জীবন এবং বাস্তবতা

425

সন্তান হিসেবে মাকে নিয়ে লেখার দায় বোধ করছি। লেখক হিসেবে এটা দায়িত্বও। কেবল মাকে নিয়েই লিখব তা কি করে হয়? এদেশে হতভাগা বাবাদের গল্পও যে অনেক আছে। এমন কিছু ঘটনায় চোখে জল আসতে চায়; হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। জীবনের গল্পতো এমনই হয়। এ জাতীয় ঘটনার সাথে আমরা মোটেও নতুন ভাবে পরিচিত নই। কি সেই ঘটনা? পত্রিকায় প্রকাশিত এমন সংবাদের একটি- ‘বাসষ্টান্ডে ফেলে রাখা বৃদ্ধ মায়ের ছেলের জন্য অপেক্ষায় কাটলো একমাস’। অন্যটি ‘ডাস্টবিন থেকে উদ্ধার করা অসুস্থ্য বৃদ্ধ পিতাকে বৃদ্ধাশ্রমে প্রেরণ’। সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ দুটি আমাদের বিবেক, মূল্যবোধ, পারিবারিক বন্ধন এবং আত্মার সম্পর্ক বিষয়ক এতদিনকার ধ্যাণ ধারণার ওপর প্রচÐ আঘাত হানে। সংবাদ দু’টি সমাজের এক নগ্ন বাস্তবতাকে উন্মোচন করে।
আজকাল বৃদ্ধাশ্রমের সাথে বেশ পরিচিত আমরা। এক দশক আগেও অধিকাংশ বাঙালির মাঝে বৃদ্ধাশ্রমের তেমন ধারনা ছিলোনা। এখন দেশের অনেক জায়গায়ই বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছে। আর নরক নামীয় এ বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় হচ্ছে অনেক বৃদ্ধ পিতা-মাতার। সেখানে যেতে তাদের বাধ্য করা হয়। অনেকে আবার জন্মদাতা পিতা-মাতার জন্য অতটুকুও ভদ্রতাও দেখান না। ওরা জন্মদাত্রিকে ফেলে আসেন রাস্তা ঘাটে, নর্দমায়; ঐসবপশুরা আমাদের অতি শ্রদ্ধেয় সেই জাতীয় মরব্বিদের কখনোবা ডাস্টবিনে ফেলে আসতেও দ্বিধা করেন না। এমন ঘটনা কতটা অমানবি, কতটা বিবেক বর্জিত এবং আপত্তিকর? এইসব অমানবিক বিষয়গুলোকে আমাদের সামনে আনা উচিৎ। সমাজ, রাষ্ট এবং পরিবারের আপরাপর সজনদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত। এ নিয়ে আন্দোলন হতে পারে। পরিবারের লোকজন এ আন্দোলনে সামিল হবেন, প্রতিবেশিরা যোগ দেবেন। রাষ্টেরও এ ব্যাপারে দায় আছে। রাষ্ট এমন অমানবিক বিষটিকে আইনের আওতায় আনতে পারে। নিয়োজিত ম্যাজিষ্ট্রেটদের মাধ্যমে ভ্রাম্যমান আদালত গঠন কওে এমন কু-সন্তান কিংবা কু-পুত্রবধূদের তাৎক্ষণিক ৬ মাস কিংবা ততোধিক সময়ের জন্য সাজার বিধান করতে পারে। বিষয়গুলো জনসমক্ষে নিয়ে আসা রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে আমাদেরও কর্তব্য আছে। পরিবারের অন্য সদস্য, প্রতিবেশীরা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে তার কর্মস্থলে গিয়ে প্রতিবাদ জানাতে পারেন। লিখিত অভিযোগ দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে সরকারি কিংবা বেসরকারী যে প্রতিষ্ঠানেই ঐ কু-সন্তান কর্মরত রয়েছে তার উর্ধ্বতনরা বিষয়টি দ্রæত আমলে এনে নিস্পত্তির ব্যবস্থা করতে পারে। পশুতুল্য ব্যক্তিটি ব্যবসায়ী কিংবা অন্য শ্রেনীপেশার হলে সামাজিকভাবে তাকে প্রতিরোধ করা যেতে পারে। মোদ্দা কথা হলো সকলকে সকলের জায়গা থেকে ওদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে, প্রতিরোধ গড়তে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় নিজেরা নিজেদের থেকে ভালো হয়ে গেলে। ভাবনায় আনতে হবে আমরা আমাদের পিতা-মাতার কারনেই পৃথিবীতে আসতে পেরেছি। তাঁরাই আমাদের আলোর মুখ দেখিয়েছেন। তাঁরাই আমাদের আগুন, পানি, রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা করেছেন। শিক্ষা দিয়েছেন, দিনদিন বড় করে তুলেছেন। মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন; যদিও আমরা অনেকে মানুষ না হয়ে অমানুষেই হয়েছি। পিতা-মাতার কষ্টের কথা বেমালুম ভুলে গেছি। চরম অসহায় সময় তাঁরা যখন পার করছেন তখন তাদের পাশে আমরা আর নেই। এমন অমানবিকতার পথটি সকল প্রকার নাগরিকের পরিহার না করা চরম মানবতার পরিপন্থী।
বাবা-মার প্রতি খারাপ আচরণ করা চরম অন্যায়, দেশের এজাতিয় আইন না থাকলেও তা চরম মানবিক অপরাধ বটে! জানি আমাদের দেশে অনেক বৃদ্ধ মা-বাবার এমন পরিনতির সাথে এখন বেশ খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। তাঁরা সন্তান কিংবা পুত্রবধূর নিষ্ঠুর আচরণকে তাদের ললাটের লিখন হিসাবেই দেখেন। এদের কেউ কেউ নিজ সন্তানের অবজ্ঞা, অবহেলাকে সম্বল করে, পুত্রবধূদের রুঢ় আচরণেকে অবলম্বন করে সকল অপমান নির্যাতন সয়ে নিজ গৃহে পড়ে থাকেন। এ ছাড়া তাঁদের সামনে আর কিই বা করার আছে? কিছু করার কোন পথ খোলাও থাকে না। আবার অনেকের নিজ গৃহে সন্তান, নাতি-নাতনি আর পুত্রবধূর সাথে একসাথে থাকার সে ভাগ্যও হয় না।
হাল জামানায় সন্তানদের প্রতি পিতা-মাতার অধিকার বিষয়ে সচেতনতা খুবই দরকার। মাতা-পিতা আর সন্তানের সম্পর্কে ঘাটতি হলেই পরিবারের শান্তি আনয়ন মুশকিল হয়ে পরে। তবে একথাও সত্য পাশ্চাত্যের মতো আমাদের দেশেও পিতা-মাতা-সন্তান সম্পর্কে কোথাও কোথ্ও ঘাটতি দেখা দিতে শুরু করেছে। সে কারনে দেশে এখন দিন দিনই বাড়ছে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা। সে সংখ্যা যে অদুর নিকটে আরও ফুলে ফেপে মস্ত হবে না তাই এখন ভবিতব্য। কিন্তু তা হতে দেয়া ঠিক হবে না। এ অবস্থার পরিবর্তন আনতেই হবে। এজন্য আমাদের, তাদের, আপনাদের, আমাদের রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল হওয়ার অবকাশও বিলক্ষণ আছে। পিতা-মাতার নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করা সন্তানের কর্তব্য। জানি কথাটি ঐসব কু-সন্তানদের জন্য কিঞ্চিৎ গোলমেলে। সত্য কথা হলো তাদের মতে পিতা-মাতা সন্তান জন্ম দিয়েছেন তাই তাদের যথাযথ লালনপালন করবে এটা তাদেরর দায়িত্ব। আর তারাও তাদের সন্তানদের লালনপালন করবে এটা তাদের দায়িত্ব। এটা ওদের, আর ওটা তাদের দায়িত্ব। বাহ বেশ সাচ্ছা যুক্তি বটে! মায়ামমতায় ঘেরা সোনার বাংলায় আমরা এমন সময় পার করছি এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। তাদের এমন প্রতিক্রিয়া আর প্রস্তাবে কী হবে, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। কিন্তু অদুর ভবিষ্যতে তাদের যে জয়জয়কার অবস্থা হবে না তা কিন্ত বলা মুশকিল। দিনকে দিন তাদের দল ভারি হচ্ছে। আর তা করতে এ ব্যাপারে তারা মরিয়া হবেনা, এমন ভাবনা সম্ভবত বাস্তবরহিত। আমাদের ততদিন ধৈর্য ধরতে হবে। তাতে আমাদের এইসব কু-সন্তানদের সামনে ধেয়ে চলার গতি লক্ষ করা যাবে বৈকি!
আরেকটি জীবনের গল্প দিয়ে লেখা শেষ করবো। “বৃদ্ধাশ্রম থেকে সন্তানের কাছে মায়ের চিঠি” ফেসবুকে সেদিন এ শিরোনাম একটি লেখার মন্তব্য আমি এভাবে লিখেছিলাম- “এই ছেলে তোকে কি বলে ডাকি বলতো? কুকুর, বিড়াল, শূকর? না এ নামে তোকে ডাকলে পশুজাতীর যে আর মান ইজ্জত রইবে না। ডাকা ডাকি বাদ দিই। বরং তোর মায়ের মতই তোর জন্য দোয়া করি- “তুই বেঁচে থাক বছরের পর বছর অনন্তকাল”। খোদার কাছে প্রার্থনা এই যে, তিনি যেন তোর অমানুষী মনে উপলব্ধি সৃষ্টি না করে তোর কাছে আজ্রাইল না পাঠান। চিঠি পড়ে তোর মায়ের কষ্ট আমি পুরটা উপলব্ধি করতে পারছি না। এতো বেশী কষ্ট উপলব্ধি করি কি করে? তোর জন্য ফরিয়াদ করি, খোদা যেন তোকে তোর মায়ের মত সমকষ্ট দিয়ে পৃথিবী ত্যাগ করান। এর বেশী কষ্ট তোর জন্য বোধ করি প্রয়োজন পড়বে না। তোর মা কষ্ট যেমনটা পেয়েছেন ঠিক তেমন কষ্টই তোকে দিক খোদা। ভালো থাকিস.. ”। ফেসবুকে আমার এ মন্তব্যের পর এর সমর্থনে শতাধিক মন্তব্য পেয়েছি যা পরলে অনেকেরই চোখে জল আসবে।
বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো ঐ মা তার ছেলেকে লিখেছেন- ‘খোকা তুই কেমন আছিসরে? বউমা আর আমাদের ছোটো দাদুভাই সবাই ভালো আছে তো? জানি তোদের তিন জনের ছোট সংসারে প্রত্যেকেরই খুব কাজ। তবুও তোদের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ। একদিন একটু সময় করে এই বুড়ি মাকে দেখতে আয় না! কিরে, আসবি না? ওঃ বুঝতে পেরেছি! এখনো আমার উপর থেকে অভিমান যায়নি বুঝি! আমাকে যেদিন বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলি, সেদিন ঝগড়া করেছিলাম বৃদ্ধাশ্রম থেকে আমাকে নিতে আসা লোকজনদের সঙ্গে। জানি শেষ দিনটাতে একটু বেশি রকমেরই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলাম, তাছাড়া আর কিইবা আমি করব বল, সময় মতো ওরা এসে আমার জিনিসপত্র সব জোর করে গাড়িতে উঠিয়ে নিল, তারপর বারবার তাগাদা দিতে লাগল। বাবা কারণ আমি তোর সঙ্গে দেখা করে আসার জন্য তাদের কাছে সময় চেয়েছিলাম, তারা সময় দিলেও শেষ পর্যন্ত তুই আসিসনি। তুই কাজে এত ব্যস্ত থাকিস তখন আমার মনে ছিলনা। পরে মনে পড়েছিল, তাই তোর সঙ্গে দেখা না করেই চলে এসেছি। তুই রাগ করিসনি তো? আর সেদিন আমার সেই জেদ দেখে বউমা তো রেগেই আগুন। তাছাড়া তার তো রাগবারই কথা! আমাকে নিয়ে যেতে যারা এসেছিলো, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা যা তড়িঘড়ি শুরু করে দিল তা দেখবার জন্য পাশের বাড়ি থেকে কেউ কেউ উঁকি দিতে লাগলো। এতো বউমার একটু লজ্জাবোধ হবেই। সেদিন তোদের যে অপমান করে এসেছি তোরা সেসব ভুলে যাস কেমন করে! আমার কথা ভাবিস না। আমি খুব ভালো আছি! আর কেনই-বা ভালো থাকবনা বল? তোরা তো আমার ভালো থাকবারই বন্দোবস্ত করে দিয়েছিস। তবে একটা কথা, আমার কথা যদি তোর কখনো-কোনোদিন মনে পড়ে; তখন যেন নিজেকে তুই শেষ করে দিস না। তুই এখনো একশ বছর বেঁচে থাক।”
বৃদ্ধ পিতা-মাতার আর বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে লিখব আর নচিকেতার সেই গান গুন গুন করে গাইব না তা কি করে হয়।
“ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার
মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার
নানা রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি
সবচেয়ে কম দামি ছিলাম এক মাত্র আমি
ছেলে আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম
আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।”
“আপনের চেয়ে পর ভাল, পরের চেয়ে বৃদ্ধাশ্রম।” কঠিন এক সত্য। আর এ সত্যকে মেনেই অনেক বৃদ্ধ মা-বাবা আশ্রয় নেন বৃদ্ধাশ্রমে। সন্তানের কাছে যাদের বেশী কিছু চাওয়ার নেই; শেষ বয়সে আদরের সন্তানের পাশে থেকে সুখ-দুঃখ ভাগ করবার ইচ্ছা এতটুকুই যা চাওয়ার। আর এ নিয়েই প্রতিটি পিতা-মাতা প্রহর গুনতে থাকেন দিবা-রজনী। কিন্তু অনেকেরই সেই সন্তানের কাছে আশ্রয় না হয়ে; আশ্রয় হয় আপনজনহীন বৃদ্ধাশ্রমে। শেষ বয়সে মস্ত ফ্ল্যাটের ঘরের কোনেও জনমদুখী মা-বাবার এতটুকুও জায়গা মিলে না। ওদের ছুঁড়ে দেয়া হয় প্রবীণ নিবাসনামীয় নরকে। তবুও প্রতিবাদ দানা বাঁধে না; মন অভিশাপ দেয় না। নাড়ী ছেঁড়া ধন ওরা। তাই চুপ থাকেন…একেবারে চুপ। তবে এ নিষ্ঠুরতা তাদের কেবলই কাঁদায় … এ কেমন নিয়তি ? ভাবি আমরা কতটাই না আধুনিক স্বার্থপর !
একদিন যে সন্তানের জন্য বাবা-মা ছিলেন স্নেহময়, যে সন্তান একটু আঘাত পেলেই বাবা হয়ে উঠতেন চিন্তিত। যে সন্তানকে নিজে হাত দিয়ে খাইয়ে দিয়েছেন, কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছেন এবং কখনই নিজের অসুবিধার কথা সন্তানদের বুঝতে দেননি। আজকাল সমাজে এমন কিছু সন্তান দেখা যায়, যারা কি না মা-বাবার এতোসব আদর-যতেœর কথা ভুলে মা-বাবাকে ঠেলে দেয় অজানা গন্তব্যে। বৃদ্ধ ও অসহায় বলে তাদের ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রমে। ঘরের মধ্যে সবার থাকার জায়গা হলেও এখানে বৃদ্ধ মা-বাবার জায়গা হয় না। আসলে একজন মা-বাবা তার সন্তানদের জন্য যা করেন, তা তাদের পক্ষে সারা জীবনেও শোধ করা সম্ভব নয়। বুড়ো বয়সে এসে তারা চায় একটু শান্তি, ভালোবাসা ও স্নেহ। এ বয়সে একটু আদর-যতœ পেলেই তারা খুশি হন। মা-বাবা চান সন্তানরা যেন তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনে। আমাদের মনে রাখা উচিত আজ যিনি সন্তান, তিনিই আগামী দিনের পিতা কিংবা মা। বৃদ্ধ বয়সে এসে মা-বাবারা যেহেতু শিশুদের মতো কোমলমতি হয়ে যায়, তাই তাদের জন্য সুন্দর জীবনযাত্রার পরিবেশ তৈরি করাই সন্তানের কর্তব্য। আর যেন কখনো কোনো পতা-মাতার ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। তাদের জন্য তৈরি করতে হবে একটা নিরাপদ ও সুন্দর পৃথিবী।

লেখক : সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট