জিয়া দরখাস্ত করে বাকশালের সদস্য হয়েছিলেন

63

বিএনপি নেতারা বাকশালের বিরোধিতায় সরব থাকলেও তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ‘দরখাস্ত করে’ তার সদস্য হওয়ার তথ্য জানালেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। মন্ত্রিসভার জ্যেষ্ঠ এই সদস্য গত সোমবার রাতে তৌফিক ইমরোজ খালিদী লাইভ অনুষ্ঠানে ১৯৭৫ সালের এই তথ্য তুলে ধরেন।
মোজাম্মেল হক বলেন, ‘তিনি (জিয়া) দরখাস্ত করে বাকশালের সদস্য হয়েছিলেন। সেনাপ্রধানসহ অন্যান্যরা অটোমেটিক্যালি হয়েছিল। তিনি আবেদন করে বলেছেন যে, আমি সেবা করার সুযোগ চাই। অথচ বঙ্গবন্ধু হত্যার এক মাসের মাথায় তিনি বললেন, বাকশাল শব্দটা একটা গালি’।
স্বাধীনতার ৪৮তম বার্ষিকী সামনে রেখে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদীর এই অনুষ্ঠানে এদিন অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধের ৪৮তম বার্ষিকীর একদিন আগে অনুষ্ঠিত হয় এই আয়োজন, যে সশস্ত্র প্রতিরোধে সংগঠকদের একজন ছিলেন মোজাম্মেল হক। খবর বিডিনিউজের
১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ গাজীপুরে সর্বপ্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ কমিটির আহবায়ক হিসেবে ব্রিগেডিয়ার জাহান জেবের বিরুদ্ধে সম্মুখে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন তিনি। সেই প্রতিরোধ যুদ্ধে তিনজন ছাত্র-জনতা শহীদ হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য এ বছর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে এই মুক্তিযোদ্ধাকে।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক হলেও ধর্মীয় কাজে জিয়াউর রহমানের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না বলেই মন্তব্য করে প্রবীণ রাজনীতিক মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, ‘ক্যান্টনমেন্টে (জয়দেবপুর) তখন কোনো মসজিদ ছিল না। নামাজ পড়তে হলে জয়দেবপুর বাজার মসজিদই একমাত্র মসজিদ ছিল। উনি ওখানে তিন বছর অবস্থান করেছেন বোধহয়, কোনোদিনও তিনি নামাজে গিয়েছেন, আমি অন্ততঃপক্ষে দেখি নাই। অন্য কোনো মানুষ দেখছে বলে আমার জানা নাই’।
তার এই বক্তব্যের পর তৌফিক ইমরোজ খালিদী দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করলে মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিয়েই এটা বলছি’। মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী বলেন, ‘জিয়া ক্ষমতা নিয়ে সংবিধান সংশোধন করে ইসলামী দলকে বৈধতা দিলেন, জামায়াতে ইসলামকে বৈধতা দিলেন। এই যে বলা হয়, জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র দিয়েছিলেন… বহুদলীয় অর্থ জামায়াতে ইসলামের রাজনীতি করার অধিকারটা নিশ্চিত করলেন। এটাই হলো তার তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্র। তিনি যে ভাবধারায় দেশকে পরিচালিত করেছেন, সেটা ধর্মভিত্তিক ভাবধারা’।
এক প্রশ্নের উত্তরে মোজাম্মেল হক বলেন, ‘জিয়া নির্বাচিত রাজনীতিকদের প্রতি ভীতশ্রদ্ধ ছিল’। তিনি বলেন, ‘আমাদের সেই সময়কার শত্রুরা চিহ্নিত ছিল, পাকিস্তানিরা, এক কথায় চিনতে পারতাম। কিন্তু আজকের শত্রুদের চিহ্নিত করতে পারছি না। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধের ব্যক্তি, তারা একজন হলেও আমাদেরকে চিহ্নিত করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে কারা, তাদের এমনিতে চেনা যায় না। তাদের কার্যক্রম দিয়ে তাদেরকে চিনতে হবে’।
মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করার জন্য একাত্তরের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক তোলা হয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কত লোক মারা গিয়েছে, কেউ কি হিসাব করে দেখিয়েছে? যখন যেটা বলা হয়েছে, সেটাই ধরা যায়। ধরেন এক লাখ যদি মারা যায়, তাহলে সেটা কি যথেষ্ট নয়?’
একাত্তরে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা জাতীয় সংসদে ইতোমধ্যে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়ে ২৫ মার্চকে জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস পালন করছি। আমাদের দূতাবাসগুলো চেষ্টা চালাচ্ছে। একটা আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস আসে, ওই দিবসের কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড নাই। সে জন্য আমরা বলতে চাচ্ছি, ওই তারিখটা পরিবর্তন করে ২৫ মার্চ করা হোক। সেজন্য আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলছে। যখনই জাতিসংঘে আসবে, তখনই ভোটাভুটি হবে’।
আদালতে মামলা চলার কারণে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা এখন প্রকাশ করা যাচ্ছে না জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘ইতোমধ্যে আদালতে মামলা হয়ে গেছে। অনেকে জানে যে, তারা বাদ পড়তে যাচ্ছে, তারা আদালতে গেছে’।
বিএনপির আমলে আইন না মেনে মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেওয়া হয়েছিল দাবি করে তিনি বলেন, ‘২০০২ সালে যখন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইনটা হয়, সেই আইনে বলা আছে- যদি কেউ ভুলে হয়ে থাকে, তাদের বাতিল করা এবং যারা বাদ পড়েছে তাদের অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষমতা দেওয়া আছে। সেই আইনে বলা আছে, যখন কেউ আবেদন করবে, থানায় আবেদন যাচাই-বাছাই হবে। এরপর জামুকার সভায় অনুমোদনের পর তারা তালিকাভুক্ত হবে। কিন্তু বিএনপির আমলে ৪৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধা করেছে। আবেদন করেছে, নামকাওয়াস্তে তদন্ত করে দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু জামুকার অনুমোদন করেনি। এরা আবার এখন গিয়ে মামলা করেছে। হতে পারে তাদের কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা’।
মুক্তিযোদ্ধা তালিকার পাশাপাশি রাজাকারদের তালিকাও করা হবে বলে জানান মন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘জাতীয় সংসদে এ ধরনের দাবি উচ্চারিত হয়েছে’।
এই পর্যায়ে তৌফিক খালিদী প্রশ্ন করেন, ‘আগামি পাঁচ বছর আপনি এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকবেন, এই পাঁচ বছরে সেই তালিকা আপনি করে যেতে পারবেন বলে মনে হয়?’
‘আমি আশাবাদী। ইনশাআল্লাহ করে যাব,’ উত্তর আসে মোজাম্মেল হকের। তখন তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, ‘আপনি আশা দিচ্ছেন, এটা করবেন?’ মন্ত্রী উত্তর দেন: ‘ইনশাল্লাহ করব। মহান পার্লামেন্টেও আমি এই প্রতিশ্রæতি দিয়েছি। স্বাধীনতা বিরোধীদের তালিকাও আমরা করে যাব’।
স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের দাবির বিষয়ে এক প্রশ্নে মোজাম্মেল হক বলেন, ‘জামায়াতের ইসলামের কোনো রাইট নাই… পৃথিবীর কোনো দেশে নাই, যারা স্বাধীনতার প্রত্যক্ষভাবে বিরোধিতা করে ঘোষণা দিয়ে, তারপরও তাদের রাজনীতি করার অধিকার থাকে। আমি মনে করি, তাদেরকে অবশ্যই বাতিল করা উচিত। তাদের সম্পদও বাজেয়াপ্ত করার কথা সংসদে বলেছি। তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্তের বিষয়টি বাস্তবায়নযোগ্য।
জামায়াত নেতাদের অপরাধে তাদের সন্তানদের শাস্তি না দেওয়ার বিষয়ে কারও কারও দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রী বলেন, ‘পিতার অপরাধে পিতার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করব, সন্তানের সম্পদ তো বাজেয়াপ্ত করব না’।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে তাদেরও বিচারের আওতায় আনা দরকার বলে মনে করছেন মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার হয়েছে, যারা সরাসরি গুলি করেছে তাদের। কিন্তু যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে, তাদের বিচার হয়নি।
‘যারা গুলি করেছে, আমরা তাদের বিচার করেছি। কিন্তু যারা উৎসাহ জুগিয়েছে, যে আমেরিকান দূতাবাস সারারাত খোলা ছিল, কি কারণে খোলা ছিল, এটা কি বের করতে হবে না?’ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক সক্ষমতা ও আন্তর্জাতিক অবস্থান দৃঢ় হয়েছে। ইনশাআল্লাহ, আমরা পারব’।
১৯৭১ সালের ১৯ মার্চে জয়দেবপুরে সশস্ত্র প্রতিরোধে জনতাকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আ ক ম মোজাম্মেল হক। সেই প্রতিরোধ যুদ্ধের স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় আলোচনা।
সেই প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রসঙ্গে মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমার জন্য ব্যক্তিগতভাবে যেমন গৌরবের। তেমন জাতির জন্য গৌরবের। এর আগে অন্যরাও প্রতিরোধ গড়েছিল, হয়ত এভাবে অস্ত্র হাতে নয়’।