জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখছে দুদক

29

পাসপোর্ট আবেদনের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের জমা দেওয়া নথিপত্র সংগ্রহে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখছে দুর্নীতি দমন কমিশন। চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের তিনটি পাসপোর্ট কার্যালয়সহ বিভিন্নভাবে সংগ্রহ করা প্রায় দেড়শ পাসপোর্ট আবেদনপত্রের নথি সংগ্রহ করে এ কাজ শুরু করছে সংস্থাটি।
চট্টগ্রামের মনসুরাবাদ, পাঁচলাইশ ও কক্সবাজার পাসপোর্ট কার্যালয়ে পাসপোর্টের আবেদন করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গা সন্দেহে বেশ কয়েকজন আটক হন। পাশাপাশি অনেকের আবেদন আটকে দিয়েছে পাসপোর্ট অধিদপ্তর।
পাসপোর্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয়তার সনদের মতো শর্তগুলো নিয়েই পাসপোর্ট করাতে আসেন রোহিঙ্গারা। ভুয়া নাম-ঠিকানা নিয়ে সিটি কর্পোরেশন কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় থেকে এই সনদ নিয়ে আসছেন তারা। ফলে পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের ভিড়ে তাদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
পাসপোর্ট আবেদনের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের জমা দেওয়া জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয়তা সনদ সংগ্রহের উৎস খোঁজার চেষ্টা করছে দুদকের তদন্ত দল। এসব সনদ রোহিঙ্গারা কিভাবে সংগ্রহ করেছেন এবং সনদগুলো দেওয়ার ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধি কিংবা তাদের কার্যালয়ের কোনো কর্মকর্তা কর্মচারীর সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, সেসব বিষয় খতিয়ে দেখার অনুমতি চেয়ে চট্টগ্রামের দুদক কার্যালয় থেকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।
দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন জানান, চট্টগ্রামের মনসুরাবাদ পাসপোর্ট কার্যালয় থেকে ৫৪টি, পাঁচলাইশ কার্যালয় থেকে ৭২টি এবং নগর পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে দু’টি পাসপোর্ট আবেদন সংগ্রহ করেছেন তারা। এর পাশাপাশি কক্সবাজার পাসপোর্ট কার্যালয় থেকে ১৮ টিসহ অন্তত ১৫০ পাসপোর্ট আবেদনের সঙ্গে দেওয়া জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম সনদ, জাতীয়তা সনদ সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলো তারা কিভাবে পেয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান দুদক কর্মকর্তা শরীফ। খবর বিডিনিউজের
শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে থাকা ১১ লাখ রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট পাওয়ার কিছু ঘটনা আগেও ঘটেছিল। তখন সতর্কতা অবলম্বনের কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি এক সঙ্গে অনেক ঘটনা ধরা পড়ার স্পষ্ট হয়, সেই সতর্কতায় কাজ হয়নি। এখন সবগুলো কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসেছে। এর তদন্তে ইসির পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়। জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের ওই প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি গতকাল বৃহস্পতিবার প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে।
কমিটির প্রধান এনআইডি উইংয়ের পরিচালক খোরশেদ আলম ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ ২৩৭ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন এনআইডি উইংয়ের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামের কাছে জমা দিয়েছেন তারা।
চট্টগ্রামে একজন রোহিঙ্গা নারীর ভুয়া আইডি ধরা পড়ার পর দু’টি তদন্ত কমিটি করে ইসি। এনআইডি উইংয়ের পরিচালক ইকবাল হোসেন নেতৃত্বাধীন কারিগরি তদন্ত কমিটি এখনও কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এনআইডি উইংয়ের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার সাইদুল বলেছেন, এখন থেকে কাউকে জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার আগে রোহিঙ্গাদের ডাটাবেইসে মিলিয়ে দেখা হবে। এতে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার সুযোগ বন্ধ হবে।
তবে পাসপোর্টের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রের বিকল্প হিসেবে জন্ম নিবন্ধন কিংবা জাতীয়তার সনদও গ্রহণ করা হয় বলে সেখানকার ফাঁকগুলো বন্ধের উপর এখন জোর দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত ৫ সেপ্টেম্বর রাতে চট্টগ্রাম নগরীর আকবর শাহ থানার সিডিএ ১ নম্বর রোড থেকে দুই ভাইসহ তিন রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় বাংলাদেশি পাসপোর্ট। আটক তিন রোহিঙ্গা যুবক কক্সবাজার থেকে নোয়াখালী গিয়ে পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে মামলাটি এখন নগর গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করছে।
থানা পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছিল, টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও চকরিয়ার দুই দালালের মাধ্যমে তারা ফেনীর এক দালালের কাছে গিয়েছিলেন। ফেনীর ওই দালাল তাদের নোয়াখালীর সেনবাগের ঠিকানা ব্যবহার করে পাসপোর্ট তৈরি করে দিতে সহায়তা করেছিলেন। প্রতিটি পাসপোর্টর জন্য তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ৫০ হাজারের বেশি টাকা।
তিন রোহিঙ্গা যুবকের আটকের পর পুলিশ জানতে পারে, তাদের পাসপোর্ট আবেদনের সঙ্গে জমা দেওয়া সব নথিপত্র জাল। তাদের মতো অনেকেই পরিচয় গোপন করে সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ইউনিয়ন পরিষদের জন্ম সনদ, জাতীয়তা সনদ জমা দিয়ে পাসপোর্টের আবেদন করছে। জন্ম নিবন্ধন সনদের কিছু কিছুর তথ্য ডাটাবেইসে থাকলেও আবার কিছু কিছু সনদের কোনো তথ্যের হদিস মিলছে না ডাটাবেইসে।
অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছেন জন্ম নিবন্ধন ডাটাবেইসে ঘাটতি এবং একটি দালাল চক্রের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন সনদ সংগ্রহ করছে। এসব জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয়তা সনদ ব্যবহার করে অনেক রোহিঙ্গা অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন ভোটার তালিকায়। সংগ্রহ করে নিচ্ছেন জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট।
দুদক কর্মকর্তা শরীফ বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা জানতে পেরেছি, কিছু দালাল চক্র টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধন, জাতীয়তা সনদপত্র সংগ্রহ করে দিচ্ছে। এ চক্রগুলোর সহায়তায় রোহিঙ্গারা পাসপোর্টের আবেদন করছে’। দালাল চক্রের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট করতে সহায়তাকারী চট্টগ্রামের তিনটি ট্রাভেল এজেন্সির খোঁজ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন এ দুদক কর্মকর্তা। অনুমতি নিয়েই তাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করার কথা জানান শরীফ।
এই দুদক কর্মকর্তা বলেন, ‘রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট আবেদনের সাথে যেসব জন্ম নিবন্ধন, জাতীয়তা সনদ দিচ্ছে সেগুলোর ব্যাপারে জনপ্রতিনিধিরা জ্ঞাত আছে কি না, সেটি খতিয়ে দেখা হবে। কোনো জনপ্রতিনিধি বা তার কার্যালয়ের কেউ এ ধরনের কাজের সাথে জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’। এছাড়াও রোহিঙ্গাদের হাতে পাসপোর্ট যাওয়ার ক্ষেত্রে পাসপোর্ট কার্যালয়ের কোনো কর্মকর্তা, কর্মচারী জড়িত কি না, সে বিষয়টিও তদন্ত করে দেখা হবে বলে জানান শরীফ।
ইসির কর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ : চট্টগ্রামে এনআইডি জালিয়াতির ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নির্বাচন কার্যালয়ের এক কর্মীকে নিয়ে গেছে তদন্ত সংস্থা কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। গতকাল বৃহস্পতিবার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট কার্যালয়ে মোস্তফা ফারুক নামে ওই কর্মচারীকে ডেকে নেওয়া হয় বলে সংস্থার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন। মোস্তফা ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে আউটসোর্সিংয়ের ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারী। সর্বশেষ তিনি বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ের অধীন হালনাগাদ কার্যক্রমে টেকনিক্যাল সাপোর্ট স্টাফ হিসেবে কাজ করেছিলেন।
কাউন্টার টেররিজমের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ওই কর্মীকে আমরা ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তার কাছ থেকেও আমরা বেশ কিছু তথ্য পাচ্ছি। সেগুলো যাচাই বাছাই চলছে’।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা মামলা তদন্তের স্বার্থে অনেককেই ডাকতে পারি। এখনও কথা বলার সময় হয়নি। শুক্রবার (আজ) মামলার অগ্রগতি নিয়ে বিস্তারিত জানাব’।
এদিকে আগে গ্রেপ্তার নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের কর্মচারী জয়নাল আবেদীনকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে তদন্ত সংস্থা। কাউন্টারে টেরোরিজম কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আদালতের রিমান্ড মঞ্জুরের পর জয়নালকে আমরা হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছি। তার কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সেগুলো আমরা যাচাই বাছাই করছি’।
গত সোমবার রাতে জয়নাল ও তার দুই সহযোগীকে আটক করে পুলিশে দেয় চট্টগ্রাম নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা। জয়নালের কাছ থেকে একটি ল্যাপটপও উদ্ধার করা হয়। জয়নালের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগ আনা হয়েছে। ভোটার তালিকা হালনাগাদে টেকনিক্যাল সাপোর্ট স্টাফ হিসেবে কাজ করে আসা মোস্তফা ফারুক এর আগে ইসির জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের ডেটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। তবে ২০১৬ সালে জালিয়াতি করে এক ব্যক্তিকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে চাকরি হারিয়েছিলেন তিনি। তবে তার বিরুদ্ধে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি চট্টগ্রাম নির্বাচন কমিশন কার্যালয়। এরপর চলতি বছর ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে মোস্তাফা ফারুককে বিভিন্ন উপজেলায় টেকনিক্যাল সাপোর্ট স্টাফ হিসেবে নিয়োগ দেন চট্টগ্রামে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা।
গত জুন থেকে চলতি মাস পর্যন্ত মোস্তফাকে কর্ণফুলী, আনোয়ারা. রাঙ্গুনিয়া, রাউজান ও বোয়ালখালী উপজেলায় আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়।