জীবিত মানুষের চল্লিশা সম্পন্ন করেছিল তার পরিবার

110

প্রবাসজীবন যদিও মধুর তথাপিও কারো কাম্য নয়। প্রবাসীদের ক্ষেত্রে নির্ভেজাল এই সত্য উক্তিটা বিদেশি এক লেখকের। দীর্ঘ প্রবাসজীবনে অনেক ধরনের প্রবাসী দেখেছি। কেউ আরামে ছিল তো, কেউ কষ্টে ছিল। মরুভ‚মিতে কেউ উত্তপ্ত বালির ওপর উটের পিছে পিছে প্রচÐ গরমে সারাদিন হাঁটে। আর কেউ এসির ভেতর বসে বসে পেট্রো ডলার গুনছে। চট্টগ্রামের মেহের আলী (ছদ্মনাম) বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। বুকভরা আশা আর হৃদয়ে লালিত ছোট ছোট স্বপ্নগুলো নিয়ে আর দশজনের মত দুবাই এসেছিল উট চরানোর কাজে। ভেবেছিল কয়েকটা উট, গরু, ভেড়া/ছাগলের দেখাশোনা করা তেমন আর কঠিন কী। কিন্তু সেতো জানতোনা তার জন্য একশো টি উট আর দেড়শটি ছাগল অপেক্ষা করছে। দুবাই তার আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে মনিব এসে নিয়ে গেল সৌদিয়া সীমান্ত সংলগ্ন সিলাতে মনিবের বাড়িতে। মনিব বয়স্ক এক বেদুঈন মহিলা। একমাস মনিবের বাড়িতেই ছিল। ভালোই ছিল গৃহ পরিচারকের কাজ করে। একমাস পর মনিব তাকে নিয়ে সৌদিয়া সীমান্ত পার হয়ে জনমানবশূন্য অনন্ত দিগন্ত বিস্তীর্ণ মরুপ্রান্তরের একটি তাঁবুতে রেখে এলো। যেদিকে চোখ যায় বালি আর বালি। প্রখর রৌদ্রকরোজ্জ্বল আকাশ মরুপ্রান্তর দিগন্তে একাকার। এখানে বেদুঈন বুড়ির একশো টা উট আর দেড়শ টা ছাগলের সাথে মেহের আলীকে বসবাস করতে হবে। বিদ্যুৎ, পানি টেলিফোন কিছুই নেই এই ধুধু সাহারার বুকে। মরুভূমির উত্তপ্ত বালিতে খালি পায়ে চলা দুষ্কর। পায়ে ফোস্কা পড়ে যায়। মেহের আলীকে নামিয়ে দিয়ে পশুগুলির খাবার ও পানি দেখিয়ে দিয়ে বেদুঈন বুড়ি তার ল্যান্ডক্রুজারে বসে ধুলি উড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। পানি গরম, বাতাস গরম। খাওয়ার জন্য তাকে দেয়া হত একটি তিনশ গ্রামের চনার টিন। স্থানীয় ভাষায় যাকে লুবিয়া বলা হয়। এবং একটি পেঁয়াজ। প্রতিদিন ৩০ বস্তা ভুষি ও ১০ বস্তা গম মেহের আলীকে মিক্স করতে হতো পশুগুলির আহার প্রস্তুত পর্বে। দীর্ঘ দেড় বছর মেহের আলীর সাথে কারো কোন যোগাযোগ নেই। মেহের আলী জানে না মেহের আলীর পরিবার কেমন আছে। মেহের আলীর পরিবারও জানেনা মেহের আলী কোথায়, কিংবা আদৌ বেঁচে আছে কিনা। মাথার চুল কাঁধ অতিক্রম করেছে। চুলে জট ধরেছে। সারাদিন পরিশ্রমের পর পেট ভরে দুটো ভাত খেতে পেতনা। দুটো কথা বলার জন্য কোন লোক পেতনা। কোন নেটওয়ার্ক নেই এই বিস্তীর্ণ জনশূন্য মরুভূমিতে। এ যেন ব্রিটিশ আমলের সেই আন্দামান দ্বীপ। অনেক চেষ্টা করেও মেহের আলীর কোন খবর কেও নিতে পারেনি। তার পরিবারের সবার ধারণা হয়েছিল মেহের আলী বোধহয় বেঁচে নেই। ওরা চল্লিশাসহ মেহের আলীর মরণোত্তর যাবতীয় অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে ফেলেছে।
এদিকে মেহের আলী উত্তপ্ত মরুপ্রান্তরে অমানুষিক পরিশ্রম করে তপ্ত বালির ওপর কম্বল বিছিয়ে ক্লান্তিতে যখন চোখের পাতা এক করে ঠিক তখনি ফোঁস ফোঁস শব্দে চোখ খুলে যায়। হাতের টর্চটা জ্বালিয়ে দেখে তাঁবুর ভেতর বিষাক্ত সাপ। প্রথম প্রথম ভীতসন্ত্রস্ত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেও প্রতিরাত একই ঘটনার পুনরাবৃতি দেখে সাহস ও বুদ্ধির বিকাশ ঘটেছে এবং লাঠিপেটা করে সাপকে ধরাশায়ী করে ঘুমুতে যেত। নিঃসঙ্গ অসহ্য উন্মাদ প্রায় মেহের আলী এ জীবন থেকে পালানোর পরিকল্পনা করে। একদা দুই জেরিক্যান পানি ভর্তি করে একটি উটের ওপর বসে লোকালয়ের উদ্দেশ্যে রাত্রে যাত্রা আরম্ভ করলো। সারারাত মরুভ‚মির ওপর উট চলল। সকালের আলো ফুটে উঠলো চারিদিকে। কিন্তু লোকালয়ের কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। চারিদিকে নীল আকাশটা বিস্তীর্ণ মরুভ‚মির সাথে মিশে আছে। মেহের আলী বুঝতে পারলো তার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। আবার যথাস্থানে ফিরে যাওয়ায় মঙ্গল। উটের পদচিহ্ন অনুসরণ করে করে সারাদিন চলার পর সন্ধ্যায় নিজের তাঁবুতে এসে পৌঁছে। ক্লান্ত শ্রান্ত মেহের আলী রাতে আর পশুদের খাবার দিলনা। বেদুঈন মালিক বুড়ি সপ্তাহে একদিন এসে মেহের আলীর সাথে পশুগুলিকেও দেখে যায়। মেহের আলীর জন্য পেঁয়াজ, লুবিয়ার টিন ও কয়েক গ্যালেন পানি নিয়ে আসে। মেহের আলী বুড়িকে অনুনয় বিনয় করে বলে একটিবার লোকালয়ে গিয়ে তার জটা চুলগুলি কেটে দেশে একটি ফোন করে পরিবারের খবর নিতে। কিন্তু বেদুঈন মহিলা প্রতিবারই বলে কদিন পরে যেও। তার সেই ‘ কদিন’ আর শেষ হয়না। তাই এবার মেহের আলী প্রতিজ্ঞা করলো, লোকালয়ে না নিয়ে গেলে সে আর পশুগুলিকে খাবার দেবে না। পশু আর মানুষের অনশন শুরু হল। ক্ষিদেয় পশুগুলির চিৎকারে বুড়ি অস্থির। মেহের আলীকে অনুরোধ করে বুড়ি। মেহের আলীর এককথা তাকে লোকালয়ে নিয়ে না গেলে সে নিজেও কিছু খাবেনা পশুদেরও কিছু খেতে দেবেনা। সিদ্ধান্তে অনড় মেহের আলীর দিকে তাকিয়ে বুড়ি প্রমাদ গুনলো। অবশেষে হার মানতে হল বুড়িকে। পরেরদিন এক সোমালিয়ান যুবককে দুইদিনের জন্য পশুগুলির দায়িত্ব দিয়ে মেহের আলীকে নিয়ে বেদুঈন বুড়ি ছুটলো দিগন্ত বিস্তৃত মরুভ‚মির ওপর দিয়ে সিলার লোকালয়ের দিকে। ৭০/৮০ কিলোমিটার স্পীডে দিকশূন্য মরুভ‚মির ওপর দেড় ঘণ্টা চলার পর বেদুঈন বুড়ির ল্যান্ডক্রুজার জীপটা পৌঁছে গেল সিলা বাজারে। বৃদ্ধা কিছু টাকা দিয়ে গাড়ি থেকে মেহের আলীকে নামিয়ে দিয়ে বলল- দেশে ফোন করো, পরিচিতদের সাথে সাক্ষাৎ করো, আগামী পরশু আমি আসবো। আবার তোমাকে পৌঁছে দেবো সেই মরুপ্রান্তর আফিয়ায়। আফিয়ার নাম শুনে ক্ষণিকের জন্য যেন মেহের আলীর শরীরটা অবশ হয়ে গেল। সিলা’র বাজারে নেমে মেহের আলী দেখলো সবাই তাকে এমনভাবে দেখছে যেন সে এক আজব চিড়িয়া। দেড় বছর পর সেলুনের আয়নায় মেহের আলী নিজেকে দেখে চমকে উঠলো। দুটো সেলুন তার জট পাকানো চুল কাটতে অনীহা প্রকাশ করলে সাধারণ রেটের তিনগুণ বেশি দাম দিয়ে তৃতীয় সেলুনে চুলগুলো কেটে টেলিফোনে সবার সাথে যোগাযোগ করলো। দীর্ঘ দেড়/দুই বছর পর পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনেরা টেলিফোনে তার কণ্ঠ শুনে মৃত মানুষের কণ্ঠ শোনার মত চমকে উঠেছিল। আবেগে হাউমাউ করে কেঁদেছিল, কথা বলতে পারেনি কেউ। দুবাই হামেরিয়া মার্কেটে অধিকাংশ বাঙালি ব্যবসায়ি। ফল-ফ্রুট শাখ-সবজির জন্য হামেরিয়া প্রসিদ্ধ। হামেরিয়া মার্কেটের পরিচিতরা বলল-ওখান থেকে ডাইরেক্ট ট্যাক্সি নিয়ে চলে এসো। যতরাত হোক আমরা বসে আছি। উল্লেখ্য, দুবাই থেকে সিলাহ ৩০০ কিলোমিটারেরও বেশি। সরাসরি ট্যাক্সি নিয়ে এলে সাড়ে চারঘণ্টার পথ। পরিচিতদের সাথে কথা বলে মেহের আলী আবেগাপ্লুত হয়ে থির থির করে কাঁপছে। মেহের আলী এখন মুক্ত বিহঙ্গ। ছুটে যাবে স্বজনদের কাছে শূন্য হাতে। কিন্তু এখনো যেই মেহের আলীরা চোখের আড়ালে রয়ে গেছে তাদের কী হবে ? দূতাবাস কী তাদের খোঁজ জানে ? এখানে মেহের আলীর অনুরোধে তার নাম ঠিকানা গোপন রাখা হয়েছে। প্রবাসীদের অনেক কষ্টের নীল পাতা সামাজিক অবস্থানের কারণে কখনো খোলা হয় না। মেহের আলী সিলাহ থেকে দুবাই তার আত্মীয়দের কাছে পৌঁছলে ঘটনাক্রমে আমার সাথে দেখা হয়। ছলছল চোখে তার আধুনিক আরব্য রজনীর বেদনাবিধুর গল্প নিজ মুখে শোনালে, আমি আমার পাঠকদের জন্য তুলে দিলাম।

লেখক : প্রবাসী সাংবাদিক