ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক মুহম্মদ আবু তৈয়ব

212

আমরা জানি শিক্ষকই জৈবিক মানুষকে নৈতিক মানুষে পরিণত করেন,মাধ্যম শিক্ষণ নামক উপায় বা পথ,গন্তব্য শিক্ষার্থীর মনন জগত- উৎকর্ষ করার জন্য, উৎভূমিক করার জন্য, সেই রসায়নে শিক্ষকের ভূমিকাই মুখ্য। কিন্তু সেই মানুষ তৈরি করার যিনি মূল শিল্পী ও ছাত্রকে পরিশোধিত করে যিনি নৈতিকতায় , মননশীলতায় মানুষ হয়ে উঠার পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যান, তাদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের উপর অনেকটাই নির্ভর করে- শিক্ষার সফলতা, মানুষ হয়ে উঠার বিষয়টি। এখানেই মনোযোগী হতে হয়, গুরুত্ব দিতে হয়। আবার সম্পর্কে গভীরতা ও সফলতা আসে-পারস্পরিক বোঝাপড়া থেকে। সেই বোঝাপড়ায় প্রয়োজন হয় বোধ-অনুভব,উতসাহ-প্রাণপ্রাচুর্য, উদ্যম-কৌতুহলের। আরো প্রয়োজন হৃদয়ক্ষমতার।
ছাত্র কখনো বড়দের ছোট সংস্করণ বা ছোট ছেড়া কাগজ নয়- যাতে আমরা ইচ্ছা মত কিছু লিখে যেতে পারি, আবার শুধু আমাদের ভাবনায় পরিবর্তন করতে পারি। আগে ছাত্রকে বুঝতে হয়,তার মানসিক উপাযোগিতার বিষয়টি বিবেচনায় মাথায় রেখে।
একজন শিক্ষককে কৃষকের মত চাষের মৌসুম আর জো বুঝে শিষ্যের মননে চাষ করে যেতে হয়। শুধু ভাল জমি আর অনুকূল জলবায়ু থাকলে হয় না, কর্ষণে কৌশলী হতে হয়। বীজ বা চারার প্রকরণকে বিবেচনা করে সেই কর্ষণের কৌশল নির্ধারণ করে তা কার্যকর করতে হয়। তবে এতটুকুতে চললেও সার্থকতা এবং সফলতার সম্ভাবনা বাড়াতেউর্বরতার জন্য, উৎপাদনশীলতার জন্যমাটিতে যে হিউমাস ও পুষ্টির সুষম নানা উপদান থাকে বা দিতে হয় তেমনি শিষ্যের মস্তিষ্কের মনন ভূমিতেও কিছু থাকতে হয় বা দিতে হয়। এই কিছু থাকাটা কী কী, বা কী কী দিতে হয় বীজ বপন বা চারা রোপণের পূর্বের মত-এই দিকে যে শিক্ষকের যত বেশি মনোযোগ থাকে সে শিক্ষক তত বেশি সফল হন। কিন্তু সে দিকেই তো আমাদের আগ্রহ কম। আমরা গড় গড়িয়ে জানার বিষয়গুলোও গড়ে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করতে চাই। শিক্ষার্থীর মানসিক প্রাক্প্রস্তুতির কথা বিবেচনায় রাখার সুযোগ বা সময় হয় না, আবার অবচেতনভাবে নিজেকে নিজে বুঝিয়ে চলি আর ভাবতে থাকি সেই বিষয়টি নিজে বুঝতে পারা মানে শিক্ষার্থীরাও বুঝতে পারা। এই খানে গলদ তৈরী হয়, নৈকট্য অর্জনের মাঝে দেয়াল তৈরী হয়। তাতে শিখণ ফলন ভাল হয় না-শিক্ষক তখন নি®ফলা মাঠের কৃষকে পরিণত হন। একজন শিক্ষক অনুভবে, উপলব্ধিতে, চিন্তায়, চেতনায় ছাত্রের মন-মননকে বুঝতে হয়, জানতে হয়। একজন ছাত্রের বিকশিত হওয়ার, চালিত হওয়ার শক্তি হল, সম্পদ হল তার তারুণ্য। সাহস আর অন্যায়ের প্রতিবাদ ক্ষমতা নিয়ে বেড়ে উঠে। অন্যদিকে স্পর্শকাতর ও স্পর্ধাবধির্ত মন নিয়ে সে পড়ে নানা বিপাকে। তখন তার দুঃসাহসি ও দুর্বিনীত যৌবনের ঔদ্ধত্য আচরণ সাধারণ কারো সহ্য হবার কথা নয়। আবার তার বেড়ে উঠার পথ আগলে দাড়ায় নানা প্রতিবন্ধকতা-দারিদ্র্য, অপসংস্কৃতি, তার সাথে যুক্ত হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির নানা ডামাঢোল ও আবর্জনা। যার জন্য এই সব যুদ্ধে তারুণ্যের অপচয় হয়। হিসাবে দেখা যায় আমাদের মত দেশে তারুণ্যের অপচয় বেশি-সত্তর ভাগের উপরে। সময়, অর্থ, অপচয়ের দুঃচিন্তার চেয়েও তারুণ্য অপচয়ের দুঃচিন্তা বড়-এই অপচয়ের ক্ষতি কখনো পোষাবার নয়।
এই সবকিছু মাথায় রেখে একজন শিক্ষক যখন তাকে নিয়ে কাজ করতে নামেন তখন তিনি হয়ে উঠতে পারেন বিশ্বাস আর শ্রদ্ধার দেবদূত-আর ছাত্রটি হয়ে উঠে তার আত্মার সন্তান। আত্মার সন্তানটি তখন স্বস্তির একটি আশ্রয় খুজে পায়, তার দুর্বিনীত অপার কৌতুহল ও তারুণ্যে ভরা বেয়াডা জীবনটা মেলার কোলাহলে জনকের একটি করাঙ্গালু ধরে হাটার সুযোগ পায়। ছাত্রটির জন্য সেই শিক্ষক তখন অপরিমেয় ঐশ্বর্য নিয়ে হৃদয়বান এক নায়ক হয়ে উঠেন। সেই নায়ককে তারুণ্যে ভরা বিস্ময়ের জগতে ছাত্রটি স্থান করে দেয়, বরণ করে নেয়। শিক্ষক তখন টের পান এই শিষ্যই পারে তার শিক্ষক জীবনকে অর্থময় করে তুলতে, বাচিয়ে রাখতে।
তখন শিষ্যটি তার আপনের চেয়ে আপন হয়ে উঠে, শিষ্যটির হৃদয় তখন শিক্ষকের কাছে দেবালয় হয়ে উঠে। সেখানে তিনি প্রার্থনা করে পূত হয়ে উঠেন। এই রকম জানা অজানা হাজারো ছাত্রের হৃদয়ে তিনি সুখে-দুখে, আনন্দ-বেদনায় নিজের সময় ও মন-মননকে ব্যয়িত করে যান উৎসর্গিত করে যান। সেই দেবালয়ে মালির মত শুধু পানি ডেলে ফুল ফুটিয়ে যান না তিনি।সৃজনশীল বুদ্ধি ও বিশ্লেষনের আলোকে তিনি ছাত্রের মধ্যে জানার অভাব বোধ তৈরি করে যান। যাতে তার ছাত্রটি জানার প্রান্ত সীমার দিকে ধাবমান থাকে-জীবনমুখী আধুনিক ভাবসমৃদ্ধ হওয়ার জন্য, জীবনকে অনুভবে, উপলব্ধিতে ও উপভোগে দক্ষ হয়ে উঠতে পারার জন্য। এতে শিক্ষার্থীর চিন্তা, ভাব ও কাজের বন্ধ্যাত্ব অপসৃত হয়ে যায়। আর শিক্ষকের উজার করে দেওয়া মন-মননের নির্যাস শোষণ করে তার শিক্ষার্থী বেড়ে উঠতে থাকে। আর সেই দেবালয়ে বসে শিক্ষক প্রার্থনা করে চলে, শিক্ষার্থী যেন তাকে অতিক্রম করে যায়, তাকে বিজিত করে আকাশ ছুয়ে যায়। প্রত্যেক শিক্ষকের মনের সেটাই আরাধ্য।
মনে প্রানে সেই আরাধনা থাকে বলে একজন শিক্ষক ঘণ্টার পর ঘণ্টা শিক্ষার্থীকে সময় দিয়ে চলে। তাও আবার চোখাচোখি প্রাণময়তার ভিতর দিয়ে। আমরা যারা পিতা মাতা অভিভাবক তারাও তা দিই বটে কিন্তু তা দিই তদারকির খাতিরে। তাও আবার কয়জনে পারি। তদারকি করে হয়ত বদলাতে পারি, রূপান্তর তো করতে পারি না। এখানেই শিক্ষক শিক্ষার্থীর সম্পর্কের গভীরতা সকল সর্ম্পককে ছাড়িয়ে যায়। যা কখনো অর্থের মানদÐ দিয়ে, প্রভাব প্রতিপত্তি দিয়ে বৃত্তাবদ্ধ করা যায় না। আর শিক্ষক যখন দেখেন তার শ্রম-নির্যাসে তার আরাধনা সার্থক হয়েছ-শিক্ষার্থী সৌন্দর্যে, ব্যক্তিত্বে আর মেধায়, মননে ও সফলতায় অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে তখন গভীর হৃদ্যিক সেই সম্পর্কে পরিতৃপ্তি খোজে পান। আর শিক্ষার্থী ব্যক্তিত্বে, পেশায়, অর্থ-যশ-খ্যাতিতে যতই বড় হয়ে উঠুক না কেন সে তার শিক্ষকের সামনে পড়লে সেই পূর্বের কাঠামোতে ফিরে যায়-প্রথম দিকের তারুণ্যের আবেগে ভরা ছাত্র হয়ে যায়, অবনত হয়ে দাড়িয়ে পড়ে। সেই শিক্ষকের সামনে। শিক্ষক আর শিক্ষার্থীর সম্পর্কের মধ্যে এইভাবে তো হয়ে আসছিল, আসছে সামনেও হবে। কিন্তু তারা তো মন-মননে আর ধারণে পরিপূর্ণ হওয়ার সংগ্রামশীলতার দিকে থাকে। আমরা শিক্ষক বলি বা শিক্ষার্থী বলি কয়জনইবা এখন সেই পরিপূর্ণ হওয়ার দিকে থাকতে পারছি-সেই প্রশ্নই আজ বড় হয়ে উঠেছে।