ছোটদের বড় কবি রবিঠাকুর

162

কঠিন লেখা নয়তো কঠিন মোটে,
যা তা লেখা তেমন সহজ নয়তো।
ছড়াটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘খাপছাড়া’ ছড়াগ্রন্থের। ছড়াটি পড়লে বেশ কিছু বিষয় আমাদের সামনে চলে আসে। প্রথমত, সহজ কথা সহজভাবে লেখা যায় না। সহজ কথা সহজভাবে লেখা মোটেও সহজ কাজ নয়। শিশু সাহিত্যের মূল বিষয়ই হলো সহজভাবে লেখা। শিশুরা যেমন সহজ সরল, তেমনি তাদের জন্যে রচিত সাহিত্যও হবে সহজ সরল। কিন্তু সহজ সরলভাবে লেখা কত যে কঠিন তা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। কঠিন কথা সহজেই লেখা যায়। দ্বিতীয়ত যে বিষয়টি এখানে লক্ষ্যণীয়, তা হল ‘যা তা’ লেখা। শিশুদের জন্য রচিত সাহিত্য কোন বাঁধা ধরা নিয়মে চলে না। মনের ইচ্ছেমত লিখতে হয়। তারা যেমন বাঁধনহারা, তেমনি তাদের জন্যে লেখাগুলোও হবে বন্ধনহীন। তাদের দূরন্ত মন উঠে আসবে লেখায়।

‘বাঙালিকে বার বার রবীন্দ্রনাথের কাছে ফিরে আসতে হয়’ এ কথা আজ প্রকাশ্যদিবালোকের মত প্রতিষ্ঠিত। সাহিত্যের সব বিষয়ে তিনি তার অবদান রেখে গেছেন। তাঁর হাত ধরে আজ বাংলা সাহিত্য বিশ্ব সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত। বাংলা শিশু সাহিত্যও আজ পূর্ণতা প্রাপ্তিতে তার অনেক অবদান। বিশেষ করে ছড়া সাহিত্যে তিনি অদ্বিতীয়। শিশুদের বৈচিত্র্যময় শৈশব যেন উঠে এসেছে তার ছড়ায়। শিশুদের জন্য ছড়া লেখার প্রেরণা তিনি তাঁর শৈশবে পঠিত লোকসাহিত্য থেকে পান। লোকসাহিত্যের বিভিন্ন ছড়া তাঁর শৈশবকে করেছিল রঙিন। এ কথাগুলো তিনি তাঁর ‘ছেলে ভুলানো ছড়া’ ও ‘গ্রাম্যসাহিত্য’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন। লোকসাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য সহজ সরল প্রকাশ ভাব তা-ই রবীন্দ্রনাথকে বেশি আকৃষ্ট করে। ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদে এল বান’ এই লোক ছড়াটি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘এই ছড়াটি বাল্যকালে আমার নিকট মোহমন্ত্রের মত ছিল এবং সেই মোহ আমি এখনো ভুলিতে পারি নাই।’ সে প্রেরণায় তিনি রচনা করেন-

‘বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে ছেলেবেলার গান,
বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান।
কবে বিষ্টি পড়েছিলো, বান এল যে কোথা,
শিব ঠাকুরের বিয়ে হলো কবেকার সে কোথা।’

শিশু, শিশু ভোলানাথ, খাপছাড়া, ছড়া ও ছবি, গল্প সল্প কল্পনা, সহজ পাঠ ইত্যাদি অসংখ্য ছড়া ও কবিতার বই তিনি লিখেছেন শিশুদের জন্যে। তবে তাঁর ছড়াগুলিকে বেশ আলাদাভাবে দেখা হয়। তাঁর ছড়াগুলিতে শিশু মনের বৈচিত্রের প্রকাশ পেয়েছে বেশি। তিনি তাঁর ছড়াগুলোকে মেঘের সাথে তুলনা করেছেন। চোখের সামনে একটি চিত্রকল্প তৈরি করে তিনি লিখেছেন। আমাদের শৈশবের যে কয়েকটা ছড়া আজো আমাদের শৈশবকে স্মৃতিময় করে তুলে সেগুলোর অনেকগুলোয় রবিঠাকুরের রচিত।

আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে,
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে,
পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।
(আমাদের ছোট নদী, সহজপাঠ)

স্কুল ছুটি বাঁধাহীন আনন্দ। ছুটি মানে বিকালের মাঠে ঘুড়ির মত উড়ে বেড়ানো। আর রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-
মেঘের কোলে রোদ হেসেছে
বাদল গেছে টুটি,
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই
আজ আমাদের ছুটি।
(ছুটি)
রবীন্দ্রনাথ তাঁর শৈশবের আনন্দ বেদনাগুলোকে ছড়ার মধ্যে এনেছেন। কারণ তিনি জানতেন প্রত্যেক শিশুর শৈশব হয় প্রায় একি রকম। ফুল, পাখি, আকাশ, নদী ইত্যাদি তাঁর ছড়ায় বিশেষ অর্থ বহন করে। এসব বিষয় যখন কোন ছড়ায় থাকে, তখন সেসব ছড়ায় শিশুরা বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। হয় উপভোগ্য!

দিনের আলো নিভে এল
সূর্যি ডোবে ডোবে,
আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে
চাঁদের লোভে লোভে।
(বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর)

রবীন্দ্রনাথ ‘বীরপুরুষ’ ছড়াটি যেন আমাদের শৈশবেরই একটা অংশ। মাকে নিয়ে এক ছোট্ট খোকার ভাবনা ও সাহসিকতার কথা বলেছেন তিনি এখানে-
মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে,
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে,
দরজাটুকু একটুকু ফাঁক করে,

শিশুদের মন বিচিত্রময় মন। এ মন কখনো চাই পাখির মত উড়তে আবার কখনো চাই মাঝি হয়ে ঔ দূরে হারিয়ে যেতে। এই বিচিত্র ইচ্ছাকে একজন সচেতন খেয়ালি কবি বেঁধেছেন ছড়ার বাঁধনে।

আমার যেতে ইচ্ছে করে
নদীটির ওই পারে,
যেথায় ধারে ধারে।
বাঁশের খোঁটায় ডিঙি নৌকা
(মাঝি)
আবার লিখেছেন-
যখন যেমন মনে করি
তাই হতে পাই যদি,
আমি তবে এক্ষুনি হই
ইছেমতি নদী। (শিশু)

মা’ যেন শিশুদের কাছে সব আবদার, আদরের জায়গা। পৃথিবীর সব ফেলেও তার মা থাকা চাই। মাকে নিয়ে শিশুদের যত স্বপ্ন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেন-

মেঘের মধ্যে মা গো যারা থাকে
তারা আমায় ডাকে, আমায় ডাকে,
আমি বলি, মা যে আমার ঘরে
তারে ছেড়ে থাকব কেমন করে। (মা)

মাত্র আট বছর বয়স থেকে রবীন্দ্রনাথ লেখালেখি শুরু করেন। তাই শৈশবের নানা জিজ্ঞাসা উঠেছে তাঁর ছড়ায়-

তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে,
উঁকি মারে আকাশে
মনে সাধ, কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়
স্কুল যেতে যেতে চুড়িওয়ালাদের দেখে তাঁরও মন চাইত চুড়িওলা হতে। তাদের মত দেশ বিদেশে ঘুরতে।

আমি যখন পাঠশালাতে যাই
আমাদের এই বাড়ির গলি দিয়ে,
দশটা বেলায় রোজ দেখতে পাই
ফেরিওলা যাচ্ছে ফেরি নিয়ে

ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথ গৃহ শিক্ষকের কাছে লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। মাস্টার মশায় সেজে তিনি কত দুষ্টামি করতেন। তিনি ‘মাস্টারবাবু’ ছড়ায় লেখেন-

আমি আজ কানাই মাস্টার
পড়ে মোর বিড়াল ছানাটি।
আমি ওকে মারি নে মা বেত
মিছিমিছি বসি নিয়ে কাঠি।

বিষ্টি কবির একটি প্রিয় জিনিস। শিশু মনে বিষ্টি অনেক প্রভাব ফেলে। আকাশের মেঘ দেখে কবি রচনা করেন অনেক ছড়া।

নীল নব গনে আষাঢ় গগনে
তিল ঠাঁই আর নাহিরে,
ও গো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।

অথবা,
আজি ঝর ঝর মুখরিত
বাদলও দিনে।

‘জন্মকথা’ ছড়ায় তিনি এক খোকার কথা বলেছেন। খোকা মাকে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে-
খোকা মাকে শুধায় ডেকে,
এলেম আমি কোথা থেকে।

তিনি শিশুদের কল্পনা রাজ্যে বিচরণ করেছেন। সেই কল্পনায় রাজ্য তিনি এঁকেছেন ছড়ার ছন্দে-
এক যে ছিল চাঁদের কোণায়
চরকা কাটা বুড়ি,
পুরাণে তার বয়স লেখা
সাতশ হাজার কুড়ি।

রবীন্দ্রনাথের জন্ম ঠাকুর পরিবারে। সেই পরিবার ছিল শিক্ষা, সংস্কৃতিতে বেশ অগ্রগামি। পারিবারিকভাবে লেখালেখি ও বিভিন্ন সৃজনশীল কাজের চর্চা হত। জ্ঞাননন্দিনী দেবীর পরিচালনায় তখন পারিবারিকভাবে ‘বালক’ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশিত হত। সেই পত্রিকার অধিকাংশ লেখা রবীন্দ্রনাথরই হতো। ফলে এ সময়ে তিনি প্রচুর শিশুতোষ ছড়া লিখেছেন, লিখেছেন গল্প, নাটক, উপন্যাসও। তিনি যখন ছোটদের জন্য লিখেছেন তখন তাঁর মনটাকে ছোটদের মত করে চিন্তা করেতেন। তাই তো তাঁর শিশুতোষ লেখাগুলো সত্যিকার অর্থেই শিশুতোষ হয়ে উঠেছে। তিনি ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য নোবেল পেয়েছেন। কিন্তু তাঁর শিশুতোষ লেখাগুলোও কোন অংশে কম নয়। আজ এই আধুনিক যুগে শিশুরা যখন তাদের খেলার মাঠ, গ্রাম হারিয়ে ফেলছে তখন রবীন্দ্রনাথের ছড়াগুলো হতে পারে তাদের জন্য শৈশব রাঙানোর মাধ্যম। শৈশবের স্মৃতি নিয়ে মানুষ বড় হয়। আর যদি শৈশব স্মৃতিময় না হয় তবে সে জীবন হবে একঘেঁয়ে।

আমাদেরকে বার বার ফিরে যেতে হবে রবীন্দ্রনাথের কাছে। সেটা সাহিত্যের যে শাখায় হোক না কেন। শিশুদের জন্য রবীন্দ্রনাথ তৈরি করেছিলেন আলাদা একটা জগৎ। যতদিন শিশু সাহিত্য থাকবে, ততদিন রবীন্দ্রনাথ থাকবেন। তাঁর ছড়াগুলো রাঙাবে শিশুদের কোমল মন। তিনি ছোটদের বড় কবি হয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।