জালনোট চক্র সক্রিয়

91

এখন পবিত্র রমজান মাস। কয়েক সপ্তাহ পরেই ঈদুল ফিতর। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে ঈদের বাজার। ঈদকে কেন্দ্র করে জাল নোট তৈরিতে মেতে উঠেছে একাধিক অপরাধী চক্র। প্রতারণার মাধ্যমে টাকা লুটে নিতে কোটি কোটি টাকার জাল নোট তৈরি করে বাজার রমরমা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তারা। ঈদকে ঘিরে কয়েক কোটি টাকার জাল নোট ছাড়ার পরিকল্পনা তাদের।
গত ১৫ দিনে চট্টগ্রামে জালনোটসহ ওই চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঢাকার কামরাঙ্গিরচরে গ্রেপ্তারকৃত তিনজন জানিয়েছে, সারাদেশে তাদের সদস্যরা রয়েছে। একটি চক্র চট্টগ্রামে পাঠিয়েছে ৩৫ লক্ষ টাকা। এদিকে জাল নোট তৈরি ও বাজারজাতরোধে মাঠে তৎপর রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিশেষ করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়্যান (র‌্যাব) এই বিষয়ে তৎপর রয়েছে বলে জানা গেছে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর দুই ঈদে জালনোট তৈরি ও বাজারজাতকারী চক্র সক্রিয় হয়ে উঠে। সারাদেশে এ চক্রের অসংখ্য সদস্য রয়েছে। একটি চক্র ঢাকায় তৈরি করে চট্টগ্রাম পাঠায় আর অপর একটি চক্র সরাসরি চট্টগ্রামেই তৈরি করে। তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দু’শতাধিক বাজারজাতকারী। তারা কৌশলে বাজারে জাল নোট সরবরাহ করে। বিনিময়ে কমিশন পায়।
গত শুক্রবার দিনগত রাতে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর ও চকবাজার এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ জাল টাকা ও জাল টাকা তৈরির সরঞ্জামসহ আন্তঃজেলা সংঘবদ্ধ জাল টাকা তৈরি চক্রের দলনেতাসহ ৩ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হল, জীবন ওরফে সবুজ (২৮),জামাল উদ্দিন (৩২) ও বাবুল ওরফে বাবু (২৪)। এসময় তাদের কাছ থেকে ৪৫ লাখ ৬৮ হাজার টাকার জাল নোট, একটি ল্যাপটপ, ২টি প্রিন্টার ও জাল টাকা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, চলতি মাসের শুরুর দিকে চক্রটি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ৩৫ লাখ টাকার জাল নোট পাঠিয়েছে। ওই জাল নোটগুলো ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের বাজারে হাতে হাতে ছড়িয়ে গেছে। চট্টগ্রামে কয়েক কোটি টাকার জালনোট ছাড়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে তারা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. কামরুজ্জামান বলেন, ঈদে জাল নোট চক্র সক্রিয় হয়ে উঠে। তারা তাদের তৈরি এসব জা নোট বাজারে ছাড়ার চেষ্টা চালায়। জাল নোটের কারণে অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তিনি বলেন, এবারে তারা বাজারে এগুলো ছাড়তে পারেে বলে খবর রয়েছে। তবে জাল নোট চক্রকে সনাক্ত করতে আমরা মাঠে রয়েছি। কেউ যাতে জাল নোট বাজারে ছাড়তে না পারে সেজন্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
নগর পুলিশ গত ১৫ দিনে জাল নোট চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তিন লক্ষাধিক টাকার জাল নোট।
কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন জানান, এক শ্রেণির প্রতারক চক্র ঈদ আসলেই সক্রিয় হয়ে উঠে। তারা জাল নোট তৈরি করে মানুষের সাথে প্রতারণা করে। তাদের তৈরি জাল নোট দেখতে হুবহু আসল নোটের মতই। সুক্ষভাবে দেখলেই কেবল বুঝা যায়। তিনি বলেন, জাল নোট নিয়ে আমরা খুবই শক্ত অবস্থানে। সব দিকেই আমাদের নজরদারি রয়েছে। যাতে কেউ এ অপকর্ম করতে না পারে।
গ্রেপ্তারকৃতরা পুলিশকে জানিয়েছে, গ্রেপ্তারকৃতরা জানিয়েছে, দু’ভাবে তাদের হাতে জাল নোট আসে। প্রথমত ঢাকা থেকে, দ্বিতীয়ত চট্টগ্রামেই তৈরি হয়। তারা ৫শ, এক হাজার টাকার জাল নোট তৈরি করতে একাধিক কারখানা গড়ে তুলেছে। তৈরি করার সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে, কম্পিউটার বা লেপটপ, দামি কাগজ, প্রিন্টার মেশিন। আসল নোট থেকে ছাপ দিয়ে হুবহু জাল নোট তৈরি করে তারা।
তারা জানিয়েছে, সেখানে তারা জাল নোট বিক্রি করে ৬০ ভাগ কমিশনে। অর্থাৎ কারখানা থেকে ৫শ টাকার নোট ২শ টাকায় ও ১ হাজার টাকার জাল নোট বিক্রি হয় ৩শ টাকায়। নগরীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতেই প্রতারকরা কাজ করে থাকে। কয়েকটি প্রেসেও তৈরি হয় জালনোট।
জানা যায়, জাল টাকা ব্যবসায়ী চক্রের প্রত্যেকেই পেশাদার। তারা একদিকে জাল টাকার নোট তৈরি করে, অন্যদিকে জাল টাকার ব্যবসাও করে। ওসব চক্রের অনেক সদস্যই এই ব্যবসার সঙ্গে অনেক বছর ধরে জড়িত। তারা নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে জাল টাকা তৈরি করে। ধরা পড়ার ভয়ে তারা এক বাসায় বেশি দিন থাকে না। কয়েক মাস পর পর তারা বাসা বদলে চলে যায় এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায়। সেখানেই গড়ে তোলে জাল টাকা তৈরির কারখানা। সিন্ডিকেটে নারী সদস্যও রয়েছে। প্রতিটি স্তরেই ঐ সিন্ডিকেটের মহিলা সদস্য রয়েছে। কখনো গৃহিণী, কখনো কলেজছাত্রী সেজে জাল টাকা বহন করে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিচ্ছে তারা। আবার তাদের মাধ্যমেই পণ্য কেনাকাটা করে মার্কেটে জাল টাকার বিস্তার ঘটানো হয়। সেজন্য তাদের দেয়া হয় মোটা অঙ্কের কমিশন। ধরা পড়লেও তাদের আইনি সহায়তাও দেয় সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
রেয়াজুদ্দিন বাজারের ব্যবসায়ী মো.শাহজাহান চৌধুরী বলেন, রেয়াজুদ্দিন বাজারে অসংখ্য দোকান রয়েছে। ক্রেতারও ভিড় থাকে। এ সুযোগে প্রতারকরা জাল নোট ঠুকিয়ে দেয়। তবে ব্যবসায়ীরা সতর্ক থাকে। তারপর ঠকে যায়।
র‌্যাব কর্মকর্তা মিমতানুর রহমান বলেন, দেশি বিদেশি একটি চক্র ঈদ এলেই তৎপর হয়ে উঠে। জাল নোট তৈরি ও বাজারজাত করতে মরিয়া হয়ে যায়। এতে প্রতারিত হন ব্যবসায়ীরা। এবারও এধরনের কর্মকান্ড করতে পারে। একারণে আমরা আগে থেকেই সতর্ক অবস্থায় রয়েছি, যাতে কেউ জাল নোট কেউ বাজারে ছাড়তে না পারে।
ব্যবসায়ীরাও সতর্ক অবস্থায় রয়েছেন। টেরিবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল মান্নান বলেন, জালনোটের কারণে অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাড়াহুড়ার মধ্যে নিতে গিয়ে জালনোট ধরিয়ে দেয় প্রতারকরা। তিনি এ ব্যাপারে প্রশাসনকে আরো কঠোর হওয়ার অনুরোধ জানান।