জামিনে মুক্তিতে বন্দীর চাপ কমছে কারাগারে

59

নির্বাচনী ডামাডোল ও অবকাশ শেষে নতুন বছরে আদালতের কার্যক্রম পুনরায় চালু হওয়ার পর রাজনৈতিক মামলায় কারাগারে আটক বন্দীদের জামিন মঞ্জুরের হার তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। বছরের প্রথম সপ্তাহ শেষে প্রায় হাজারখানেক বন্দী কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেছেন। মুক্তি পাওয়া বেশিরভাগ বন্দীকে পুলিশ নির্বাচনের আগে নগরীর বিভিন্ন থানার নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছিল।
কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘সাধারণভাবে আদালত থেকে জামিননামা আমাদের হাতে আসার পর যাচাই-বাছাই শেষে আমরা সংশ্লিষ্ট বন্দীকে মুক্তি দিচ্ছি। আমরা জামিননামা আর বন্দীর রেকর্ডপত্র দেখি। রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিকভাবে আমরা দেখি না। যে ধারার মামলাতেই গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আসুক না কেন, আমাদের কাছে তিনি একজন বন্দী। এভাবেই আমাদের দেখতে হয়।’
কারাসূত্র জানিয়েছে, কারাগার প্রতিষ্ঠার পর থেকে এবারই কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চসংখ্যক বন্দীর চাপ নিতে হয়েছে। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত পাঁচ গুণেরও বেশি বন্দী চাপ সামলাতে কারা কর্তৃপক্ষ হিমশিম খাচ্ছে। কারাগারের মূল ভবনে তৈরি করা কক্ষগুলোতে স্থান সংকুলান না হওয়ায় বারান্দা ও চৌকাতে (রান্নাঘর) পর্যন্ত বন্দীদেরকে রাখতে হচ্ছে। মূলতঃ বিদায়ী বছরের শুরুতে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শুরুর পর থেকেই কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দীর চাপ বাড়তে থাকে। তার আগে গড়ে প্রতিদিন পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার বন্দী থাকলেও গত ২০ ডিসেম্বর এসে বন্দীর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এরপর নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক মামলায় আটকের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে।
এক হাজার আটশ’ ৫৩ জন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্বাচনের ভোটগ্রহণের পরদিন অর্থাৎ সদ্যবিদায়ী বছরের শেষদিন বন্দী ছিল ১১ হাজারের প্রায় কাছাকাছি ১০ হাজার নয়শ’ জন। এতে গাদাগাদি অবস্থা সৃষ্টি হয় কারাভ্যন্তরে। অতিরিক্ত বন্দীর চাপ সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় কারা কর্তৃপক্ষকে।
কারাসূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত পয়লা জানুয়ারি থেকেই আদালতে রাজনৈতিক মামলার আসামিদের জামিন মঞ্জুরের হার তুলনামূলকভাবে বাড়তে শুরু করে। গত ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত নারী ও পুরুষ মিলিয়ে কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন হাজারখানেক বন্দী। এর মধ্যে পয়লা জানুয়ারি সর্বনিম্ন ৬৪ জন এবং ৮ জানুয়ারি সর্বোচ্চ তিনশ’ চার জন বন্দী জামিনে মুক্তি পান। মুক্তিপ্রাপ্তদের তালিকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীমসহ অনেকেই রয়েছেন। তবে, বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলায় আটক বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী, নগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন, সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর, জামায়াত ইসলামীর নেতা আ ন ম শামসুল ইসলাম এবং শাহজাহান চৌধুরীসহ অনেকে এখনও কারাগারে আটক রয়েছেন।
সরকার নির্বাচনের আগে পুলিশকে ব্যবহার করে গণহারে বিরোধী নেতাকর্মীকে সাজানো মামলায় গ্রেপ্তার করার কারণে অতিরিক্ত বন্দির চাপে কেন্দ্রীয় কারাগারে রীতিমত অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল বলে মনে করেন সাবেক পিপি ও বিএনপি নেতা এডভোকেট আব্দুস সাত্তার। তিনি বলেন, পুলিশ সন্দেহজনকভাবে ধরে এনেও অনেককে মিথ্যা ও সাজানো ঘটনার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে বন্দী করেছে। এখন মামলার এজাহারে যেসব নেতাকর্মীর নাম নেই তাদের জামিনে মুক্তি দেয়া হচ্ছে। এর আগে নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে গত ৬ ডিসেম্বর কারাগারে বিদ্যমান বন্দী পরিস্থিতি নিয়ে কারা মহাপরিদর্শকের পক্ষে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ ইকবাল হাসান স্বাক্ষরিত একটি প্রতিবেদন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়। প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে সেসময় বন্দীর সংখ্যা উল্লেখ করা হয় নয় হাজার পাঁচশ’ ৯২ জন। আর কক্সবাজার জেলা কারাগারে বন্দীর সংখ্যা দেখানো হয় তিন হাজার নয়শ’ ৭৫ জন। অথচ এই দুই কারাগারে সর্বমোট বন্দীর ধারণ ক্ষমতা হচ্ছে দুই হাজার তিনশ’ ৮৩ জন। নির্বাচনকে ঘিরে এ সংখ্যা আরো বাড়লে সমস্যা প্রকট হতে পারে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ধারণক্ষমতার তুলনায় মাত্রাতিরিক্ত বন্দী আটক থাকায় বন্দীদের আবাসন সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। অপরাধীর ধরন অনুযায়ী বন্দীদের আলাদা করে রাখার নিয়ম থাকলেও আবাসন সমস্যার কারণে মাদকাসক্ত, বয়স্ক বন্দী ও উগ্রবাদী কর্মকান্ডে জড়িত হিসেবে চিহ্নিত বন্দীদের আলাদা রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এতে কারাগারের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। এছাড়া, বন্দীদের সাথে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতে সমস্যাসহ নানারকম সঙ্কটের উদ্ভব হচ্ছে। এই সুযোগে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা সৃষ্টি হচ্ছে বলে তাতে উল্লেখ করা হয়।