ছাত্ররাজনীতির নামে অপরাজনীতি বন্ধ হোক

48

আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও দাবির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষকের সব ধরনের সাংগঠনিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। উপাচার্য ড. সাইফুল ইসলাম গত বুধবার ছাত্রদের আন্দোলনের মধ্যে ক্যাম্পাসে সব ধরনের ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিক নোটিশের মাধ্যমে তা কার্যকর করা হয়। বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি ঘোষণার পর বিভিন্ন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। অনেকে মনে করছেন, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের মাধ্যমে আবরার ফাহাদের হত্যাকাÐের পর বুয়েট প্রশাসনের ব্যর্থতার যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা থেকে বাঁচতে বিভ্রান্তকর এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, দেশের শিক্ষাঙ্গন থেকে শুরু করে মাঠে-ময়দানে যে অরাজক পরিস্থিতিতে বিরাজ করছে তাতে ছাত্ররাজনীতির সব অতীত গৌরব আজ ধূলিসাৎ হওয়ার উপক্রম। অথচ কী গৌরব ও অহঙ্কারের বিষয় ছিল ছাত্ররাজনীতির চেহারা! বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী নব্বই-এর স্বৈরচার বিরোধী আন্দোলনসহ এ দেশের প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল ছাত্ররা। তাদের অবিস্মরনীয় ত্যাগের বিনিময়ে প্রতিটি আন্দোলন সফল হয়েছে। যদিও আশির দশক থেকে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির ছাত্র সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সূচনা করেছিল। তাদের নিপীড়ন নির্যাতনে অনেক প্রগতিশীল এমনকি ধর্মীয় প্রতিপক্ষের নেতা কর্মীরাও খুন-খারাবির শিকার হয়েছেন। এরপরও ছাত্র রাজনীতির বিশাল অংশ সাধারণ মানুষের আস্থায় ছিল। কিন্তু আজ সেইটুকুও স্নান হতে চলছে। সে দিনের ছাত্ররাজনীতি কি আজকের ছাত্রদের প্রেরণা দেয়? বরং ছাত্ররাজনীতিতে এখন চলে অস্ত্রের ঝনঝনানি, ন্যায়-নীতিহীন অসুস্থ সংস্কৃতির চর্চা হয়; যা ছাত্ররাজনীতি তথা গোটা ছাত্রসমাজকে কলুষিত করছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা যায় কীভাবে সেটা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। প্রায় দুই যুগ ধরে অসুস্থ রাজনীতির অন্ধগলিতে ঘুরপাক খাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। সব সময়ই ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদ নিয়েই নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মী। এখন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আছে, অপকর্ম করছে ছাত্রলীগ। যখন বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারে ছিল, তখনো একই কাজ করেছে ছাত্রদল-ছাত্র শিবির।
স¤প্রতি আবরার হত্যাকান্ডের পর ছাত্রলীগের কর্মকান্ড সামনে এসেছে। শুধু বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ড নয়, গত ১০ বছরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ছাত্রলীগ নামধারীদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণে অস্থির বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, সরকারি সম্পদ ধ্বংসসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকান্ডে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আদর্শিক এই ছাত্র সংগঠনটি। টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির অভিযোগে দলটির সভাপতি শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক রাব্বানীকে স¤প্রতি সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল। সর্বশেষ আবরারকে হত্যায় প্রমাণিত হয়েছে যে কত নৃশংস হতে পারে ছাত্রলীগের কতিপয় নেতাকর্মী। হত্যাকান্ডে জড়িতরা বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন পদধারী নেতা। অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রলীগের তান্ডব-সন্ত্রাস পুলিশ দেখেও দেখে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষও তাদের বিশেষ নাক গলাতে চায়না। এভাবে তো চলবে না। বুয়েট প্রশাসন শক্ত হলে আবরারকে হয়তো বাঁচানো যেত। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন খারাবি চাই না, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কেউ খুনি হোক- এটাও চাই না। আমরা মেধার চর্চা চাই, আবার বিশ্ববিদ্যালয় মানবিক আন্দোলন-সংগ্রাম ও মুক্তচিন্তার পাদপীঠ না হয়ে সব ধরনের রাজনীতিমুক্ত হয়ে একটা কূপমন্ডক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হোক-সেটাও চাই না। আমরা মনে করি, সরকারকেও তার ভাবমূর্তির স্বার্থেই শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস মোকাবেলায় কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ কোনো সমাধান নয়। দুর্বৃত্তায়িত শক্তিকে অপসারণ করে ছাত্ররাজনীতি স্বাধীনভাবে করতে দিতে হবে। ছাত্ররাজনীতি বন্ধ নয়, বরং তা লেজুড় মুক্ত করে উন্মুক্ত করে দেয়াই হবে সমাধান।