জেলহত্যা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রকারী ও খুনিদের শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি

37

৩ নভেম্বর ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কময় জেলহত্যা দিবস। ৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর জাতির ইতিহাসে আরো একটি দুঃখজনক ও বিষাদের দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে বর্বর হত্যাকান্ডের শিকার হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সহচর ও মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী জাতীয় চার নেতা। সভ্য দুনিয়ায় এ ধরনের ঘটনার নজির নেই। সেদিন নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের শিকার হন স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান। বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী দখলদার চক্রান্তকারী অশুভ রাজনৈতিক শক্তির প্ররোচনায় কিছু সেনাসদস্য রাষ্ট্রের সুরক্ষিত স্থান হিসেবে বিবেচিত কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে এই হত্যাকান্ড ঘটায়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতায় জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করার সুপরিকল্পিত ও সুগভীর চক্রান্তের অংশ হিসেবেই এই হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছিল। আজ এ দিনে আমরা জাতীয় এ চার নেতার মৃত্যুতে গভীর শোক ও তাদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী দখলদার রাজনৈতিক শক্তির প্ররোচনায়ই যে কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে এই বর্বর হত্যাকাÐ ঘটানো হয়েছিল, তা বোঝা গিয়েছিল তখনকার ক্ষমতাসীনদের আচরণেই। তারা হত্যাকান্ডের বিচারের উদ্যোগ নেয়া তো দূরের কথা, আইন করে বিচারের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। হন্তারকদের বিশেষ ব্যবস্থায় বিদেশে নিরাপদ অবস্থানের ব্যবস্থা করে, কাউকে কাউকে মর্যাদাপূর্ণ চাকরি দিয়েও পুরস্কৃত করেছে পরবর্তী সরকারগুলো। হত্যাকাÐের দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী বিচারকাজ শুরু করে। পরবর্তী সময় বিচারকাজ নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে। ২৯ বছর পর ২০০৪-এর ২০ অক্টোবর অভিযুক্তদের মধ্যে পলাতক ৩ জনের ফাঁসি, জেলে অবস্থানরত ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও জামিনে মুক্তদের নির্দোষ ঘোষণা করে বিচারিক আদালত দায়সারা একটি রায় দেয়। রায়ে এত বড় একটি ঘটনায় ষড়যন্ত্রীদের শাস্তির আওতায় না আসাও জাতিকে বিস্মিত করে। পরে ডেথ রেফারেন্স ও রায়ের বিরুদ্ধে আসামি পক্ষের করা আপিলের শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত দুই আসামিকে বেকসুর খালাস এবং যাবজ্জীবন কারাদন্ডাদেশপ্রাপ্তদের মধ্যে চারজনকে দন্ড থেকে অব্যাহতি দেন। এ রায় জাতিকে আরো স্তম্ভিত ও মর্মাহত করে। আত্মস্বীকৃত মূল আসামিরা বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে এটা কারো কাছেই প্রত্যাশিত ছিল না। বিস্ময়করভাবে তখন রাষ্ট্রপক্ষ এ রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপিল করেনি। এরপর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রত্যাশিত আপিল দায়ের করা হয়। আপিল শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির বেঞ্চ ২০১৬ সালে ৩০ এপ্রিল রায় দেন। হাইকোর্টের রায়টি বাতিল করে বিচারিক আদালতের রায়ই বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। বহুল আলোচিত এই জেলহত্যাকান্ডের আসামিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। এতে দন্ডিত ১১ আসামির সবাই পলাতক আছে, যাদের তিনজন মৃত্যুদন্ড ও আটজন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। এদের মধ্যে দুজন ছাড়া বাকি আসামিরা কোথায় আছে, সে ব্যাপারে সরকারের কাছে নিশ্চিত তথ্যও নেই। প্রশাসনের দায় পলাতক দন্ডিত আসামিদের খুঁজে বের করে দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তি কার্যকর করা। এটি স্পষ্ট যে, মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী চার নেতার হত্যাকান্ড কোনোভাবেই কেবল গুটিকতক অস্ত্রধারীর কাজ নয়, এটি ছিল জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করতে, দেশকে মুক্তি সংগ্রামের চেতনার বিপরীত দিকে নিয়ে যেতে স্বাধীনতার শত্রুদের ঘোরতর ষড়যন্ত্রের অংশ। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, এ হত্যাকান্ড একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডেরই ধারাবাহিকতা। ১৫ আগস্টের খুনিচক্রই জেলহত্যাকান্ড ঘটায়। তারা খবর পেয়েছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাÐের জন্য দায়ী সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীরই একটি অংশ পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। এ অবস্থায় কিছুটা জিঘাংসা থেকেও ঘাতকরা জেলহত্যার ঘটনা ঘটায় বলে ধারণা। এমনও মনে করা হয়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক শক্তিকে নিঃশেষ করার হীন পরিকল্পনা ছিল, তার পুনরুত্থানে নেতৃত্বদানে সক্ষম নেতাদের শেষ করে দেয়াই ছিল উদ্দেশ্য। জেলহত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়ে তারা বিদেশে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় বিমানবন্দর দিয়ে। কীভাবে সেটা সম্ভব হয়েছিল, তা আজও এক রহস্য।
আপিল রায়েও এ হত্যাকাÐের নেপথ্যে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র থাকার বিষয়টি বলা হয়েছে। সেই ষড়যন্ত্রের স্বরূপ জাতির সামনে পুরোপুরি উন্মোচিত হওয়া, ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।