জালনোট ছড়াতে সক্রিয় চক্র

44

কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে নগরীতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে জালনোট বাজারজাতকারী চক্র। বিশেষ করে কোরবানির পশুর হাট ও ভোগ্যপণ্যের বাজারই তাদের মূল টার্গেট। এদিকে দীর্ঘ প্রায় দুই দশক ধরে বাজারে বিভিন্ন মূল্যমানের জালনোট বিস্তার লাভ করলেও শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায় প্রতারকচক্রের লাগাম টানা যাচ্ছে না। উল্টো প্রতারকচক্র প্রশাসন ও গ্রাহকের চোখে ধূলো দিতে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নিত্যনতুন কৌশলে জালনোট ছাপা ও বাজারজাত করছে।
নগর গোয়েন্দা পুলিশ সর্বশেষ গত সাত জুলাই দিবাগত রাতে এক লাখ ৪৭ হাজার টাকার জাল নোটসহ সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্রের এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। তার নাম মো. শাহ আলম। গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (বন্দর) আবু বকর সিদ্দিকের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে ডবলমুরিং থানার কর্ণফুলী মার্কেট সংলগ্ন এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ বলছে, গ্রেপ্তারকৃত শাহ আলম কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে জাল টাকার ব্যবসায় নামেন। গত তিন বছর ধরেই তিনি নগরীতে জাল টাকার ব্যবসা করে আসছেন। গত সাত জুলাই রাতে নগরীর কর্ণফুলী মার্কেট এলাকায় এক লাখ ৪৭ হাজার টাকার জাল নোট আরেকজনের কাছে হস্তান্তর করতে যাওয়ার সময় তাকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে ডবলমুরিং থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে সহযোগীদের ব্যাপারে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করা হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৯৮ থেকে সর্বশেষ ২০১৯ সাল পর্যন্ত জালনোট সংক্রান্ত মোট মামলা হয়েছে সাত হাজার একশ’ ৬৮টি। এর বিপরীতে ২১ বছরে আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে দুই হাজার তিনশ’ ৭৪টি মামলা। তবে বেশিরভাগ মামলাতেই অভিযুক্তরা আদালতে বেকসুর খালাস পেয়েছেন। তদন্তে দুর্বলতা ও উপযুক্ত সাক্ষির অভাবেই অভিযুক্তরা মামলা থেকে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। আবার আসামি শনাক্ত করতে না পারায় অনেক মামলা অভিযোগ গঠনের আগেই খারিজ করে দিচ্ছেন আদালত। এসব কারণেই জালনোট চক্রের মূলোৎপাটন যেমন সম্ভব হচ্ছে না, তেমনি রোধ করা যাচ্ছে না জাল নোটের বিস্তার। শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায় গ্রেপ্তারকৃতরা জামিনে বেরিয়েও দ্বিগুণ উৎসাহে একই অপরাধ সংঘটিত করছে। জালনোটের বিস্তার রোধে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল পক্ষগুলোর ধারাবাহিক ব্যর্থতার নেপথ্য কারণ অনুসন্ধানে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। জালনোটের মামলা নিষ্পত্তির বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সরকারি-বেসরকারি একাধিক ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও আইনজীবী আলাপকালে জানান, রাষ্ট্রের সাথে প্রতারণার মত স্পর্শকাতর বিষয় হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে জালনোট সংক্রান্ত মামলাগুলোও দ্রæতবিচার আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ওই আইনেই জালনোটের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে হবে। পাশাপাশি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের আরও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের থানা থেকে শুরু করে বিভাগীয় শহর পর্যন্ত সর্বস্তরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতা আরও বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোতে উন্নত ও সর্বাধুনিক জালনোট শনাক্তকরণ মেশিন সরবরাহ করতে হবে। যাতে করে ব্যাংকের মাধ্যমে জালনোটের প্রবাহ বৃদ্ধি করা হলেও গণনায় তা ধরা পড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, জাল নোট সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তির হার খুবই কম। আবার যেগুলো নিষ্পত্তি হয়, সেগুলোতে আসামির আশানুরূপ সাজা হয় না। কারণ আদালতে উপযুক্ত সাক্ষি হাজির করা যায় না। এমনকি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেও অনেক মামলার সাক্ষিকে আদালতে আনা সম্ভব হয়নি। থানায় পুলিশ বাদি হয়ে জালনোট সংক্রান্ত মামলাগুলো দায়ের করে। যথাযথ গুরুত্ব না দেয়ায় তাদের তদন্তেও দুর্বলতা থেকে যায়। তদন্তে দুর্বলতা কিংবা ত্রæটি থাকলে আদালতে আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক সময় আসামি শনাক্ত হয়না। এসব কারণে মামলার নিষ্পত্তি যেমন তুলনামূলকভাবে কম হয়, তেমনি আদালত মামলা খারিজও করে দেন।
ব্যাংক সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ১৯৯৮ সালে দেশের থানাগুলোতে জাল নোট সংক্রান্ত ৭৬টি মামলা দায়ের হয়। বিপরীতে একই বছরে নিষ্পত্তি হয় মাত্র ২২টি মামলা। এরপর থেকে প্রতিবছরই ধারাবাহিকভাবে জাল নোট সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু সেই হারে নিষ্পত্তির হয়নি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ২০১১ সালে। ওই বছর মোট মামলা হয় পাঁচশ ৯১টি। এর আগে ২০০৭ সালে পাঁচশ’ ২১টি, ২০০৫ সালে পাঁচশ’ ১৯টি এবং ২০০৬ সালে পাঁচশ’ দুটি মামলা হয়। ২০১০ সালে দায়ের হয় পাঁচশ’ ৯০টি মামলা। বিগত ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে এক হাজার সাতশ’ ৩২ টি মামলা দায়ের হয়। ২০০০ সালের পর থেকে কোনও বছরই গড়ে পাঁচশটির কম মামলা হয়নি। এর বিপরীতে এক বছরে সবচেয়ে বেশি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ২০০৬ সালে। ওই বছর মোট একশ’ ৯২টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। এছাড়া ২০০৫ সালে একশ’ ৪৮টি, ২০০৭ সালে একশ’ ৪৬টি এবং ২০০৪ সালে একশ’ ১৮টি মামলা নিষ্পত্তি করেন আদালত। সবচেয়ে কম সংখ্যক মামলা নিষ্পত্তি হয় ১৯৯৯ সালে। ওই বছর মাত্র ১৪টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। ২০১১ সালে নিষ্পত্তি হয় মাত্র ৭৭টি মামলা। ২০১০ সালে হয় ৭৩টি। প্রতি বছর নতুন মামলা দায়েরের পাশাপাশি নিষ্পত্তি কম হওয়ায় জাল নোট সংক্রান্ত পেন্ডিং মামলার সংখ্যা বেড়ে ছয় হাজার ছাড়িয়েছে।
চট্টগ্রাম বারের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সাধনময় ভট্টাচার্য পূর্বদেশকে বলেন, জালনোট সংক্রান্ত মামলায় ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড থাকলেও পরে তা সংশোধন করে যাবজ্জীবন কারাদÐ করা হয়েছে। জরিমানারও বিধান আছে। আবার অনেক সময় নিরপরাধ ব্যক্তিকেও হয়রানি হতে হয়। কারণ পুলিশ যার হাতে টাকা পাবে, তার বিরুদ্ধে মামলা করবে। এতে অনেক সময় নিরপরাধ ব্যক্তির ওপর দায় চাপলেও মূলহোতারা আড়ালেই থেকে যায়।’
অপরদিকে মামলার আলামত হিসেবে যে টাকা আদালতে জমা দেয়া হয়, তার স্বত্ব নিয়ে আদালত এবং ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। আদালত মনে করেন, এটি আদালতের সম্পত্তি। অতএব তা সেখানেই সংরক্ষিত থাকবে। অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংকিং নোটের মালিক হওয়ায় জব্দ হওয়া সব জালনোট হাতে পেতে চায়। এ বিষয়ে আইনেও অষ্পষ্টতা রয়েছে। ফলে অভিযুক্ত পক্ষ শাস্তি এড়াতে এ সুযোগকেও কাজে লাগায়।