টানা বর্ষণে ডুবল নগরী

155

টানা ভারিবর্ষণে পানিতে তলিয়ে গেছে নগরী। কোথাও হাঁটু, আবার কোথাও কোমর পানিতে সয়লাব। হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বাড়ি-ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও পানি প্রবেশ করেছে। কোনো কোনো সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তার উপর গণপরিবহনের তীব্র সংকটে নাকাল নগরবাসী। চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস বন্ধ হয়ে যায়। আবহাওয়া দপ্তর বলছে, আজ মঙ্গলবারও ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকবে।
এদিকে, নগরবাসীর দুর্ভোগের তালিকার শীর্ষ পর্যায়ে উঠে আসা জলাবদ্ধতাকে চিরতরে নির্বাসনে পাঠানোর মহাস্বপ্ন দেখিয়ে নগর উন্নয়ন সংস্থা সিডিএ কয়েক হাজার কোটি টাকার মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ অব্যাহত রাখলেও তার কোনও সুফল বা দৃশ্যমান কার্যকারিতা নেই বলেই মনে করছেন নগর বিশেষজ্ঞরা। সংস্থাটির বিদায়ী চেয়ারম্যান অতি-উৎসাহী হয়ে এ প্রকল্প নিলেও তা বাস্তবায়নের জন্য নিজস্ব কারিগরি দক্ষতা ও সক্ষমতা কোনোটাই আসলে সংস্থাটির নেই। তাই বিগত সময়ে মতই চলতি বর্ষা মৌসুমের প্রথম ভারি বর্ষণেই নগরবাসীকে জলাবদ্ধতায় নাকানি-চুবানি খেতে হয়েছে। মৌসুমের বাকি দিনগুলোকে নিয়ে ভুক্তভোগীদের মনে রীতিমত আতঙ্ক ভর করেছে।
গত রবিবার দিনের বেলায় কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি আবার কখনো ভারিবর্ষণ হলেও রাতে ভারিবর্ষণ হতে থাকে। এ বর্ষণ যেন আর থামে না। বর্ষণের কারণে রবিবার রাত থেকেই নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পানি উঠতে শুরু করে। গতকাল সোমবার দুপুরের মধ্যে আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, বাদুরতলা, প্রবর্তক মোড়, দুই নম্বর গেট, অলঙ্কার, পাহাড়তলি রোড, বাকলিয়া, চকবাজার, মেহেদীবাগ, মেহেদিবাগ, অক্সিজেন মোড়, মুরাদপুর, ২ নম্বর গেট, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা, বহদ্দারহাট, বাদুরতলা, পাঁচলাইশ, শুলকবহর, কাপাসগোলা, কাতালগঞ্জ, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, বাকলিয়া, হালিশহরসহ নগরীর বড় অংশজুড়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও হাঁটু পানি, আবার কোথাও কোমর পানিতে তলিয়ে গেছে নগরীর মূল সড়ক ও অলিগলি। এ সময় নগরীর বিভিন্ন অলিগলিতে পানি ঢুকে পড়েছে। তিন পোলের মাথা, হেমসেন লেন, জামালখান বাই লেনসহ বিভিন্ন এলাকায় কোমর সমান পানি দেখা গেছে। এনায়েত বাজার ও রাইফেল ক্লাব সংলগ্ন এলাকায় অপর্ণাচরণ স্কুল সংলগ্ন এলাকায় নালার পানি উপচে মূল সড়কে বইছে।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ প্রদীপ কান্তি নাথ গতকাল সোমবার রাতে পূর্বদেশকে জানান, বৃহস্পতিবার থেকে সোমবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত গত পাঁচদিনে ২৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে চট্টগ্রামে। আর মাঝারি থেকে ভারি আকারে টানা বৃষ্টি শুরু পর সোমবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ১৩৬ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রামে। আজ মঙ্গলবারও ভারিবর্ষণ অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান।
সরেজমিনে দেখা যায়, ষোলশহর দু’নম্বর গেট থেকে জিইসি হয়ে লালখান বাজার, আগ্রাবাদ সড়কটি পানিতে তলিয়ে যায়। আগ্রাবাদ বাদামতল থেকে বড় পোল পর্যন্ত এক্সেস রোডটি কোমর পানিতে ডুবে গেছে। এ সড়ক দিয়ে হালকা যানবাহন এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায়। হালিশহর পোর্ট কানেক্টিং সড়কেও হাঁটু পানিতে তলিয়ে যায়। এক্সেস রোডের আশেপাশে আবাসিক এলাকাগুলোতেও পানি প্রবেশ করতে দেখা গেছে।
আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। মূল সড়কসহ আবাসিকের প্রতিটি গলিই হাঁটু থেকে কোমর পানিতে ডুবে যায়। ওই এলাকায় বসবাসকারিরা ঘর থেকে বের হতে পারেননি। ষোলশহর দু’নম্বর গেট থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত সড়কেরও একই অবস্থা দেখা গেছে। রাস্তার উপর হাঁটু পানি। এ সড়কে যানবাহন চলাচল করেছে খুবই ধীরগতিতে।
বিমানবন্দর সড়কটি চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। বন্দরটিলা থেকে রেল ক্রসিং পর্যন্ত রাস্তায় ছিল হাঁটু পানি। সেখান থেকে চিচাগাং সিমেন্ট সড়ক কোমর পানিতে তলিয়ে যায়। বিমান যাত্রীরা খুব কষ্ট করেই রাস্তাটি পার হয়েছেন।
বন্দরটিরা নিবাসি নগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য রোটারিয়ান মো. ইলিয়াছ জানান, বিমান বন্দর সড়কটি ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। পুরো সড়কটি পানিতে ডুবে গেছে। অনেক কষ্টে লোকজন চলাচল করেছে। অনেকক্ষণ যান চলাচলও বন্ধ ছিল।
অক্সিজেন মোড়ও ডুবে যায় পানিতে। কোমর পানিতে ডুবন্ত রয়েছে মোড়টি। উত্তর চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খাগড়াছড়িগামী বাস চলাচল করেছে খুব কম। প্রবর্তক মোড় এলাকা কোমর পানিতে তলিয়ে যায়। ওই সড়ক দিয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ ছিল। ভারি বৃষ্টি আর জলাবদ্ধতায় কার্যত অচল হয়ে পড়ে বন্দরনগরী। সকাল থেকে জলমগ্ন রাস্তায় যানবাহন কম থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েন অফিসগামী মানুষ এবং শিক্ষার্থীরা। পাহাড়তলি বাজার সড়ক, ঈদগাঁও সড়ক ও ডিটি রোডের কিছু এলাকা পানি জমে যাওয়ায় বেলা দেড়টা পর্যন্ত যানজটে পুরো সড়ক অচল হয়ে যায়।
টানা বৃষ্টিতে বিভিন্ন সড়কে পানি জমে গিয়ে যানবাহন চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। মূল সড়কগুলোতে যানজট তৈরি হয়। পানি ঢুকে পড়েছে বাসা-দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অফিস, কাঁচাবাজারেও।
কয়েকটি আবাসিক এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে। সেখানে বাসা বাড়িতে পানি প্রবেশ করায় জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে। অনেকে ঘরের খাটের উপর অবস্থান নেন। আবার ানেকে দোতালায় চলে যান। বাকলিয়ায় প্রায় ঘরেই পানি প্রবেশ করেছে।
কোতোয়ালী থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জসহ বাকলিয়া এলাকার অধিকাংশ স্থানেই পানি উঠেছে। বাড়ি ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অনেকের মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। পানিতে ভাসতে দেখা গেছে চকবাজার কাঁচাবাজারের দোকানপাট। একইভাবে নগরীর বিভিন্ন মার্কেটের নিচতলায় পানি ঢুকে পড়েছে।
নগরীর মুরাদপুর থেকে লালখানবাজার পর্যন্ত আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে হাঁটু পরিমাণ পানি জমে যায়। বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি নিয়ে ফ্লাইওভার অতিক্রম করতে গিয়ে অনেকে দুর্ভোগে পড়েছেন।
সরকারী হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ সংলগ্ন পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি পুরনো ও ঝুঁকির্পূণ রিটেইনিং দেয়াল বেয়ে চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নীচতলার শ্রেণি কক্ষে ঢুকে পড়ে। ফলে শিক্ষার্থীদের পাঠদান ব্যাহত হয়। বিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন-১ অর্থ্যাৎ প্রধান শিক্ষকের কার্যালয়ের নীচ তলার শ্রেণি কক্ষগুলোতে প্রবেশ করে। এতে করে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে ভোগান্তি পোহাতে হয়। পাশাপাশি নীচ তলার শ্রেণিকক্ষে বৃষ্টির পানি জমে থাকায় শিক্ষার্থীদের ক্লাস করানো সম্ভব হয়না।
গতকাল সোমবার সকাল থেকে ভারি বৃষ্টিপাত হওয়ায় কলেজ সংলগ্ন পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি রিটেইনিং দেয়াল বেয়ে বিদ্যালয়ের নীচ তলার শ্রেণি কক্ষে প্রবেশ করে। বৃষ্টির কারণে যে কোন মুহুর্তে পাহাড়টি ধসে পড়ে বিদ্যালয়ের রিটেইনিং দেয়ালটি ভেঙে পড়তে পারে।
ভারিবৃষ্টির কারণে নগরীর বিভিন্ন সড়কে যান চলাচলে চরম ব্যাঘাত ঘটে। বিশেষ করে কাপ্তাই রাস্তার মাথা, বদ্দারহাট থেকে মুরাদপুর, শুলকবহর এলাকা, দুই নম্বর গেট এলাকা, অক্সিজেন মোড়, বাদশা মিয়া পেট্রোল পাম্প, জিইসি মোড় থেকে খুলশী, শিল্পকলা এলাকায় মোহাম্মদ আলী রোড, ওয়ারলেস গেট মুরগি ফার্ম, প্রবর্তক মোড়, চকবাজার গুলজার মোড়, ডিসি রোড, নউ মার্কেট থেকে আমতলা, নিউ মার্কেট থেকে বিআরটিসি মোড়,, চৌমুহনী থেকে কদমতলী মোড়, আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড় থেকে এক্সেস রোড, সদরঘাট মোড়, সল্টগোলা ক্রসিং মোড়, ইপিজেড থেকে বন্দরটিলা, মনসুরাবাদ পুলিশ লাইন এলাকার সামনে সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে। এতে যানজট সৃষ্টি হয়েছে। লোকজন ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও গণপরিবহন পাননি।
সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি শৈবাল দাশ সুমন জানান, অধিকাংশ এলাকায় হাঁটু পরিমাণ পানি হয়েছে। প্রবর্তক-কাপাসগোলার দিকে কোমর সমান পানি হয়েছে। কয়েকটি এলাকা থেকে দেওয়াল ও গাছপালা ভেঙে পড়ার খবর পেয়েছি। আমাদের সিটি করপোরেশনের টিম মাঠে কাজ করছে। সড়কে গাড়ি চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। কোথাও কোথাও যানজট সৃষ্টি হয়েছে। ফ্লাইওভারের ওপর পানি উঠে গেছে। ফ্লাইওভার দিয়ে গাড়ি চলতে পারছে না।
সিডিএ’র জলাবদ্দতা নিরসনকল্পে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের পরিচালক আহমেদ মঈনুদ্দিন জানিয়েছেন, জলবাবদ্ধতা কমাতে সেনাবাহিনীর পাঁচটি রেসপন্স টিম মাঠে কাজ করেছে। প্রবর্তক মোড়, দুই নম্বর গেটসহ বিভিন্ন এলাকায় যেখানে বেশি পানি সেখানে এর কারণ বের করে তা সমাধানে তারা কাজ করেছেন।
বৃষ্টির কারণে বঙ্গোপসাগরে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে বড় জাহাজ থেকে লাইটারেজ জাহাজে আমদানি পণ্য খালাস বন্ধ ছিল। এছাড়া পণ্য নিয়ে নৌপথে গন্তব্যেও যেতে পারেনি কোনো লাইটারেজ জাহাজ। ফলে প্রায় ৪০০ লাইটারেজ জাহাজ কর্ণফুলী নদীতে অলস সময় কাটিয়েছে।