জীবন-মৃত্যু-স্বপ্নের কথা

166

মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ফুল্লুনাফসিন জা’য়িকাতুল মউত’। প্রত্যেক নফসকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। এই স্বাদ দুনিয়ার সব স্বাদ বিনাশ করে। নফসের মৃত্যু হয় কিন্তু রুহের মৃত্যু হয় না। রুহের সম্পর্কে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘ইল্লালিল্লাহে ওয়াইল্লা ইলাইহি রাজিউন’ অর্থাৎ আল্লাহর নিকট হতে আগমন এবং আল্লাহর নিকট প্রত্যাগমন হয়।
পৃথিবী নামক গ্রহটির মাঝে আজ যারা আদি, তারা এক সময় ছিল না, আরেক সময় সবাই নাই হবে যাবে। এটিই বিধাতার বিধান। অতিসংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আমাদের দুনিয়াতে আসা। কোন শিশু সন্তান ভূমিষ্ট হলে তার ডান পাশে আজান এবং বাম পাশে ইকামত দেওয়া ইসলামের বিধান। আজান ইকামতের পর নামাজের শুরু। ভূমিষ্ট শিশুর জন্মের পর আজান-ইকামত এবং মৃত্যুর পর জায়নাজার নামাজ আদায় করতে হয়। আজান ইকামতের মাঝখানে সংক্ষিপ্ত সময়টুকুই আমাদের জীবন। ইসলামের একজন সেরা দার্শনিক আল্লামা ইমাম গাজ্জালী (রাহ.) লিখেছেন, ‘আমরা যখন নিদ্রামগ্ন থাকি তখন স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নগুলো আমাদের বাস্তব মনে হয়। নিদ্রাভঙ্গের পর স্বপ্নগুলো কাল্পনিক মনে হয়, এ জগৎটাই মনে হয় বাস্তব। ইহ জগৎ ত্যাগ করে যে দিন পরজগতে গমন করবো সে দিনই বুঝতে পারবো দুনিয়ার জগৎটা স্বাপ্নিক, পরকালটাই বাস্তব ও স্থায়ী’। আমাদের জীবনটা ক্ষণস্থায়ী হলেও অত্যন্ত মূল্যবান। এই সংক্ষিপ্ত জীবনের মাঝে হয় পুলসিয়াতের পার। সূরা ফাতিহায় বর্ণিত ‘ইহদিনাস্ সিরাত্বল মোস্তাকিম’ সরল সঠিক পথ এই দুনিয়ার অতিক্রম করতে সক্ষম হলে পুলসিরাত পার হওয়া গেল। জান্নাতও এই দুনিয়ায় অর্জন করতে হয়। তাই দুনিয়ার সংক্ষিপ্ত সময় অত্যন্ত মূল্যবান। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া যায় না, ধার করা যায় না, জমাও রাখা যায় না, টাকা দিয়ে ক্রয় করা যায় না তার নাম ‘সময়’। সময়ের মূল্যমানে জীবনের মূল্য। আমরা গাড়ির মূল্য বুঝি, বাড়ির মূল্য বুঝি, নারীর মূল্য বুঝি, সম্পদের মূল্য বুঝি কিন্তু জীবনের মূল্য বুঝি না। যে ব্যক্তি সময়ের মূল্য দেননি, সময় সে ব্যক্তির নিকট চরম প্রতিশোধ নিয়েছেন।


মানুষের বিদায় বেলায় রুহ আজরাইলের, সম্পাদক ওয়ারিশের শরীরের মাংস পোকা মাকড়ের, হাড় মাটির শুধুমাত্র আমলই নিজের। আমল বা কুতকর্মই আমাদের সাথে যাবে। আমলের ফলে ভোগ সময়কেই করতে হবে।
একই শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে তখন শূন্য হাত মুষ্টিবদ্ধ থাকে, কিন্তু যখন মৃত্যুবরণ করে মানুষ তখন কোনো অবস্থাতেই হাতকে মুষ্টিবদ্ধ করা যায় না। মানুষ দুনিয়ায় হতে কোন কিছুই চালে যাওয়ার সময় নিয়ে যেতে পারে না। শূন্য হাতে বিদায় নিতে হয়। এটি আমাদের জন্য বড় শিক্ষা। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘দি লাস্ট জ্যাকেট হ্যাস নো পকেট’ শেষ কাপড়ের ( কাফনের কাপড়) পকেট নেই। আলেকজেন্ডার দ্যা গ্রেড দুনিয়া হতে বিদায় নেওয়ার পূর্বে তিনটি অসিয়ত করে যান। তাঁর মৃত্যুর পর একটি হাত যেন কফিনের বাইরে প্রসারিত রাখে। কারণ বিশ্ববাসী যেন দেখেন বিশ্ববিজেতা বীর খালি হাতে ফেরত যাচ্ছেন। তাঁর কফিনটা যেন ডাক্তারদের কাঁধে তুলে দেন, কারণ ডাক্তাররা নাকি মানুষ বাঁচায়, তারা আমার মত মানুষ বাঁচাতে পারলো না। আর আমার সম্পদ সোনা, রূপা, হিরা, টাকা সবগুলো রাস্তায় ছড়িয়ে দিবে কারণ এসব আমার কোন কাজে আসল না।
স্টিভ জবস, পৃথিবীর সেরা ধনীদের অন্যতম। এপেল কম্পিউটারের মালিক। কয়েক বছর পূর্বে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু শয্যায় শায়িত হয়ে বললেন, আমি আজ হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। কিন্তু যমদূতকে আমি সমস্ত সম্পদ অর্পণ করেও একটি রাত বেশি বাঁচার কোন উপায় নেই। এই হলো আমাদের জীবন।
মহাবিশ্বের সকল সৃষ্টি আল্লাহর আইন মানতে বাধ্য। কিন্তু জ্বীন ও ইনসানকে আল্লাহ পাক দিয়েছেন ইচ্ছার স্বাধীনতা। এই দুনিয়ায় জ্বীন এবং ইনসান চাইলে মহান আল্লাহর আইন মানতে পারে, নাও মানতে পারে। কয়েকটি বিধান মানুষ মানতে বাধ্য। যেমন-জন্ম-মৃত্যু-দুর্ঘটনা। বিজ্ঞান প্রযুক্তি বর্তমানে অসম্ভবকে করেছে সম্ভব। মানুষ যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে অনেক কিছু করতে পারে, কিন্তু মৃত্যুকে অতিক্রম করতে পারে না। এই ক্ষমতা মানুষের নেই। যত ক্ষমতাবান মানুষই হোক তাঁকে মৃত্যুর কাছে পরাজিত হতে হবে। মানুষের ক্ষমতা মৃত্যুর কাছে অসহায়।
জন্মের পর মায়ের দোলনায় দোল খেতে খেতে জীবনের শুরু, বেড়ে উঠা, মৃত্যুর পর আরেক দোলনায় করে কবরে যাওয়া। দোলনা দিয়ে জীবন শুরু দোলনা দিয়ে জীবন শেষ। এই তো আমাদের জীবন।
যতক্ষণ অসুস্থতায় না পড়ি ততক্ষণ বুঝতে পারি না, সুস্থতা মহান আল্লাহর কত বড় নেয়ামত। যতক্ষণ জীবন আছে ততক্ষণ বুঝতে পারি না জীবনের দাম কত! যে দিন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে আরেকটা নিঃশ্বাস নিতে পারবো না, সেদিন বুঝবো জীবনের মূল্য কত। কিন্তু তখন কিছুই করার থাকবা না। মৃত্যু তো একটি ওয়ানওয়ে ব্যবস্থা, একবার মারা গেলে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, এমনভাবে দুনিয়াতে বসবাস কর যেন তুমি একজন মুসাফির। অর্থাৎ পথ অতিক্রমকারী।
আমরা জন্মেছি মৃত্যর জন্য। জন্ম-মৃত্যুর মাঝখানে যদি মানুষের জন্য কিছু করা যায় তা হবে জীবনের সার্থকতা।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যিনি মহামানবতার সেবায় নিজের জীবনকে নিঃশেষ বিলিয়ে দেন তিনিই মহামানব।’
আজ মহামানব নয়, একজন নেহায়েত সাধারণ স্বাভাবিক মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। যে মানুষ সমাজের উপকার নয়, অপকার করে না, যে ন্যায় কাজ নয়, অন্যায় করেনা, যে ভালোবাসা নয় অন্তত ঘৃণা করে না, এমন মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। অথচ মানব ক্যাণই শ্রেষ্ঠ ইবাদত।
এক শ্রেণীর মানুষ আছে, ভোগবাদী। তারা বলে, জান হ্যায় তো জাহান হ্যায়। অর্থাৎ শরীরে জান আছে তো আমার জন্য দুনিয়া আছে। আমি যদি না থাকি পৃথিবীটা স্বর্গের দ্বারা মুড়িয়ে দিলে আমার কী ? সাগরের সব পানি শরবত হলে আমার কী ? তারা বলে, আমি না থাকলে কী হবে আমার শিল্প সাহিত্য প্রতিষ্ঠান দিয়ে ! আসলে এ ধরনের মানুষগুলো স্ববিরোধী। এসব মানুষগুলো তাদের সন্তানদের যতেœর সাথে শিক্ষিত করে। সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখতে মরণ পণ লড়াই করে। তারা বেঁচে থাকতে চায় সন্তানের মধ্যে দিয়ে। এতে আত্মস্থ হয় যে, মৃত্যুর পর স্বার্থপর মানুষগুলো বেঁচে থাকতে চায়। পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের জীবন নিয়ে ভাবতে হবে মৃত্যু নিয়ে নয়। ইহকালের মধ্যে আছে পরকালের মুক্তি। তাই জীবনের মূল্য আত্মস্থপূর্বক সময়কে কাজে লাগানো উচিৎ।

লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক