ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ

2892

অতএব অধ্যয়ন ছাড়া ছাত্র হওয়া যায় না, অধ্যয়নকে তপস্যা-ব্রত মানতে হবে যদি ছাত্র হতে চায়, কোন ছাড় নাই। আর তার জন্য অধ্যবসায় হল বড় এক সাধনা, অধ্যয়নের সাথে অধ্যবসায় অতি নিবিড় সম্পর্কযুক্ত, তাই অধ্যবসায় হল বড় তপঃ। কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের সেই বিখ্যাত চরণ, “দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে?” ঠিক তেমন করে আমরাও বলতে পারি, অধ্যবসায় বিনা অধ্যয়ন হয় কি মহীতে? আবার বলতে পারি গুরু ছাড়া সাধন হয় কি মহীতে, কিংবা শিক্ষক বিনা শিক্ষা লাভ হয় কি মহীতে? অতএব অধ্যয়ন হল ছাত্রদের জন্য তপস্যা আর গুরু বা শিক্ষক হলেন দেবতা, তাই তো বলা হয় গুরু সেবিলে বিদ্যা বাড়ে। কিন্তু হায়, কিছু নিন্দুক, মন্দলোক, কুজন সেটিকে বানিয়েছে, গুরু ছেঁচিলে বিদ্যা বাড়েÑ তাদের মুখে চুনকালি, সেই সাথে গায়ে অনেক ধুলবালি। আর চিন্তা নাই ঐসব বজ্জাত, কুলাঙ্গারদের ভাল করে দিয়ে দিয়েছি গালি। কি সাহস গুরুদের নিয়ে তামাশা করে! কিন্তু হায় আমি একা গালি দিলে কি হবে, নিন্দুকরা তো গুরুদের বিরুদ্ধে দল পাকিয়ে ফেলেছে। এখন আমি যদি তাদের গালি দিই তারা সবাই মিলে নেংটা হয়ে আমাকে গালি দেওয়া শুরু করবে। আর জানেন তো চাটগাঁইয়্যা ভাষায় মাশাল্লাহ্ ঐটার কমতি নাই, তার সামনে আমার গুলা তখন হবে তপ্তমরুতে এক মশক জল। কোঁত করে গিলে ফেলবে তাই ভাবছি সে বিপদে না জড়াই ভাষণ দিয়ে কাম সারাই। নইলে সবাই মিলে আমার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করবে তো করবে সেই সাথে আপন হাত-পা-মাথার হাড্ডির নিরাপত্তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। যেখানে খোদ গুরুদেবতা কেরোসিন হামলার শিকার হয়েছেন সেখানে আমি একদম কোন সৈয়দ বাড়ীর সৈয়দ নূর হয়েছি যে ভক্তিতে আমাকে মাথায় তুলে নাচবে? বাবাগো, যেই কারবার শুরু হয়েছে, পাবনায় শিক্ষককে কিল, ঘুষি, থাপ্পড় মেরেছে, ইউএসটিসিতে গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিয়েছে। আমাকে পেলেই তো মোরগ মুছল্লম বানাবে, কারণ আমি যে শিক্ষকের পক্ষ নিয়েছি, তাই সেরে থাকাটাই নিরাপদ। তবে মজার বিষয় হল উভয় শিক্ষকের নামই মাসুদ, মাসুদুর রহমান আর মাসুদ মাহমুদ।
দেশে এসব কি শুরু হলো আল্লাহ্ই জানেন, কিছুদিন আগে দেখলাম ধানে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়েছে। এখন আবার দেখছি শিক্ষকের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিয়েছে, কেরোসিন মনে হয় সস্তা হয়ে গেছে, ভাগ্য ভালো আগুন দেয় নাই। মনে হয় ডামি ওয়ার্ক তাই আগুন দেয় নাই, ভয় দেখিয়েছে, না হয় আগুন দেয়া কি এমন কঠিন কাজ, মাত্র তো একটি ম্যাচের কাঠি’না। আজকাল সবকিছু দেখছি অত্যন্ত শর্টকাট হয়ে গেছে কোন কষ্ট নাই, একসময় মানুষ কত কষ্ট করে পাকাধানে মই দিত। এখন শুধু এক বোতল কেরোসিন আর একটি ম্যাচের কাঠি, ব্যস আর কষ্ট নাই অটোমেটিক সব শেষ। কিন্তু তা শিক্ষকের উপরও প্রয়োগ করবে, এটি কেমন কথা? কোয়ান্টাম মেথড সহজ পদ্ধতি, বর্তমানে বহুল প্রচলিত একটি শব্দ, সবকিছুতে কোয়ান্টাম মেথড, তাই শিক্ষককেও কোয়ান্টাম মেথড। আচ্ছা বুঝলাম কোয়ান্টাম মেথডে মুহূর্তে সবকিছু ধ্বংস করা যায়, হাজার মাইল দূরের জিনিস দেখা যায় কিন্তু তাই বলে মুহূর্তে পড়ালিখাও শিখা হয়ে যায়? সেদিন একজন এসে বলল তিন দিনে নাকি ইংরেজি ভাষা শিখিয়ে দেবে। আমি বললাম, কি ভাবে? কোয়ান্টাম মেথড, জবাব দিল। আমি বললাম; ও বুচ্ছি। কি বুচ্ছেন? ইয়েস, নো, ভেরিগুড, থ্যাঙ্কু। তার মানে? বললাম, এ চারটা জানলে অনেক্ষণ ইংরেজিতে কথা বলা যায়। অতএব ঐ চারটাই কোয়ান্টাম মেথড, ঐ চারটা ছাড়া আর কোন কোয়ান্টাম মেথড আমার মাথায় আসছেনা। ব্যাটা মুখ কালো করে চলে গেল, আমি বিড়বিড় করে বললাম, ভাঁওতাবাজির আর জায়গা পাওনা। মনে রাখতে হবে ভাঙ্গাতে কোয়ান্টাম মেথড চলে গড়াতে কোন কোয়ান্টাম মেথড নাই, সেটা গোটাই কমপ্লেক্স মেথড। তেমনি শিখাও পুরাটাই কমপ্লেক্স মেথড, সেখানে সহজ কোন পদ্ধতি নাই। এখন সবাই দৌড়াচ্ছে সহজের পেছনে তাই লিখাপড়া না করেই পাশ করতে চাইছে। ফলে ধরছে কোয়ান্টাম মেথড নকল, আর তা করতে বাধা দেয়ায় শিক্ষক খাচ্ছেন ছাত্রের হাতে মাইর। ক্লাস না করাতে পরীক্ষা দিতে না দেয়ায় শিক্ষক হচ্ছেন কেরোসিন হামলা তথা কোয়ান্টাম হামলার শিকার। ৬৮ বছরের বৃদ্ধের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানীর অভিযোগ! মাগো জোয়ান হলে না হয় একটা কথা ছিল। এখন তো প্রমাণ করাই মুশকিল হবে কারণ খেলোয়াড় নরম। তিনি কি হয়রানী করবেন? তিনি তো নিজেই হয়রান হয়ে বসে আছেন, হাহাহা।
এখন সবকিছুতে কোয়ান্টাম মেথড না হয় মানা যায়, কিন্তু শিক্ষক পিটানোর বেলায় যদি সেই মেথড ব্যবহার হয়, তাহলে তো মহাঝামেলা। শরৎ বাবুর ‘বিলাসী’র কথা মনে পড়ে গেল। ছেলেরা পড়ালিখা তো করেই না, ফলে এক্সামিনের খাতায় লিখিয়া আসে এডেন পারসিয়ার বন্দর, আর হুমায়ুনের বাপের নাম তুঘলক খাঁ। তারপর প্রমোশনের দিন মুখভার করিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া দল বাঁধিয়া মতলব করিত মাস্টারকে ঠ্যাঙানো উচিত। দেখা যাচ্ছে শরৎবাবুরাও শিক্ষককে মারার পরিকল্পনা করতেন, তাহলে বিষয়টা নতুন নয় শত বছরের পুরানা। অবশ্য আমাদের সময়ও ছিল, শিক্ষককে ভূত সেজে ভয় দেখাতাম, রাতের বেলায়, হিঁহিঁহিঁ, তিনি তখন উচ্চৈঃস্বরে ক্বুলহু আল্লাহ পড়তেন। ঠিক আছে ছাত্ররা দুষ্টু হয়, দুষ্টামি তো তারা করেই এটি নতুন কিছু নয়, কিন্তু এখন তা আর দুষ্টুমির পর্যায়ে নেই ছাত্ররা এখন হিং¯্র হয়ে উঠেছে, এটি ভয়ঙ্কর। তবে ইতিহাসে গুরুর হিং¯্রতারও প্রমাণ মিলে, তেমন একটি ঘটনা মহাভারতে একলব্যর গুরু ভক্তির কাহিনীটি। “একলব্য ছিলেন মগধের অধিবাসী, জাতিতে অনার্য। অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করতে তিনি একদিন এসেছিলেন অস্ত্র গুরু দ্রোণের কাছে। কিন্তু দ্রোণ ক্ষত্রিয় ছাড়া অন্য কাউকে যুদ্ধবিদ্যা শিখাতেন না। একলব্য ক্ষত্রিয় ছিলেন না সেজন্য দ্রোণ তাঁকে অস্ত্রবিদ্যা শিখাতে সম্মত হন নি। কিন্তু একলব্য বনের মধ্যে মাটি দিয়ে দ্রোণের একটি মূর্তি বানিয়ে সেটিকে গুরু জ্ঞান করে তথায় অস্ত্রাভ্যাস শুরু করলেন। অস্ত্রচালনায় তিনি এত দক্ষ হয়ে উঠলেন চতুর্দিকে তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল, দ্রোণের কানেও গেল সে কথা। দ্রোণ ছিলেন হস্তিনীপুরের বাসিন্দা একলব্য মগধের, মগধের সাথে তখন হস্তিনীপুরের ঘোর শত্রæতা চলছিল। তাই দ্রোণ চাচ্ছিলেন না মগধের কেউ অস্ত্রবিদ্যা পারদর্শী হোক, তিনি একলব্যর কাছে তাঁর দক্ষিণ অঙ্গুষ্ঠটি গুরু দক্ষিণা চাইলেন। সাথে সাথে একলব্য গুরুকে তাঁর ডানহস্তের বৃদ্ধাঙ্গুলিটি কেটে দিয়ে দিলেন! চিরদিনের জন্যে একলব্য শর চালনায় পারদর্শীতা হারালেন কিন্তু গুরু ভক্তির এক অনন্য নজির স্থাপন করলেন।”
ভাগ্য ভাল দ্রোণের ঘটনাটি তখন ঘটেছে, এখন যদি হত একলব্য তাহলে বলত; ‘গুরুজী উপরের নেট ওয়ার্কে মনে হয় জট লেগেছে, জলদি একটু পাগলা পানি খাই আসেন ঠিক হয়ে যাবে।’ হাহাহাহা, তবে দ্রোণ ঠিক করেন নি গুরু নামে তিনি কালি লেপেছেন, অবশ্য ভাল-খারাপ সব সময়েই থাকে। রবিন্দ্রনাথের মাস্টারমশায়’র কথা মনে পড়ে গেল; “অধরলাল আর ননীবালার পুত্র বেণুগোপালকে পড়াইত হরলাল। গ্রামের ছেলে হতদরিদ্র হরলাল অতি কষ্ট করিয়া এন্ট্রান্স পাশ দিয়াছে, কলিকাতা আসিয়াছে কলেজে পড়িবে বলিয়া। বেণুগোপালকে পড়াইবার চাকরিটা পাইয়া তাহার কলেজে পড়িবার রাস্তাটা প্রসারিত হইল, বেণুগোপালের জায়গির মাস্টার, থাকা-খাওয়া, মাসিক পাঁচ টাকা মাহিনা। অল্পদিনের মধ্যে হরলাল বেণুগোপালের অতি প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিল, মাস্টারমশায়ের প্রতি বেণুর মাত্রাতিরিক্ত অনুরাগ অনেকের যন্ত্রণার কারণ হইল। অতএব বেণুদের বাড়ি হইতে মাস্টারকে বিদায় লইতে হইল, এক ইংরেজ সওদাগরী প্রতিষ্ঠানে হরল চাকরি লইল। দিন তাহার ভাল কাটিতে লাগিল বেণুও বড় হইল, ঘটনা ঘটনায় মাস্টারের বাড়িতে বেণুর যাতায়াত বৃদ্ধি পাইল। হরলালের গৃহে অফিসের টাকা থাকিত, তাহা হইতে বেণু একদিন অবস্থার চাপে পড়িয়া গোপনে তিন হাজার টাকা লইয়া ছিল। সেই কথা হরলাল কাহাকেও বলিতে পারিল না, অবশেষে চুরির অপবাদ নিজের মাথায় লইয়া ইহ জগতের মায়া কাটাইয়া সে পর জগতের পথে পা বাড়াইল।” রবিন্দ্রনাথের এই গল্পটি আমার পছন্দ হয়নি, কারণ বেণু টাকা নিয়েছিল বটে, বিনিময়ে সে তার মায়ের প্রচুর গহনা হরলালের ঘরে রেখে গিয়েছিল। হরলাল চাইলে তা থেকে কিছু বিক্রি করে তার তিন হাজার টাকা উশুল করতে পারত। তা না করে সে বেণুর পিতার নিকট সাধু সাজতে গিয়ে বিপদ বাড়িয়েছে, যা সচরাচর ঘটে না। যারা তাকে সারা জীবন এত কষ্ট দিল তাদের কাছে এত সাধু সাজার কি দরকার? তাছাড়া বেণু তো চিঠিতে লিখেই দিয়েছে তার মা’র গহনা হরা বিক্রি করতে পারবে। নাহ্ মজা পাইনি পড়ে, হরলাল কোনভাবেই বেণুকে দায়ী করতে পারে না। তবে একটি কথা গল্পটিতে ছাত্র-শিক্ষকের এক অকৃত্রিম ভক্তি-শ্রদ্ধা ও স্নেহ-ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে যা সাধারণত দেখা যায় না। আজকাল তো গুরু-শিষ্য সম্পর্ক টাকার অংকের চৌহদ্দিতে এসে ঠেকিছে, অংক সবল হলে সম্পর্ক প্রবল হয় অংক দুর্বল হলে সম্পর্ক বিকল হয়। একসময় শিষ্যরা বিদ্যা অর্জন করতে গুরুগৃহে গমন করত, গুরুগণ অতি যত্ন সহকারে শিষ্যদের জ্ঞান দান করতেন। শিষ্যদের একমাত্র কাজ ছিল কঠোর অধ্যবসায় দিয়ে অধ্যয়ন সাধন করা। তাই শ্লোক হয়েছে, ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ। গুরুগৃহে শিষ্যরা থাকত কঠিন জ্ঞান সাধনায় লিপ্ত এবং ভীষণ গুরু সেবায় নিয়োজিত, ফলে গুরু তৃপ্ত হয়ে শিষ্যকে বর প্রদান করতেন। শিষ্য যোগ্য গুরুদক্ষিণা দিয়ে সে বর বরণ করে যথাযোগ্য মর্যাদা নিয়ে নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করতো। এভাবে দীর্ঘ পরিশ্রমের মাধ্যমে তার জ্ঞান সাধনা পূর্ণতা লাভ করত এবং সে নিজেও একদিন গুরুত্ব অর্জন করত। এর কোনরূপ ব্যত্যয় ঘটলে মন্ত্রের সাধন হতো না। কিন্তু এখন হল ডিজিটাল যুগ সেই সাথে এল কোয়ান্টাম মেথড, অতএব অত সময় এখন কারো নাই। সবকিছু এখন শর্টকাট ও দ্রুত, তাই অত পড়ালিখা করা আর ক্লাস করার সময় নাই। নকল করে পারে কিংবা ক্লাশ না করেই, পরীক্ষা দিয়ে হোক অথবা না দিয়ে, দরকার পাশ। তার জন্য প্রয়োজনে গুরুকে ছেঁচিয়ে বিদ্যা বের করতে হবে, দ্রুত এবং সহজে, ডান্ডা বা কেরোসিন যা দিয়েই হোক। আহা এক সময় গুরুর জন্য দিতে যেত শিষ্য তার জান, এখন সে আবার নিতে চায় শিক্ষাগুরুর প্রাণ। অতএব গুরু সেবিলে এখন আর বিদ্যা বাড়ে না গুরু ছেঁচিলেই বিদ্যা বাড়ে, তাই তো চারিদিকে এখন কেবল গুণীদের ছড়াছড়ি, বাতাসে লাশের গন্ধ আর ধন নিয়ে কাড়াকাড়ি। জলাশয়ে মানুষের মৃত দেহ, স্বজনের সন্ধান পায় না কেহ।
লেখক : কলামিস্ট