জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও আমাদের করণীয়

144

 

জলবায়ু পরিবর্তন সারাবিশ্বের জন্য একটি অশনি সংকেত। বিশেষ কোনো অঞ্চলে বা জনগোষ্ঠীতে নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে পুরো বিশ্বময়। বৈশ্বিক জলবায়ু সুচকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, গেলো ২০ বছরে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কুফলে মারা গেছে ৫ লাখ ২৮ হাজারেরও বেশি মানুষ। ২০২১ সালে জুন মাসে জার্মানির পশ্চিমাঞ্চল, বেলজিয়ামের পূর্বাঞ্চল, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, লুক্সেমবুর্গ ও সুইজারল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে অস্বাভাবিক মাত্রায় বৃষ্টিপাত ও বন্যার কারণে প্রাণহানি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। শুধু জার্মানি ও বেলজিয়ামে ২২০ জনের মৃত্যু হয়। জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) ২০২১ সালের জরিপ বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মারাত্মক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে বিশ্ব। গত ৫০ বছরে বন্যা ও তাপপ্রবাহের মতো দুর্যোগগুলো বেড়েছে ৫ গুণ। এসময়ে দুর্যোগের কারণে মৃত্যু হয়েছে ২০ লাখের বেশি মানুষের। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩ দশমিক ৬৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ সম্পদের। গত ২০ বছরে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় ইথিওপিয়ার খরায়। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত হানা ঘুর্ণিঝড় ক্যাটরিনায় ক্ষতি হয় ১৬৩ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারের। জলবায়ু বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্যানেলের (আইপিসি) বিজ্ঞানীরা বলছেন, বরফের আচ্ছাদন বিলীন হওয়ার কারণে কার্বন নিঃসরনের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। যার ফলে পরিস্থিতি দিনকে দিন বিপজ্জনক হয়ে পড়ছে। সেই সাথে জীব-জন্তুর বিভিন্ন প্রজাতি তাদের আবাসস্থল বদলাচ্ছে। সাগর-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়ছে, দ্রুত হারে বরফ গলছে এবং এর প্রভাব পড়ছে পুরো বিশ্বের প্রাণীজগতের উপর। বিজ্ঞানীদের মতে, সাগর-মহাসাগরের উষ্ণতা ১৯৭০ সাল থেকে অব্যাহতভাবে বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, জীবাশ্ম জ্বালানির বাড়ন্ত ব্যবহার আবহাওয়াকে উষ্ণ করে তুলছে। মানুষের নানা কর্মকান্ডের ফলে পরিবেশে যে বাড়তি তাপ তৈরী হচ্ছে তার ৯০ শতাংশ শুষে নিচ্ছে সাগর। ১৯৯৩ সাল থেকে শুষে নেয়ার এই মাত্রা দ্বিগুণ হয়েছে। অ্যান্ডিজ, মধ্য ইউরোপ এবং উত্তর এশিয়ার হিমবাহগুলোর বরফ ২১০০ সাল নাগাদ ৮০ শতাংশ গলে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইন্টার্নাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের (আইডিএমসি) প্রতিবেদন মতে, ২০২০ সালে ঝড়, বন্যা, দাবানল ও খরার কারণে ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে তিন কোটি মানুষ। আর উৎখাত হওয়া ৮০ শতাংশ মানুষই এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের বাসিন্দা। আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়ন গবেষণা সংস্থার মতে, সমুদ্র-পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের উপকুলীয় এলাকায় জলবায়ু উদ্বাস্তু বাড়বে। যা দেশের ৬৪ জেলার জনজীবনে প্রভাব ফেলবে। জলবায়ু উদ্বাস্তুর কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অন্তত ১৩ লাখ মানুষের উপর প্রভাব পড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চলতি শতকে বিশ্বের উপকুলীয় এলাকার প্রায় ৬০ লাখ মানুষ হুমকির মুখে রয়েছে। কমনওয়েলথের মহাসচিব ব্যারোনেস প্যাট্রিসিয়া বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে বিশ্ব থেকে হারিয়ে যেতে পারে ৪২টি দেশ। জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক সমস্যা হলেও উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর ওপর এর প্রভাব হবে খুবই ভয়ংকর। কারণ এসব দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান, কলাকৌশল এবং পরিবর্তিত পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোর উপাদানের ঘাটতি রয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের জীবন ও অর্থনীতির অস্তিত্বের জন্য একটি হুমকি। জলবায়ু বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্যানেলের (আইপিসি) বিজ্ঞানী ড. জ্যঁ পিয়ের বলছেন, ব্লু-প্ল্যানেট এখন মহাসংকটে। বিভিন্ন দিক থেকে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে এবং এর জন্য আমরাই দায়ী। অতীতের জলবায়ু পরিবর্তনগুলো ছিল প্রাকৃতিক কিন্তু বর্তমান পরিবর্তন মানব সৃষ্ট। বর্তমান সময়ে মনুষ্যসৃষ্ট গ্রীনহাউস গ্যাসের ফলে পৃথিবীর উষ্ণায়নকে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি অন্যতম কারণ ধরা হয়। যাতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধিতে তাপমাত্রা বেড়ে যায়। গত শতাব্দীতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে ২৩ শতাংশ নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে ১৯ শতাংশ ও মিথেনের পরিমাণ বেড়েছে ১০০ শতাংশ। আইপিসির নতুন রিপোর্টের তথ্যমতে, ২১০০ সাল নাগাদ সাগর-পৃষ্ঠের উচ্চতা ১.১ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। আগের ধারণার চেয়ে এর উচ্চতা ১০ সে.মি বেশি। নিচু উপকুলীয় এলাকায় ৭০ কোটি মানুষ বসবাস করে যার কারণে বিষয়টি খুবই উদ্বেগের। তাছাড়া সাগরের তাপমাত্রা বাড়ার ফলে ৯০ শতাংশ প্রবাল ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। গ্লোবাল কোরাল রিফ মনিটরিং নেটওয়ার্কের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, উষ্ণতার প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়া, আরব উপদ্বীপ, অষ্ট্রেলিয়া উপকূল ও প্রশান্ত মহাসাগরের প্রবাল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গবেষণার তথ্যমতে, ১১ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটার (৪ হাজার ৫১৭ মাইল) প্রবালপ্রাচীর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। মাছের শরীরে পারদের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, পৃথিবীর মোট গ্রীনহাউস গ্যাসের মাত্র শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ নিঃসরিত হয় বাংলাদেশে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশই হবে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত শীর্ষ ১০ দেশের একটি। মূলত ভৌগোলিক অবস্থান, বিশাল জনসংখ্যা, দারিদ্র্য ও সামাজিক সুরক্ষার অপ্রতুলতা বাংলাদেশের ঝুঁকিকে প্রসারিত করছে। ২০২১ সালের আগস্টে প্রকাশিত ইউনিসেফের প্রতিবেদন মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে বসবাসকারী শিশু ও তরুণ জনগোষ্ঠী রয়েছে, যা তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুরক্ষাকে হুমকির মুখে ফেলছে। এছাড়াও বৈশ্বিক পর্যায়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৬৫টি দেশের মধ্যে রয়েছে নেপাল ও শ্রীলঙ্কা। প্রতিবেদন মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় ৬০ কোটিরও বেশি শিশুর বসবাস এবং বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠীর বসবাসও এই অঞ্চলে। গ্রীনহাউস গ্যাসের নির্গমন কমাতে প্রয়োজনীয় জরুরী পদক্ষেপ না নিলে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ভুগতে থাকবে। বিশ্বনেতারা জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলা ও বিশ্বকে পুরুদ্ধার করতে ‘বিশ্ব সবুজ চুক্তির’ উপর গুরুত্বারোপ করছেন। সম্প্রতি স্কটল্যান্ডের গøাসগোতে অনুষ্ঠিত কোপ-২৬ জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে ১৯০টি দেশ কার্বন ও গ্রিনহাউস নিঃসরণ রোধে কয়লাভিত্তিক জ্বালানী বন্ধ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বন উজাড় রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সম্মত হন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমন্ত্রণে ২০২১ সালের ২২ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত লিডার্স সামিটে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিশ্বনেতাদের চারটি পরামর্শ দেন। ক. কার্বন নিঃসরন কমানো, খ. জলবায়ুর ক্ষতি প্রশমন গ. পুনর্বাসনে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলারের ফান্ড নিশ্চিত করা এবং ঘ. পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির দিকে মনোযোগী হওয়া। প্রতিবছর বাংলাদেশ জলবায়ু অভিযোজন এবং টেকসই অবকাঠামো নির্মাণে ৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে যা জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় বিশ্বের সব রাষ্ট্রের যৌথ প্রয়াস লাগবে।
২০১৫ সালে তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার বিষয়ে প্যারিস চুক্তি করা হয়। তবু গবেষণা বলছে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা আরো নিচে রাখা না গেলে আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদানের অনিয়মিতকরণ ও অস্বাভাবিকতার কারণে বাংলাদেশেকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের এই অভিঘাত মোকাবেলায় এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। বৃক্ষরোপণ করে বনভূমিকে রক্ষা করতে হবে। কলকারখানার কালো ধোঁয়া নির্গমন কমিয়ে আনতে হবে। সিএফসি নির্গত হয় এমন যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না এমন অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় উপকরণের উৎসে বিনিয়োগ করতে হবে। উপকুলীয় অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণের পাশাপাশি বৃক্ষরোপণ করতে হবে।
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক