জলবায়ু পরিবর্তন, ঝুঁকিতে বিশ্ব

134

এই তো সেদিন বুলবুল চোখ রাঙ্গিয়ে গেল। বুলবুলির গানে নয়, তাণ্ডবের আশঙ্কায় দেশের সমুদ্র ও নদী বন্দরগুলোতে মহাবিপদ সংকেত দেখাতে হয়েছে। দেশবাসী আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। উপকূলীয় এলাকা হতে সরকার তথা প্রশাসনকে নিরাপদে সরাতে হয়েছে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষদের। যাক শেষ পর্যন্ত মহান আল্লার কৃপায় রক্ষা পেল দেশ। অনেকেই বলছেন, সুন্দরবন বুক চিতিয়ে রক্ষা করেছে মহাবিপদ থেকে। ’৭০এর গোর্কির কথা মনে আছে? দেশের দক্ষিণাঞ্চল, বিশেষ করে নোয়াখালী, ভোলা, খুলনা, বরিশালের প্রায় কয়েক লক্ষ লোক মারাপড়ে। সেদিন পল্টন ময়দানে মাওলানা ভাসানি ভাষণে তর্জনী উড়িয়ে পশ্চিমাদের উদ্দেশ্যে করে বলেছিল ‘ওরা কেউ আসেনি।’ আপনাদের আসসালামু আলাইকুম। ’৭০এর গোর্কি পরবর্তী নির্বাচনে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীকে হারিয়ে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। যার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত গড়্ উেঠে। গোর্কিতে ১০ লক্ষ লোক মারা যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল ঐ সকল উপকূলীয় এলাকায় প্রকৃতির প্রতিকুলতাকে ঠেকানোর জন্য পর্যাপ্ত বন ছিল না। ফলে জোয়ারের এক আঘাতে উপকূলীয় এলাকার জনপদে নোনা পানি ঢুকে লক্ষ লক্ষ মানুষ ও গবাদি পশুকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু এবার সুন্দরবন সে বৈরি প্রভাব বুক চিতিয়ে নেয়। রক্ষা করে লক্ষ লক্ষ মানুষের জানমাল। তারপর কী আমাদের বোধোদয় হচ্ছে! আমরা সুন্দরবনকে উন্নয়নের না হত্যা করতে উদ্যোগী হয়েছি। সুশীল সমাজ এ নিয়ে নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতিবাদ করে চলছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা?
এতো গেল দেশের কথা। সারা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বন্যা, খরা, অগ্নিকাণ্ড, অতিবৃষ্টি নানা দুর্যোগে আক্রান্ত। বলা চলে বিশ্ব এখন ধুঁকছে প্রকৃতির করাল ছোবলে। এর মূল কারণ মানুষের উন্নয়ন তৃষ্ণা, উন্নয়নের জন্য ধরিত্রকে যথেচ্ছ ব্যবহার। বণ বনানী, খাল বিল নদী সমুদ্র পাহাড় পর্বত কিছুই বাদ যাচ্ছে না। তার সাথে জীবাষ্ম জ্বালানির ব্যাপক ব্যবহার।
ইতালির ভেনিস নগরীর বিশ্ব শ্রেষ্ঠ পর্যটন নগরী। সেখানে দেখা দিয়েছে আকস্মিক বন্যা। আবার অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলে সপ্তাহ ধরে জ্বালিয়ে পড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে দাবানল। তিন বছর ধরে খরার কবলে পড়েছে ঐ সকল অঞ্চল। আফ্রিকার কোন কোন অঞ্চলে প্রচণ্ড খরা। গবাদি পশু নয় শুধু গণহারে মারা যাচ্ছে বন্যা প্রাণী। সামাজিক মাধমে জানা যায়, প্রায় ২০০ টি হাতি মারা পড়েছে। সাথে অন্যান্য প্রাণী। প্রচণ্ড কষ্টে আছে সে সকল এলাকার মানুষেরা। আবার চীনে ইঁদুর বাহিত প্লেগ রোগের পাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। ভারতের দিল্লীতে বায়ু দূর্ষণের কারণে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে আকস্মিক বৃষ্টি ও বন্যায় জনজীবন থমকে আছে। এইতো ২/৩ মাস আগে বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রভাবে মৃত্যুর সংবাদ আছে। বলা চলে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ডেঙ্গু স্থায়ীভাবে বাসা করে নিয়েছে। এ সকল দুর্যোগের জন্য বিজ্ঞানিরা জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করছেন। তারা আরও বলছেন, বৈশ্বিক উঞ্চায়নের কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জীবনভর স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ নানা ধরনের হুমকির মধ্যে থাকবেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৫০ বছরের বেশি সময়ের মধ্যে ভেনিসে আঘাত হানা সবচেয়ে বড় ও বিশাল জোয়ারের কারণে বন্যা দেখা দেয়। যার উচ্চতা ছিল ছয় ফুট, যার প্রভাবে ভেসে গেলে লোকালয়। ফলে শহরটিতে জরুরি অবস্থার ঘোষণা দেয় প্রশাসন। আবার বিশ্বের অন্য প্রান্ত অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলেস, কুইন্সল্যান্ডের ভয়াবহ দাবানলে ইতিমধ্যে চারজনের মৃত্যু সংবাদ জানা যায়। হাজার হাজার বাসিন্দা বাড়িঘর, অফিস আদালত ছেড়ে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হয়। জানা যায়, ২০১৬ সাল থেকে ঐ সকল এলাকায় তীব্র খরা চলে আসছে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের ধরন ধারণ বদলে যাচ্ছে। ফলে, খরা, আর তারই প্রভাবে দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশে বজ্রপাতের হার যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে মৃত্যুর হার। চলতি মাসে পাকিস্তানে কিছুক্ষণের বজ্রপাতে ১৩ জনের মৃত্যুর সংবাদ আছে। বাংলাদেশে গত এক বছরে অসংখ্য মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়। আর এ সকল হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন ও চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার কারণে। এখন দেশে দেশে জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যু রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। সকলে স্বীকার করছেন, কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে। তারপরও জীবাস্ম জ্বালানির পৃষ্ঠপোষকতাও করছে। এখন জলবায়ু পরিবর্তনে সম্পদ ও প্রাণহানিতে যেমন ক্ষতি হচ্ছে তেমনি হুমকির মাঝে পড়ছে বিশ্বের অর্থনীতি।
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা ও সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্য দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেওয়ায় সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। বিশ্বের অধিকাংশ নেতারা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি নিয়ে সরব। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্রাজিল এক সুরে কথা বলছে। তবে কী ব্রাজিল ভুলে গেছে, বিশ্বের সর্ববৃহৎ চিরহরিৎ বনাঞ্চল আমাজানের ব্রাজিল অংশে ভয়াবহ আগুনের কথা? জলবায়ু পরিবর্তনে পৃথিবীর উষ্ণতা যেমন বাড়ছে, তেমনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েই চলছে। রাজনৈতিক প্রবাকাণ্ডা ও বাগবিতণ্ডা বাদ দিয়ে এখন বিশ্বকে সার্বিকভাবে ভাবতে হবে কিভাবে জলবায়ু পবির্তনের ঝুঁকি হ্রাস করা যায়। সকলকে সম্মিলিত উদ্যোগ নিয়ে কাজ করতে হবে।
লেখক : কবি, নিসর্গিক ও প্রাক্তন ব্যাংক নির্বাহী