চৈত্রের খরতাপের পারদ চড়ছেই

54

বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া মরণঘাতী ভাইরাস করোনার আতঙ্ক এবার যেন চৈত্রের খরতাপের অস্বস্তিকে ভুলিয়ে রেখেছে। দেশের ১২ জেলার ওপর দিয়ে চলতি কালবৈশাখী মৌসুমের প্রথম মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে চললেও মানুষের মনজুড়ে ভর করে আছে করোনা আতঙ্ক। খরতাপের অস্বস্তির চেয়ে তাই করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিমুক্তিই এখন মানুষের কাছে সবচেয়ে আরাধ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনা-পরিস্থিতি যেদিকেই যাক না কেন, আবহাওয়ার অবস্থায় তাপমাত্রার ঊর্ধ্বমুুখি প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, গত ১৫ মার্চ ফাল্গুনের বিদায়লগ্নে চলতি কালবৈশাখী মৌসুমে দেশের সর্বোচ্চ ৩৬ দশমিক সাত ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল সমুদ্রউপকূলবর্তী অঞ্চল সীতাকুন্ডে। এরপর খানিকটা নিম্নমুখি হলেও সপ্তাহের ব্যবধানে ফের বাড়তে শুরু করে সূর্যের তেজ। সর্বশেষ গত শুক্রবার দেশের সর্বোচ্চ ৩৭ দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ঢাকা বিভাগের ফরিদপুরে।
এটাই চলতি মৌসুমে এ যাবত দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। অবশ্য, চট্টগ্রাম বিভাগের রাঙামাটি পার্বত্য জেলা বাদে বাকি সবকটি অঞ্চলে তাপমাত্রার পারদ ৩১ থেকে ৩৫ দশমিক সাত ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরেই উঠানামা করেছে।
গতকাল রবিবার রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় দেশের সর্বোচ্চ ৩৭ দশমিক চার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৬ দশমিক চার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল সীতাকুন্ডে।
অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, সীতাকুন্ড ও রাঙামাটি অঞ্চলসমূহের উপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। যা আগামী কয়েকদিন অব্যাহত থাকতে পারে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে বলে পূর্বাভাসে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সাথে বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিমাণও বেশি হওয়ায় গরম অনুভূত হচ্ছে সারা দেশজুড়ে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান আবহাওয়ার বিরাজমান অবস্থায় কয়েকটি জেলার উপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে জানিয়ে পূর্বদেশকে বলেন, শনিবার থেকে শুরু হওয়া সপ্তাহটি তাপপ্রবাহের মধ্য দিয়েই অতিবাহিত হতে পারে। তবে, এর মধ্যে কোনও কোনও এলাকায় তাপমাত্রার সামান্য হেরফেরও হতে পারে। সারাদেশে অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। রবিবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে পরবর্তী আটচল্লিশ ঘণ্টায় কোনও কোনও অঞ্চলে দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে। আর বর্ধিত পাঁচদিনের আবহাওয়ার অবস্থায় তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।
এর আগে আবহাওয়া অধিদপ্তরের তিন মাস (মার্চ, এপ্রিল ও মে) মেয়াদী পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, মার্চে সামগ্রিকভাবে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের আলামতই বিদ্যমান রয়েছে। দিনের তাপমাত্রা এ মাসে স্বাভাবিক (৩৪-৩৬ ডিগ্রি) অপেক্ষা সামান্য কম থাকার সম্ভাবনা আছে। তবে মাসের শেষের দিকে দেশের পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ওপর দিয়ে একটি মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। এ মাসে রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য বেশি থাকতে পারে। মাসের শেষ সপ্তাহে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাতজনিত কারণে আকস্মিক বন্যার শঙ্কা রয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। তারপরের এপ্রিল মাসের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এ মাসে দেশে স্বাভাবিক থেকে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে। পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দুটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে একটি রূপ নিতে পারে ঘূর্ণিঝড়ে। পুরো মাসজুড়ে দেশের উত্তর থেকে মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত দুই থেকে তিনদিন বজ্রপাতসহ মাঝারি থেকে তীব্র কালবৈশাখী অথবা বজ্রঝড় এবং দেশের অন্যত্র চার থেকে পাঁচদিন হালকা থেকে মাঝারি কালবৈশাখী বা বজ্রঝড় হতে পারে। পাশাপাশি দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং অন্যত্র এক থেকে দুটি মৃদু বা মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।
সর্বশেষ মে মাসের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এ মাসে দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের লক্ষণই বিদ্যমান রয়েছে। একই সময়ে বঙ্গোপসাগরে পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দুটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে একটি রূপ নিতে পারে ঘূর্ণিঝড়ে। মে মাসজুড়ে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে দুই থেকে তিনদিন মাঝারি থেকে তীব্র কালবৈশাখী এবং দেশের অন্যত্র তিন থেকে চারদিন হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার কালবৈশাখী ঝড় হতে পারে। পাশাপাশি দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এক থেকে দুটি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং অন্যত্র দুই থেকে তিনটি মৃদু বা মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।
এবার কালবৈশাখী মৌসুম শুরু হওয়ার পর গত ৩ মার্চ ভোরে প্রথম শিলাবৃষ্টির দেখা মেলে। ওইদিন ভোরের আলো না ফুটতেই মাদারীপুরের শিবচর, ফরিদপুর ও চাঁদপুরে কয়েক মিনিট স্থায়ী শিলাবৃষ্টি হয়েছে। এতে আমের মুকুল ও ফসলের ক্ষেতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পরদিন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সাত জেলার ওপর দিয়ে কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যায়।
চট্টগ্রাম বিভাগের চাঁদপুরে শিলাবৃষ্টির দেখা মিললেও সদরসহ অধিকাংশ এলাকায় এখনও কালবৈশাখী ঝড়ে আক্রান্ত হয়নি। বরং এখানকার উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতেই গত কয়েকদিন ধরে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হচ্ছে। শিলাবৃষ্টির পরদিন অর্থাৎ গত ৪ মার্চ রাতে ঢাকা ছাড়াও ফরিদপুর, মাদারীপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইলসহ আশপাশের এলাকার ওপর দিয়ে মৌসুমের প্রথম কালবৈশাখী ঝড় আঘাত হানে। এসময় কোথাও ঝড়ো বাতাসের গতি, আবার কোথাও বৃষ্টির দাপট বেশি ছিল।
প্রকৃতি বিশারদদের মতে, নামে বৈশাখ যুক্ত থাকলেও শীতের বিদায়ের পর ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, সমগ্র পূর্ব এবং উত্তরপূর্ব ভারতে যে ঝড় বয়ে যায় তাই কালবৈশাখী। বাংলা বর্ষের শুরুতে মানে বৈশাখ মাসে এ ঝড় তুলনামূলকভাবে বেশি হয় বলেই এ ঝড় কালবৈশাখী নামে পরিচিত লাভ করেছে। কালবৈশাখীর আসল নাম, ‘নর-ওয়েস্টার।’ অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে এই ঝড় ধেয়ে আসে বলে একে বলে ‘নর-ওয়েস্টার’। তাই বলে কালবৈশাখী শুধুমাত্র বৈশাখ মাসেই (১৫ এপ্রিল থেকে ১৫ মে পর্যন্ত) দেখা যাবে- এমনটি নয়। কালবৈশাখী এবং সাধারণ ঝড়ের মধ্যে পার্থক্য বিচার করার কিছু মাপকাঠি রয়েছে।
মোটা দাগে বলা যায়, ঝড়ের গতিবেগ ঘণ্টার ৫০ কিলোমিটারের বেশি এবং স্থায়ীত্ব অন্তত একমিনিট হলে সেটাই কালবৈশাখী ঝড়।
উল্লেখ্য, এশিয়া অঞ্চলের আবহাওয়াবিদরা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রাকে তীব্র তাপপ্রবাহ, ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মাঝারি এবং ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মৃদু তাপপ্রবাহ হিসেবে গণনা করেন।