ছাত্ররাজনীতি দলীয় লেজুড়বৃত্তি পরিত্যাগ করতে হবে

61

আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনা এতটাই মর্মান্তিক ও পৈশাচিক যে এ বিষয়ে বারবার লিখলেও যেন লেখার শেষ হবে না। এই হত্যার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বুয়েটের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের ৩০ জন শিক্ষক লিখেছেন, ‘এই ঘটনার মধ্য দিয়ে পুরো বুয়েটই খুন হয়েছে’। বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য, প্রধ্যক্ষ, ছাত্র কল্যাণ পরিষদের পরিচালক, বুয়েটের অবস্থানরত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আবরারের খুন রোধ করতে পারেন নি। এমনকি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের সেদিন রাতে শেরেবাংলা হলে গিয়েও ফিরে আসতে হয়েছে। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাদের হলের ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। রাষ্ট্রের আইন সেখানে খাটে না। অবশ্য আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নেতা ও অন্যান্য দায়িত্বশীল নেতারা বলেছেন, আরবার হত্যার সঙ্গে জড়িত কেউ ছাড় পাবে না। অপরাধীরা সর্বোচ্চ শাস্তি পাবে। ইতিমধ্যে বেশির ভাগ অপরাধী অবশ্য গ্রেফতার হয়েছে।
দুঃখের সঙ্গে আমাদের বলতে হচ্ছে যে স্বাধীনতার পর দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১৫১ জন শিক্ষার্থী খুন হয়েছে বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৪ জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৯, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯, বাংলদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ২ জন করে, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং হযরত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জন করে শিক্ষার্থী খুন হয়। আগের কথা যদি বাদও দিই, গত টানা ১০ বছরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৪ জন শিক্ষার্থী খুন হয়। যার মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনটির নেতা-কর্মীই বেশি। কিন্তু একটিরও যথাযথ বিচার হয়নি। বিচার হলেও কেউ শাস্তি পায়নি। কেউ কেউ পলাতক অথবা বিদেশে পালিয়ে গেছে (সূত্র : প্রথম আলো)। ১৯৭৩ সালের ডাকসু নির্বাচনে জাসদ-সমর্থিত ছাত্রলীগের সঙ্গে যৌথভাবে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেছিল সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন এই নির্বাচনে ভরাডুবি হবে জেনে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে ছাত্রলীগ। যদিও তখন জাসদ ছাত্রলীগের ওপরই এর দায় চাপানোর চেষ্টা হয়েছিল। বাংলাদেশে সুস্থ ছাত্ররাজনীতির সর্বনাশ শুরু হয় তখন থেকেই। যদিও এই ছাত্রলীগেরই গৌরবময় ইতিহাস ছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং তারও অনেক আগে থেকেই।
১৯৭৪ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিকিৎসার জন্য মস্কো যান। ৪ এপ্রিল রাতে ছাত্রলীগের অস্ত্রধারীরা সূর্য সেন হলের ৬৩৫ নম্বর থেকে ছাত্রলীগের নেতা কোহিনুরসহ ৪ জনকে ‘হ্যান্ডস আপ’ পরিয়ে নিয়ে আসেন মুহসীন হলের টিভিরুমের সামনে। অস্ত্রধারীদের আরেকটি দল ৬৪৮ নম্বর কক্ষ থেকে আরও তিনজনকে একই কায়দায় সেখানে নিয়ে আসেন। রাত ২ টা ১১ মিনিটে ওই সাতজনকে লক্ষ্য করে ‘ক্রসফায়ার’ করেন তারা। এরপর ফাকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
মুহসীন হলে যারা খুন হলেন এবং যারা খুন করলেন, তারা সবাই ছাত্রলীগের। নিহত শিক্ষার্থীরা আওয়ামী যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনির সমর্থক ছিলেন। প্রতিপক্ষ গ্রæপের উসকানিতে শফিউল আলম প্রধান এ কাজ করেছেন বলে অভিযোগ আছে। পরদিন হত্যার বিচারের দাবিতে যে মিছিল হয়, তাতেও তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনদিন পর প্রধান গ্রেফতার হন। হত্যাকারীদের মধ্যে যারা রাজসাক্ষী হয়েছিলেন, তাদের বর্ণনায় উঠে আসে খুনের ভয়ংকর বিবরণ। আওয়ামী লীগ শাসনামলেই মুহসীন হলের সাত হত্যার বিচার হয়। বিচারে প্রধানের যাবজ্জীবন কারাদÐ হয়। কিন্তু জিয়াউর রহমান তাকে ১৯৭৮ সালে মুক্তি দিয়ে আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতিতে মাঠে নামান। এরপর ক্যাম্পাসে শুরু হয় ছাত্রদলের তাÐব। মেধাবী ছাত্রদের জিয়া হিজবুল বাহারে কেন নিয়ে গিয়েছিলেন জানি না। ক্যাম্পাসে খুনোখুনির ঘটনা সব সরকারের আমলেই হয়েছে। ১৯৮৭ সালে ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হন আরও অনেকে। ২০০১ সালে খালেদা জিয়া দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রদলের সন্ত্রাস ও হানাহানি বেড়ে যায়।
সরকার নাসিরুদ্দিন আহমেদ পিন্টুকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়। পিন্টু তখন দলের সাংসদ ও ছাত্রদলের সভাপতি। ২০১০ সালের ২ ফেব্রæয়ারি আওয়ামী লীগ আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীন কোন্দলে খুন হন আবু বকর নামের এক শিক্ষার্থী। তিনি ছিলেন এক দিনমজুরের সন্তান। এ ঘটনায় এফ রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি সাইফুজ্জামান ফারুকসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় শাহবাগ থানার পুলিশ। কিন্তু মামলায় রায়ে ২০১৭ সালের ৭ মে ছাত্রলীগের সাবেক ১০ নেতা-কর্মীর প্রত্যেককে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। ২০১২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কর্মীদের নির্যাতনে অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমদ নিহত হন। তিনিও ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ গ্রæপের কর্মী ছিলেন। ছয় বছর পর হাইকোর্ট অভিযুক্ত পাঁচ ছাত্রলীগের কর্মীকে মৃত্যুদÐ দিলেও সেই রায় কার্যকর হয়নি।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রদল ক্যাম্পাসে খুনোখুনি করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রলীগ একই কাজ করে। আসল রোগ ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল নয়। আসল রোগ হলো ক্ষমতায় নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে ভাবা। আবরার হত্যার বিচার হবে কি হবে না, সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ। কোনো কিছুকে পরোয়া না করা কিংবা আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার যে সংস্কৃতি আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে বিদ্যমান, এ হত্যা তারই বহিঃপ্রকাশ। যারা আবরারকে ছয়-সাত ঘণ্টা ধরে নির্যাতন করে হত্যা করেছে, তারা হয়তো ধরে নিয়েছেন তাদের কিছু হবে না। কেননা তাদের দল ক্ষমতায় আছে। বিএনপির আমলে ছাত্রদলও এরকম ভাবতেন। ছাত্ররাজনীতির নামে এই অপরাজনীতি উচ্চশিক্ষালয়ে আসা শিক্ষার্থীকে শুধু লাশ করে না, খুনিও করে।
বুয়েটে আবরার নৃশংস হত্যার পর, শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি থাকা উচিৎ কিনা, তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে। কেউ বিপক্ষে আর কেউ পক্ষে মত দিচ্ছেন। ছাত্র সমাজের কাজতো শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জন করা ছাত্র সমাজের কাজ তো এটাই। কিন্তু যখন তারা দেখবে জাতীয় স্বার্থ বিপন্ন হচ্ছে তখন তাদের সোচ্চার হতে হবে। একে কখনোই দলীয় রাজনীতির মধ্যে আনা যাবে না। যেমন ছিল ভাষা আন্দোলন, কারণ তখন ছাত্ররা জানত ভাষার অধিকার হলে তাদের দেশের অধিকার। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি ছাত্ররা তখন সংগ্রামে এগিয়ে এলো। তখন রাজনীতিকেরাই বরং ব্যাকফুটে ছিল। জাতির কোনো ক্রান্তিলগ্নে যখন কোনো ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি হয়। যখন ছাত্ররা দেখে তাদের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়েছে তখন তারা এগিয়ে আসতে পারে। এই কিছু দিন আগেই আমরা তাদের নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করতে দেখেছি। স্কুল-কলেজের লাখ লাখ ছোট ছোট ছেলেমেয়ে রাস্তায় নেমে এসে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর চেষ্টা করে। এটা হলো জাতীয় সমস্যা, কারণ প্রতিদিন সড়কগুলোতে যে মৃত্যুর মিছিল চলছে তা বন্ধের দাবিতে তারা আন্দোলন করে। তাই আমরা বলতে চাই ছাত্রদের রাজনীতি করতে হবে জ্ঞানভিত্তিক। এখনকার ছাত্ররাই তো আগামী দিনের নেতৃত্বে আসবে। আমাদের দেশের ক্ষমতায় বা বিরোধী দলে যারা রয়েছেন, তাদের তো বয়স হয়েছে। নতুন প্রজন্মকে নেতৃত্বের জন্য তৈরি করা তাদের কর্তব্য। আরও একটি কথা, রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়কের মধ্যে তফাৎ আছে। নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন রাষ্ট্রনায়ক। ২৭ বছর জেলে ছিলেন, কিন্তু জেল থেকে বের হয়ে তাদের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন যারা তাকে জেলে পুরেছিল। তিনি বলেছিলেন আমাদের হোয়াইটও (সাদা) প্রয়োজন। তাই তিনি, মহান হয়েছেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমাদের উপমহাদেশে এমন দুরদর্শী নেতার অভাব দেখছি। ্আমরা হয়তো মহাত্মা গান্ধীর কথা বলতে পারি। তার অহিংস আন্দোলনের জন্য আমরা তাকে শ্রদ্ধা করি। আব্রাহাম লিংকনের কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি শত্রæকে ক্ষমা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
আমি বলতে চাই আমাদের রাজনীতি, আমাদের স্টেটম্যানশিপ, ছাত্ররাজনীতি এই সবগুলো পরস্পর সংযুক্ত, ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু ছাত্রদের জন্য দলীয় রাজনীতির প্রয়োজন নেই। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা বলা খুব সহজ কিন্তু ছাত্রদের কি অধিকার নেই ? ওদের যখন স্বার্থ নষ্ট হতে দেখবে ওরা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে না ? কোটা বিরোধী আন্দোলন তো ওদের স্বার্থেই। সেটি কি রাজনীতি ? এটা তাদের স্বার্থরক্ষার আন্দোলন, কিন্তু আমরা ছাত্রদের দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি করার বিপক্ষে। জ্ঞানভিত্তিক রাজনীতি থাকবে। জাতির ক্রান্তিলগ্নে তারা এগিয়ে আসবে। এর আলোকে বুয়েটের সাম্প্রতিক হত্যাকাÐটিকে আমি ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে অভিহিত করতে চাই। আবরার ফাহাদ নামের ছাত্রটি নিজের জীবন দিয়ে ছাত্রদের দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি করার পরিনাম সম্পর্কে শিক্ষা দিয়ে গেল। ভিন্নমতকে সহ্য করতে না পারলে কোনো জাতি কখনো সামনে এগোতে পারবে না। ভারতের সাথে বাংলাদেশের চুক্তি নিয়ে আবরার যা নিখেছে সেটি সঠিক না বেঠিক সেই বিতর্কে আমি যেতে চাই না। একজনের বক্তব্য আরেকজনের পছন্দ না-ও হতে পারে। এনিয়ে তার সাথে বিতর্ক করা যায় কিন্তু তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে যায় না।
সমাজের বিকাশের জন্য ভিন্নমতকে সম্মান জানানো জরুরি। যারা আবরারকে পিটিয়ে মেরেছে তারাও মেধাবী ছাত্র। তাদের জন্য আমাদের দুঃখ হয়। এখন এই ১৯ জন ছাত্রের কেরিয়ার ধ্বংস হয়ে গেল। তাদের অনেকে নিম্নবিত্ত ঘরের সন্তান। কেন তাদের নৈতিক ভিত্তি তৈরি করা হলো না। আমরা মনে করি প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মান অনুযায়ী মৌলিক ধর্মীয় শিক্ষা। বিশেষ করে বড় বড় ধর্ম সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া উচিত। তাদের সহনশীলতার শিক্ষা দেয়া উচিত। কোনো ধর্মই মারামারি করতে বলেনি। কিন্তু দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিকে আমরা সমর্থন করি না। দলীয় রাজনীতি ছাত্রদের জন্য নয়। সে যে দলই হোক। ছাত্ররাই আমাদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব দিবে। তাদের যোগ্য করে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। শেষ কথা হলো যে ছাত্রনীতির নামে অপরাজনীতি মেধাবী ছাত্রদের লাশ ও খুনি বানায়, আমরা তার অবসান চাই।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট