জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস আজ

554

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস আজ ১৭ মার্চ। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু ১৯২০ সালের এই দিন গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জাতি যথাযোগ্য মর্যাদা ও উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে আজ বঙ্গবন্ধুর জন্ম দিবস উদযাপন করবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে বাংলাদেশি দূতাবাসসমূহে দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় উদযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। দিনটিতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য : ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, শিশুর জীবন করো রঙিন’। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর­ রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত সময়কে ‘মুজিব বর্ষ’ হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। খবর বাসস’র
আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে রাজধানীতে বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে রক্ষিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ। এছাড়া ১৮ মার্চ সোমবার আলোচনা সভার আয়োজন করেছে আওয়ামী লীগ। এদিন বিকাল ৩টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সন্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিতব্য আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করবেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়াও প্রতিবারের মত এবারও বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকাল দশটায় টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করবেন। পরে তারা ফাতেহা পাঠ ও মোনাজাতে অংশ নিবেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১২টা ১০ মিনিট পর্যন্ত টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধ কমপ্লেক্সে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম বার্ষিকী এবং জাতীয় শিশু দিবস-২০১৯ উদযাপন উপলক্ষে গোপালগঞ্জ জেলা ব্রান্ডিং-এর লোগোর রেপ্লিকা উপহার হিসেবে গ্রহণ করবেন।
এছাড়াও ‘বঙ্গবন্ধুকে লেখা চিঠি’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন, বঙ্গবন্ধুকে লেখা শ্রেষ্ঠ চিঠি পাঠ, সেলাই মেশিন বিতরণ, ‘আমার কথা শোন’-শীর্ষক ভিডিও প্রদর্শন, জাতীয় শিশু দিবসের আলোচনা সভায় যোগদান ও প্রধান অতিথির ভাষণ প্রদান করবেন প্রধানমন্ত্রী ।
কাব্যনৃত্যগীতি আলেখ্যানুষ্ঠান উপভোগ, শিশুদের ফটোসেশনে অংশ গ্রহণ এবং বই মেলা উদ্বোধন ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের আঁকা বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক চিত্র প্রদর্শনী পরিদর্শন করবেন তিনি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মদিন ও জাতীয় শিশু কিশোর দিবস উপলক্ষে আজ সব সরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের বহির্বিভাগে সকাল সাড়ে আটটা থেকে দুপুর সাড়ে বারোটা পর্যন্ত বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করা হবে। এদিন সকল হাসপাতালে মানসম্মত খাবার পরিবেশন করা হবে। শিশু ওয়ার্ডগুলোকে সুসজ্জিত করা হবে। বিভিন্ন স্থাপনায় ব্যানার ও ফেস্টুন প্রদর্শনের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) এ উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বিনা মূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি ও দোয়া মাহফিল। এছাড়া এদিন বিএসএমএমইউ-এর বহির্বিভাগে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত বিনামূল্যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করবেন।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সারাদেশের প্রতিটি ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলায় কুরআনখানি, দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। ইসলামিক মিশনের ৪৬৩টি মক্তবে এদিন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দিনের কর্মসূচি শুরু হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে বাংলাদেশী দূতাবাসসমূহে দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় উদ্যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
আজ সারাদিন ধরেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের রেকর্ড বাজানো হবে। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে সারা দেশে বিভিন্ন মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং অন্যান্য উপাসনালয়ে প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বিভিন্ন বেসরকারি টিভি চ্যানেল দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। জাতীয় দৈনিকগুলো প্রকাশ করবে বিশেষ ক্রোড়পত্র।
এদিকে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু কিশোর দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪০ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমানে মওলানা আজাদ কলেজ) ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের টিকেটে ইস্ট বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলীর সদস্য নির্বাচিত হন। ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আজীবন সোচ্চার এই অবিসংবাদিত নেতাকে রাজনৈতিক জীবনে বহুবার কারাবরণ করতে হয়।
তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬-দফা ও পরবর্তীতে ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালে গণস্ত‚্যত্থানসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং বঙ্গবন্ধু উপাধি লাভ করেন।
তাঁর সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ধাপে ধাপে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জিত হলেও তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালি জাতির ওপর নানা নির্যাতন শুরু করে। বঙ্গবন্ধু একাত্তরের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। যা ইউনেস্কোর ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য ওয়াল্ড রেজিস্টার’- এ অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
অন্যদিকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে (৬ মার্চ) তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালির বহু আকাক্সিক্ষত বিজয় ও স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
বিংশ শতাব্দীতে নির্যাতিত, নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে যারা বিশ্বনন্দিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের অন্যতম। সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিরামহীন সংগ্রামে অবদান রাখার জন্য তিনি বিশ্বশান্তি পরিষদের জুলিও কুরি পদকে ভূষিত হন।
বিবিসি’র এক জরিপে তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু যখন বিভিন্নমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করতে শুরু করেন ঠিক সেই মুহূর্তে স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত শক্তি ও কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহল তাঁর বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং ওই ষড়যন্ত্রেরই অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে কতিপয় বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার হাতে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নিহত হন।
বিশ্ব গণমাধ্যমের চোখে বঙ্গবন্ধু ক্ষণজন্মা পুরুষ। অনন্য সাধারণ এই নেতাকে ‘স্বাধীনতার প্রতীক’ বা ‘রাজনীতির ছন্দকার’ খেতাবেও আখ্যা দেয়া হয়। বিদেশী ভক্ত, কট্টর সমালোচক এমনকি শত্রুরাও তাদের নিজ নিজ ভাষায় তাঁর উচ্চকিত প্রশংসা করেন।
বিগত বিংশ শতাব্দীর কিংবদন্তী কিউবার বিপ্লবী নেতা প্রয়াত ফিদেল ক্যাস্ট্রো বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ক্যাস্ট্রো বলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি ছিলেন হিমালয় সমান। সুতরাং হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা আমি লাভ করেছি।’ ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় জোট-নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ক্যাস্ট্রোর সাক্ষাত ঘটে।
শ্রীলংকার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী লক্ষণ কাদির গামা (নৃশংস হত্যার শিকার) বাংলাদেশের এই মহান নেতা সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়া গত কয়েক শতকে বিশ্বকে অনেক শিক্ষক, দার্শনিক, দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক, রাজনৈতিক নেতা ও যোদ্ধা উপহার দিয়েছে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সবকিছুকে ছাপিয়ে যান, তাঁর স্থান নির্ধারিত হয়ে আছে সর্বকালের সর্বোচ্চ আসনে।’
রাষ্ট্রপতির বাণী : বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে দেয়া এক বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন উদযাপনের মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম তাঁর জীবন, কর্ম ও আদর্শ সম্পর্কে জানতে পারবে এবং দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আগামীতে জাতিগঠনে অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল শিশু-কিশোরকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, ‘রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু ছিলেন নীতি ও আদর্শের প্রতীক। দেশ ও জনগণের কল্যাণ ও অধিকার আদায়ে জীবনভর সংগ্রাম করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু শিশুদের খুবই ভালোবাসতেন। তিনি জানতেন সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে হলে নতুন প্রজন্মকে সোনার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।’
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উদ্দেশে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, তা ছিল মূলত বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, যা ছিল মূলত স্বাধীনতার ডাক।’
প্রধানমন্ত্রীর বাণী : বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে দেয়া বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশুর প্রতি সহিংস আচরণ এবং সকল ধরনের নির্যাতন বন্ধ করা এবং শিশুদের কল্যাণে বর্তমানকে উৎসর্গ করার আহ্বান জানিয়েছেন। একই ভাবে সবাই মিলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স¦প্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার কথাও বলেছেন তিনি। তিনি বলেন, “সকল শিশুর সমঅধিকার নিশ্চিত করার মধ্যদিয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ দিনটি আমাদের জাতীয় শিশু দিবস। সকল শিশুসহ দেশবাসীর প্রতি জানাচ্ছি আন্তরিক শুভেচ্ছা। প্রিয় মাতৃভূমিকে শিশুদের জন্য নিরাপদ আবাসভূমিতে পরিণত করতে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। শিশুদের মনে দেশপ্রেম জাগ্রত করা, তাদের ব্যক্তিত্ব গঠন, সৃজনশীলতার বিকাশ এবং আত্মবিশ্বাসী করে তোলার লক্ষ্যে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং খেলাধুলার বিভিন্ন শাখায় শিশুদের সম্পৃক্ত করা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধরু জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন পরিষদ : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন আজ। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আজ বঙ্গবন্ধুর ৯৯তম জন্মবার্ষিকী। আগামী বছর জন্মশতবার্ষিকী।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে চট্টগ্রামে একটি জন্মশতবর্ষ উদযাপন পরিষদ গঠন করা হয়েছে। পরিষদে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. অনুপম সেন ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীকে যথাক্রমে চেয়ারম্যান ও নির্বাহী চেয়ারম্যান এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা নাসিরুদ্দিন চৌধুরীকে মহাসচিব করা হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠক অরুণ চন্দ্র বণিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক সুজিত ভট্টাচার্য দোলনকে সমন্বয়কারী করা হয়েছে।
এই পরিষদের উদ্যোগে আজ রবিবার সকালে জামালখান ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে বঙ্গবন্ধুর জন্মোৎসব উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। সকাল ১০টায় কেক কেটে জন্মোৎসবের সূচনা করা হবে। এরপর বঙ্গবন্ধুর বিশাল প্রতিকৃতি নিয়ে র‌্যালি বের করা হবে। পরে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত করে ছড়া উৎসব ও সঙ্গীতাঞ্জলি নিবেদন করা হবে।
অনুষ্ঠানে আওয়ামী পরিবারের সকল সদস্য, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, মুক্তিযোদ্ধা, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী এবং সর্বস্তরের পেশাজীবি, নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠক ও কর্মীদের উপস্থিত থাকার জন্য অনুষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদক নাসিরুদ্দীন চৌধুরী অনুরোধ জানিয়েছেন। খবর বিজ্ঞপ্তির

তোমার কীর্তির চেয়ে
তুমি যে মহৎ
রতন কান্তি দেবাশীষ
তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ/ তাই তব জীবনের রথ/ পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার/ বারম্বার ।
যদি বলি আকাশ কত বড় কিংবা সমুদ্র কত বিশাল, তার উত্তর দেয়া যেমন কঠিন, তেমনি মানুষ হিসেবে তিনি কত বড় কিংবা তার কর্ম কত মহৎ- এসবের উত্তর দেয়াও সত্যিই দুরূহ। আকাশের মতো উদার আর সমুদ্রের মতোই বিশাল ছিল তার হৃদয়ের ঔদার্য। আর তার কর্মই তাকে করেছে মহিমান্বিত।
আজীবন সংগ্রামী বঙ্গবন্ধুর যখন জন্ম হয় তখন ছিল বৃটিশ রাজত্বের শেষ অধ্যায়। গ্রামের স্কুলে তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। ১৯২৭ সালে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। নয় বছর বয়সে ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখানে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিশোর বয়সেই বঙ্গবন্ধু সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে তৎকালীন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেন। এরপর থেকে শুরু হয় তার বিপ্লবী জীবন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর তিনি কলকাতার ইসলামীয়া কলেজে (বর্তমান মাওলানা আজাদ কলেজ) ভর্তি হন। ওই কলেজ থেকে সক্রিয়ভাবে তিনি ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে অর্থাৎ দেশবিভাগের বছর বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। পাকিস্তান-ভারত পৃথক হয়ে যাওয়ার পর শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ যার মাধ্যমে তিনি উক্ত প্রদেশের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন। তিনি ১৯৪৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে তিনি পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের টিকিটে ইস্ট বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হন।
বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আজীবন সোচ্চার এই অবিসংবাদিত নেতাকে বহুবার কারাবরণ করতে হয়। তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা ও পরবর্তীতে ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং বঙ্গবন্ধু উপাধি লাভ করেন। তার সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ধাপে ধাপে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জিত হলেও তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালি জাতির ওপর নানা নির্যাতন শুরু করে।
বঙ্গবন্ধু একাত্তরের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর গণহত্যা শুরু করলে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং তার নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুকে সেই রাতে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে সামরিক আদালতে বিচার করা হয়।
এদিকে তারই নির্দেশিত পথ ও নেতৃত্বে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে সূচিত হয় বাঙালির বিজয়। বিশ্ব মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। বিংশ শতাব্দীতে নির্যাতিত, নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করে যারা বিশ্বনন্দিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের অন্যতম। সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিরামহীন সংগ্রামে অবদান রাখার জন্য তিনি বিশ্ব শান্তি পরিষদের জুলিওকুরি পদকে ভূষিত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডির বাসভবনে কতিপয় বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার হাতে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ শাহাদাতবরণ করেন।
এ উপলক্ষে দেয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন উদযাপনের মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম তাঁর জীবন, কর্ম ও আদর্শ সম্পর্কে জানতে পারবে এবং দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আগামীতে জাতিগঠনে অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল শিশু-কিশোরকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, ‘রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু ছিলেন নীতি ও আদর্শের প্রতীক। দেশ ও জনগণের কল্যাণ ও অধিকার আদায়ে জীবনভর সংগ্রাম করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু শিশুদের খুবই ভালোবাসতেন। তিনি জানতেন সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে হলে নতুন প্রজন্মকে সোনার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উদ্দেশে বজ্রকণ্ঠে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন তা ছিল মূলত বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। বাঙালির আবেগ ও আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, যা ছিল মূলত স্বাধীনতার ডাক।’ তিনি বলেন, ‘ঐতিহাসিক ভাষণের সেই ধারাবাহিকতায় ২৬ মার্চ ১৯৭১ জাতির পিতা ঘোষণা করেন বাঙালি জাতির বহু কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাণীতে শিশুর প্রতি সহিংস আচরণ এবং সকল ধরনের নির্যাতন বন্ধ করা এবং শিশুদের কল্যাণে বর্তমানকে উৎসর্গ করার আহবান জানিয়েছেন। একইভাবে সবাই মিলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স¦প্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার কথাও বলেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘সকল শিশুর সমঅধিকার নিশ্চিত করার মধ্যদিয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে পিতা-মাতা, পরিবার ও সমাজের ভূমিকা অপরিসীম। শিশুর প্রতি সহিংস আচরণ এবং সকল ধরনের নির্যাতন বন্ধ করার জন্যে আজকের এদিনে আমি সকলের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।’ ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির ৯৯তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, ‘এ দিনটি আমাদের জাতীয় শিশু দিবস। সকল শিশুসহ দেশবাসীর প্রতি জানাচ্ছি আন্তরিক শুভেচ্ছা। বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য-‘বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, শিশুর জীবন করো রঙিন।’
শেখ হাসিনা বলেন, শিশুদের জন্য নিরাপত্তা, খাদ্য ও পুষ্টি, আশ্রয় ও সুরক্ষা এবং শিক্ষা ও স¦াস্থ্যের মতো মৌলিক চাহিদা সম্পর্কিত নানাবিধ কর্মসূচিসহ শিশুশ্রম বন্ধ করার লক্ষ্যে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতায় টেকসই উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান করা হচ্ছে। প্রায় শতভাগ শিশু এখন বিদ্যালয়ে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ৯৯তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস ২০১৯ উদ্যাপনের লক্ষ্যে আয়োজিত সব কর্মসূচির সাফল্য কামনা করেন।