জ্ঞান মুসলমানদের হারানো সম্পদ

228

 

মুসলমানদের প্রত্যেক ফরজের শুরু হয় বাগেল হওয়ার পর হতে। সুন্নাতের জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত সঙ্গি থাকে। নবজাতক শিশুর আজান-ইকামত, নাম রাখা, আকিকা করা, চুল কেটে ওজন করে স্বর্ণ বা রুপা দান করা সবই সুন্নাত। মৃত্যুর পর দাফন কাফন জিয়ারত সবই সুন্নাত। কিন্তু একটি ফরজের যাত্রা শুরু হয় দোলনা হতেই। তা হলো ‘জ্ঞান’। মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, উতলুবুল ইলমা মিনাল মাহদি ইলাল লাহাদ’ অর্থাৎ দোলনা হতে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন কর।
সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে করেছে বাধ্যতামূলক। ১৪শ’ বছর পূর্বে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন, ‘তলবুল ইলমা ফরিদাতুন আলা কুল্লে মুসলেমুন ওয়া মোসলেমাত’। অর্থাৎ প্রত্যেক মুসলমান ‘নর এবং নারীর জন্য জ্ঞান অর্জন ফরজ। ‘মুসলেমুন’ (মুসলমান) শব্দটি দ্বারা নারী-পুরুষ সবাইকে বুঝায়, কিন্তু কোন অল্প শিক্ষিত মৌলভী যাদের সম্পর্কে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমপারা পড়া, হামববা মোরা’ তারা যদি এসে ফতোয়া দিয়ে দেয় ‘মুসলমান’ শব্দটি দ্বারা পুরুষ মানুষ বুঝিয়েছেন, তাই হাদিসে ‘ওয়া মুসলেমাত’ (মুসলমান নারী) শব্দ উচ্চারণ করেছেন। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তির যুগে এসে কেউ কেউ বলে, নারীদের বেশি শিক্ষা দরকার নেই। কয়েক ক্লাস পড়লে চলবে। তাদের উদ্দেশ্যে আমি বলতে চাই, একটা নারীর অপারেশন পুরুষ ডাক্তার দিয়ে করা শরীয়তের দৃষ্টি কীভাবে সম্ভব।
পৃথিবীর সেরা ম্যাগাজিন ‘টাইম’ প্রচ্ছদ করেছে, একুশ শতকের সম্পদ কী ? একুশ শতকের সম্পদ স্বর্ণের খনি নয়, ডায়মন্ডের খনি নয়, বিমান গাড়ির ফ্যাক্টরী নয়, একুশ শতকের সম্পদ হলো ‘জ্ঞান’। যে জাতির নিকট জ্ঞান থাকবে সে জাতি একুশ শতকে পৃথিবী নামক গ্রহটির নেতৃত্ব দিবে। এটি আধুনিক দুনিয়ার জন্য নতুন কথা মনে হতে পারে, কিন্তু কথাটি প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১৪শ’ বছর পূর্বে ইরশাদ করেছেন, ‘জ্ঞানের চেয়ে বড় কোন সম্পদ নেই, মূর্খতার চেয়ে বড় কোন দরিদ্রতা নেই’।
নবুয়তের পর জ্ঞানের চেয়ে বড় সম্মানের আর কিছুই নেই। আলেমগণ নবীগণের ওয়ারিশ। নবী-রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পদের উত্তরাধিকার রেখে যান না, তারা রেখে যান জ্ঞানের উত্তরাধিকার। সে জ্ঞান অন্বেষণ কারীর অনেক মর্যাদার বর্ণনা হাদিস শরীফে বর্ণনা আছে। মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জনের পথে বের হয় আল্লাহ পাক তাকে জান্নাতের পথে চালিত করেন। জ্ঞান অন্বেষণকারীর প্রতি খুশি হয়ে ফেরেস্তারা জ্ঞান বিছিয়ে দেন। আর আল্লাহর দরবারে জ্ঞান অন্বেষণকারীর জন্য নবমন্ডল ও ভূমন্ডলের সবকিছু তাঁর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
জ্ঞান অর্জনকারী ডুবুরির মুক্তা খোঁজার চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। ডুমুরি মুক্তা খোঁজে মৌসুমে আজ আঁজলা ভরে গেলে জলের অতলে ডুব দিতে হয় না। জ্ঞান অনুসন্ধানকারীর মৌসুম নেই, তাঁর আজলার সীমা নেই, তাঁর স্বাদের তৃপ্তির সীমা নেই। এই স্বাদ অন্য কোন স্বাদ দ্বারা তৃপ্তি আসে না।
মানব জাতিকে ফেরেস্তাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে জ্ঞানের কারণে। মহান আল্লাহ পাক সমস্ত বস্তু ফেরেস্তাদের সামনে পেশ করে সেসব বস্তুর নাম বলার জন্য নির্দেশ দেয়। অজ্ঞতার কারণে ফেরেস্তারা অক্ষমতা প্রকাশ করেন। হযরত আদম (আ.)কে এসব বস্তুর নাম বলতে বলা হলে তিনি সুস্পষ্টভাবে সব বস্তুর নাম বলেদেন। জ্ঞানের প্রতিযোগিতায় ফেরেস্তারা পরাজিত হয়। তাই সাথে সাথে মহান আল্লাহপাক আদম (আ.) সেজদা করতে ফেরেস্তাদের প্রতি নির্দেশ দেন। এই সেজদা ছিল মূলত জ্ঞানকে, মানুষকে নয়। জ্ঞানের মর্যাদা এত বেশি। জ্ঞান লোকের মর্যাদা মহান আল্লাহ পাক নিজেই বাড়িয়ে দিয়েছেন। দুনিয়ার কেউ কমাতে পারবে না। পবিত্র কোরআনের ঘোষণা, ‘ইয়ারফাউল্লা হুল্লাজিনা আমানু মিনকুম ওয়াল্লাজিনা উতুল ইলমা দারাজাত’। অর্থাৎ আল্লাহ তাদের সম্মান বাড়িয়ে দিয়েছেন, যারা বিশ্বাসী এবং জ্ঞানী।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক আরো ঘোষণা করেছেন, ‘মান কানা ফি হাজেহী আম্মা ফাহুয়া ফিল আখেরাতে আম্মা’ যে ব্যক্তি এই দুনিয়াতে অন্ধ থাকবে’ পরকালেও সে অন্ধ থাকবে’। জ্ঞানীরা দুনিয়াতেও আলোকিত এবং আখেরাতেও আলোকিত থাকবে। হযরত মাওলা আলী (রা.) ইরশাদ করেছেন, মূর্খ লোক জীবিত থাকতে মৃত আর জ্ঞানী লোক মৃত্যুর পরও জীবিত থাকবে। যখন কোন কোন ধর্ম সাধারণ মানুষের জন্য জ্ঞান অর্জন নিষিদ্ধ করেছিল, শিক্ষা শুধু ধর্মগুরুদের জন্য নির্ধারিত ছিল। জ্ঞান অর্জন মুচি সুচি, চামার কুমুর জেলে দাস সকলের জন্য কর্তব্য। সম্মিলিত জাতীয় সম্পদ ‘জ্ঞান’ সমগ্র জাতি সম্মিলিত ভাবে অর্জন করে পুরো জাতিকে এগিয়ে নাও। এতদিন ধরে মূর্খদের ঠকিয়ে বিদ্যানদের করা ব্যবসায় তালা লাগিয়ে দিলেন মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি তাঁর উম্মতের উদ্দেশ্যে একটি কথা গুরুত্বের সাথে বলতেন, তাহলো, ‘হে আমার উম্মত। জ্ঞান হলো তোমাদের হারানো সম্পদ। যেখানে পাবে তা কুড়িয়ে নেবে। এই সম্পদ যদি কুড়ানোর জন্য চীন দেশও যেতে হয় সেখানে যাও’।
কোন ধর্মের প্রথম কথা ‘ইকরা’ (পড়) নেই, ইসলাম ধর্মের প্রথম কথা ‘ইকরা’ (পড়)। প্রথম নাজিলকৃত কোরআনের পাঁচটি আয়াত ইতিহাসের নয়, ফতোয়ার নয়, বিধি-বিধানের নয়, এসব আয়াত জ্ঞান-বিজ্ঞানের। পৃথিবীর কোন ধর্মমতের প্রধান গ্রন্থের নাম অধ্যয়ন নেই, কোরআন শব্দের অর্থ অধ্যয়ন। ‘ক্বেরাত’ অর্থ অধ্যয়ন, ‘তেলোওয়াত’ অধ্যয়ন। মানুষ শপথ গ্রহণ করে প্রতিজ্ঞা ও সত্যতা প্রমাণের জন্য। মহান আল্লাহ পাক শপথ গ্রহণ করেন মর্যাদাবৃদ্ধি করে দেওয়ার জন্য। মুসলিম শরীফের হাদিসে বর্ণনা আছে, পবিত্র কোরআনে একটি সূরা আছে যে সূরাটি পাঠ করলে দশ খতমের সওয়াব পাওয়া যায়, সেটি হল সূরা ‘ইয়াসিন’। মহান আল্লাহ পাক এই সূরার শুরুতেই শপথ গ্রহণ করেন, ‘ইয়াসিন ওয়াল কোরআনুর হাকিম’। অর্থাৎ বিজ্ঞানময় কোরআনের শপথ। মহান আল্লাহ পাক বিজ্ঞানময় কোরআনের শপথ গ্রহণ করে মর্যাদাবৃদ্ধি করলে ‘কলম’র শপথ গ্রহণ করলে তিনি পবিত্র কোরআনে। ইসলাম ধর্ম যে জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতি ব্যাপক গুরুত্বারোপ করেছেন সে জ্ঞান বিজ্ঞান আজ মুসলমানদের হাতে নেই। পৃথিবীর সেরা একশতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটিও ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে নেই। উন্নত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ৭ লক্ষ, ৮ লক্ষ, ১০ লক্ষ, ১২ লক্ষ হতে ১৭ লক্ষ পর্যন্ত বিজ্ঞানী আছে, অথচ ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্রে মাত্র আড়াই লক্ষ বিজ্ঞানী আছে। সত্যি আজ মুসলমানদের জন্য আধুনিক কালে মধ্যযুগ (অন্ধকার যুগ)। মুসলমানদের মুক্তি চাইলে জ্ঞানের পথে, আলোর পথে আসতেই হবে।

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক