জানা যায়, জাল টাকা ব্যবসায়ী চক্রের প্রত্যেকেই পেশাদার। তারা একদিকে জাল টাকার নোট তৈরি করে, অন্যদিকে জাল টাকার ব্যবসাও করে। ওসব চক্রের অনেক সদস্যই এই ব্যবসার সঙ্গে অনেক বছর ধরে জড়িত। তারা নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে জাল টাকা তৈরি করে। ধরা পড়ার ভয়ে তারা এক বাসায় বেশি দিন থাকে না। কয়েক মাস পর পর তারা বাসা বদলে চলে যায় অন্য এলাকায়। সেখানেই গড়ে তোলে জাল টাকা তৈরির কারখানা। সিন্ডিকেটে নারী সদস্যও রয়েছে। প্রতিটি স্তরেই সিন্ডিকেটের মহিলা সদস্য রয়েছে। কখনো গৃহিণী, কখনো কলেজছাত্রী সেজে জাল টাকা বহন করে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিচ্ছে তারা। আবার তাদের মাধ্যমেই পণ্য কেনাকাটা করে মার্কেটে জাল টাকার বিস্তার ঘটানো হয়। সেজন্য তাদের দেয়া হয় মোটা অঙ্কের কমিশন। ধরা পড়লে তাদের আইনি সহায়তাও দেওয়া হয়।
এদিকে কোরবানির পশুর হাটসমূহে (উপজেলা সদর পর্যন্ত) জাল নোট চক্রের অপতৎপরতা রোধে জাল নোট শনাক্তকরণ বুথ স্থাপনে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণে তফসিলি ব্যাংককে নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, জাল নোট শনাক্তকারী মেশিনের সহায়তায় অভিজ্ঞ ক্যাশ কর্মকর্তারা হাট শুরুর দিন থেকে ঈদের পূর্বরাত পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে পশু ব্যবসায়ীদেরকে বিনা খরচে নোট যাচাই সংক্রান্ত সেবা প্রদান করবেন।
এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিস নেই এমন জেলাসমূহের সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও থানা/উপজেলার অনুমোদিত পশুর হাটে বিভিন্ন ব্যাংকের দায়িত্ব বন্টনের জন্য সোনালী ব্যাংক লি. এর চেস্ট শাখাগুলো দায়িত্ব পালন করবে।
বুথে নোট যাচাইকালে কোন জালনোট ধরা পড়লে সেক্ষেত্রে পরিপত্র (পলিসি) অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, বুথে ব্যাংকের নাম ও তার সাথে ‘জাল নোট শনাক্তকরণ বুথ’ উল্লেখপূর্বক ব্যানার/নোটিশ প্রদর্শন করা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি সম্বলিত ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার ব্যাংক নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য সম্বলিত পোস্টার প্রদর্শনসহ বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দেওয়া হয়।