জুনের মাঝামাঝি দেশে মৌসুমি বায়ুর প্রবেশ

55

করোনা মোকাবেলায় জেরবার দেশসহ সারাবিশ্ব। এর মধ্যেই ক্যালেন্ডারের পাতায় গ্রীষ্মের পাততাড়ি গুটানোর সময় ঘনিয়ে আসছে। সপ্তাহখানেক পর বিদায় নেবে জ্যৈষ্ঠ মাস। এবার বাংলা বর্ষপঞ্জিকার হিসাব ধরেই চলীত জুনের মাঝামাঝি সময়েই দেশে প্রবেশ করতে পারে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু। মানে বর্ষাকাল। বৃষ্টিপাতের ধারা মাথায় নিয়েই যাত্রা শুরু করবে আষাঢ়। এবার বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি ভঅরী বর্ষণজনিত কারণে স্বল্পমেয়াদী বন্যার পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণকারী সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস বলছে, প্রতিবেশি দেশ ভারতের কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গ হয়ে দেশের টেকনাফ অঞ্চল দিয়ে মৌসুমী বায়ু স্থলভাগে প্রবেশ করে। গত পয়লা জুন ভারতের কেরেলায় মৌসুমি বায়ুর প্রবেশ পরিলক্ষিত হয়েছে। এরপর তা পশ্চিমবঙ্গ হয়ে আগামী ১৪ জুনের আগে-পরে দেশে প্রবেশ করতে পারে। সেই হিসেবে চলতি মাসেই এবারের বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টিপাত শুরু হবে। জুনের প্রথমার্ধে সারাদেশে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বা বর্ষা বিস্তার লাভ করতে পারে। এর প্রভাবে দেশজুড়ে বৃষ্টিপাত হতে পারে। পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরে এ মাসে এক থেকে দুটি মৌসুমি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। মৌসুমি ভারী বৃষ্টিপাতজনিত কারণে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কিছু স্থানে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। মৌসুমী বায়ু প্রবেশের সাথে সাথে দেশে নতুন বৃষ্টিবলয় সক্রিয় হতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ১০-১২ জুন থেকে এ বৃষ্টিবলয় সক্রিয় হতে পারে। মৌসুমী বৃষ্টি বলয়ে একটানা বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। মৌসুমী বৃষ্টিপাতের এই ধারা চট্টগ্রাম বিভাগকেই সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করতে পারে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে কৃষিখাতও ক্ষতিগ্রস্ত। চলতি বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক বৃষ্টিধারা পূর্বাভাস খানিকটা হলেও কৃষকদের মনে আশার সঞ্চার করতে পারে বৈকি। কৃষিখাতের পক্ষে এই পূর্বাভাস সুখদায়ক বলেই মনে করছেন অনেকে।
চলতি জুন মাসের দীর্ঘমেয়াদি আবহাওয়ার পূর্বাভাসে তথ্য উল্লেখ করে আবহাওয়াবিদ মো. আফতাব উদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমরা আশঙ্কা করছি, এ মাসের শেষের দিকে এই বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলে এর আশংকা বেশি। এখনও দেশের নদ-নদীতে পানিপ্রবাহ একটু বেশি রয়েছে বলেই মনে হয়।’
প্রায় একই শঙ্কার কথা জানিয়ে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, জুনের মাসের মাঝামাঝির পর বৃষ্টিপাতের আরামত রয়েছে। যদি ভারী বৃষ্টিপাত হয় তাহলে সাময়িক বন্যা দেখা দিতে পারে। আর সেটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হওয়ার শঙ্কাই বেশি।
আবহাওয়া অধিদপ্তর গতকাল শনিবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে পরবর্তী চব্বিশ ঘন্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলেছে, ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝড়ো হাওয়া ও বিজলী চমকানোসহ হালকা থেকে মাঝারী ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরণের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে। খুলনা, সাতক্ষীরা ও যশোর অঞ্চলসমূহের উপর দিয়ে বর্তমানে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। সারাদেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। পরবর্তী আটচল্লিশ ঘন্টা বা দু’দিনের আবহাওয়ার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা না গেলেও বর্ধিত পাঁচ দিনের আবহাওয়ার অবস্থায় দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু টেকনাফ উপকূল পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গতকাল শনিবার সন্ধ্যঅ ছয়টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী চব্বিশ ঘন্টায় চট্টগ্রামসহ দেশের প্রায় সবকটি বিভাগের কোনও না কোনও অঞ্চলে কমবেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর মধ্যে দেশের সর্বোচ্চ ৯৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে রংপুর বিভাগের সৈয়দপুরে। আর চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে ফেনীতে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বছর দুয়েক আগে অর্থাৎ বিগত ১৪২৫ বঙ্গাব্দের বৈশাখেই ‘শ্রাবণের উপস্থিতি’ আগাম বর্ষার একধরণের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। সেই বছর মধ্য বৈশাখ পর্যন্ত দেশে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, তা গত সাড়ে তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে, এবার কালবৈশাখী মৌসুমের দৈর্ঘ্য পূর্ববর্তী বছরের মত লম্বা হয়নি। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে কয়েক দফায় দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার তাপদাহ বয়ে গেছে। মাসের শেষে সিলেট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণাসহ কিছু কিছু অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে কালবৈশাখীর দাপট পরিলক্ষিত হলেও সামগ্রিকভাবে তাপদাহেই পুড়তে হয়েছে বেশিরভাগ এলাকার মানুষকে। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে, আষাঢ়-শ্রাবণকেই বর্ষাকাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে, ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত বর্ষার রেশ থেকে যায়। অর্থাৎ জুনের শেষ থেকে আগস্টের শেষ সপ্তাহ পর্যন্তই বর্ষা মৌসুম ধরা হয়।
আবহাওয়াবিদদের সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, একটানা কয়েকবছর দেশে বর্ষাঋতুর দৈর্ঘ্য অনেকটা কমে এসেছিল। আর আগাম বন্যা ঠাঁই নিতে শুরু করেছিল ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু, ২০১৭ সালে বাঁক বদল ঘটিয়ে স্বমহিমায় আবির্ভূত হয় বর্ষাকাল। ওইবছর দেশে বন্যায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে। সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয় অর্ধ কোটিরও বেশি বন্যাদুর্গত মানুষকে। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়। হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে বন্যার পানিতে ফসল তলিয়ে যায়। এছাড়া, বন্যাকবলিত অন্তত ৩২টি জেলার বাড়িঘর ও ফসলাদি মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়। দেশের নদনদীর পানির ৯৩ শতাংশই আসে উজানের দেশগুলো অর্থাৎ নেপাল, ভারত এবং কিছুটা ভুটান থেকে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা এবং মেঘনা অববাহিকায় বৃষ্টিপাতের ওপরই বাংলাদেশে বন্যা হবে কিনা তা অনেকটাই নির্ভর করে। উজানের পাশাপাশি দেশে অতিবৃষ্টি হলে জুনের শেষ দিক থেকে ক্রমাগতভাবে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। আর নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করলেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধীনে দেশের তিনটি নদী অববাহিকার তিনশ’ ৪৩ টি পানি সমতল পর্যবেক্ষণ পয়েন্ট রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান প্রধান নদ-নদীর ৯০টি পয়েন্ট থেকে ৫৪টি পয়েন্টে পানির উচ্চতা পর্যবেক্ষণ করে বন্যার পূর্বাভাস দেয়া হয়।
প্রসঙ্গত, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংরক্ষিত তথ্যভাÐারে উল্লেখ রয়েছে, দেশে ১৯৮৮ সালে প্রধান প্রধান নদ-নদীর পানি বিপদসীমার একশ’ ১২ সেন্টিমিটার এবং ১৯৯৮ সালে বিপদসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বন্যার সৃষ্টি করেছিল। এর মধ্যে ১৯৮৮ সালের বন্যায় দেশের ৬১ শতাংশ এবং ১৯৯৮ সালের বন্যায় ৬৮ শতাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেলেও এরপর আর এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি। তবে, ২০১৭ সালে হাওরে আগাম বন্যা ও উত্তরাঞ্চলে দুই দফা বন্যায় ব্যাপক ফসলহানি ঘটে।