চুল নিয়ে চুলকানি চুলে সব ঝলকানি

307

দেশে দেখছি ঘটনার শেষ নাই, ফলে আমাদের বিষয়বস্তুরও অভাব নাই। ব্যাংক, শেয়ার বাজার, বালিশ, বøাউজ, ধান, চামড়া, গুজব, গজব, বন্যা, কেরোসিন, কল্লাকাটা, ছেলেধরা, ধর্ষণ, ইত্যাদি হাজার হাজার। সেই সাথে আরো আছে গ্রীনল্যান্ড, বিমানবন্দর, অফুরন্ত হীরার ভাÐার, ঠিক আছে সেসব নিয়ে কালেভদ্রে কিছু বিশ্লেষণ করছি সমস্যা নাই। কিন্তু ওসব বিশ্লেষণের ফাঁকে যে হঠাৎ চুল নিয়ে চুলকানির কারণ সন্ধানে চুলচেরা বিশ্লেষণে বসে যাব তা ভাবিনি কখনো। কি করব, হঠাৎ করে আমাদের পুলিশ প্রশাসন চুলের পেছনে উঠেপড়ে লেগেছেন, অন্তত আট জেলায় ঘোষণা করেছে ‘বখাটে কাট’ দেয়া যাবে না। মাগো সেটা আবার কোনটা, বখাটেরা চুলে কি বিশেষ কোন কাট দেয় নাকি? জানি না, তবে মিডিয়ায় যা এসেছে পুলিশ যেগুলোকে বখাটে কাট বলছে সেই সব মূলত বিভিন্ন নায়ক, উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি কিম জং উন কিংবা বাংলার সর্বকালের সেরা কণ্ঠশিল্পী মাহফুজুর স্টাইল। উনারা কি বখাটে? তবে মাহফুজুর কিÑ জানি না, তাঁর তো আবার অনেক গুণ। বগুড়ায় দেখলাম পার্ক থেকে ৩২ ছেলে-মেয়েকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল অভিভাবকের জিম্মায় ছেড়েছে। মাশাল্লাহ পুলিশ চমৎকার সামাজিক দায়িত্ব পালন করছে, অনেকে বাহবাও দিচ্ছে। ঠিক আছে সমস্যা নাই, তবে একাজগুলো বিশেষ করে চুলে হাত দেওয়ার কাজটা মার্শাল্ল সরকারের সময় দেখা যায় বেশি সম্পাদিত হয়। শুনেছি আইয়ুবখান যখন প্রথম মার্শাল্ল জারি করলেন তৎকালীন যুবসমাজের দীলিপকুমার স্টাইল, ওয়াহিদ মুরদ স্টাইল সব কাঁচি মেরে মাহফুজুর স্টাইল বানিয়ে দিয়েছিল। অবশ্য তখন মাহফুজ ছিল না, ডিজাইনটার নাম ছিল চাম ছাঁটা। দেখুন কি কাÐ আইউব খানের নিকট কায়দাটা ছিল প্রসিদ্ধ আমাদের পুলিশের কাছে এখন তা হল নিষিদ্ধ। অর্থাৎ ফ্যাশন তথা ঢঙেরও স্থান-কাল-পাত্র আছে, এককালে যা প্রসিদ্ধ অন্যকালে তা নিষিদ্ধ। আবার উত্তর কোরিয়ায় কিম জং উন ছাঁট প্রসিদ্ধ আমাদের দেশে তা নিষিদ্ধ। ফলে একেক যুগের একেক তাল একেক দেশের একেক হাল।
১৯৮০’র দশকের গোড়ার দিকে আমাদের চিরতরুণ, রোমান্টিক রাষ্ট্রপতি কবি এরশাদ যখন ক্ষমতা গ্রহণ করলেন দেখলাম তিনিও চুলে হাত দিয়ে বসলেন। বুঝি না মার্শাল্ল খালি চুলকে রুষে কেন? জানি যার যেটা নাই সে সেটাকে হিংসা করে, টেকো চুলভর্তি মাথাকে হিংসা করে। অতএব সেনাবাহিনী যেহেতু ডিজাইন করে চুল রাখতে পারেনা তাই ঢং করা চুল দেখলে মনে হয় তাদের চুলকায়। ফলে শুধু শুধু জনতার সাথে শুরু করে চুলোচুলি, এরশাদের সময় আমাদের কলেজের এক শিক্ষক বয়সে তরুণ। তিনি আবার মিঠুন ঢঙেই (মিঠুন চক্রবর্তী) চুল কাটতেন, ওমাÑ একদিন দেখি কি তিনি মাহফুজ হয়ে গেছেন, হাহাহা। এরশাদ কেবল পুরুষের চুলে নয় নারীদের পেটেও হাত দিয়েছিলেন, যাদের পেট দেখা যেত পেটে আলতা লাগিয়ে দিত। তবে দুঃখ হল আমাদের কমার্স কলেজের রহিম স্যারেরও সে অভ্যাস ছিল, লম্বা চুল একদম দেখতেই পারতেন না। তাই আমরা কমার্স কলেজের নাম দিয়েছিলাম রহিম স্যারের মাদ্রাসা। কি যন্ত্রণা, স্কুল ছেড়ে কলেজ এসে হতে চাইলাম মাকাল, তিনি মোদের এনে দিলেন দুঃখ ভরা আকাল। হায়রে কপাল, কেন যে নিয়েছি কমার্স, কাটছে সময় দুঃখে যে বারমাস।
দুঃখের এখানে শেষ না, শুনলাম মেয়েরা এ সেকশন আর ছেলেরা বি সেকশনে থাকবে। তবে মেয়েদের নেওয়ার পর আসন খালি থাকলে সেখানে ছেলেদের নেওয়া হবেÑ শর্ত সাপেক্ষে। এটা কি কোন কথা হল, লেগে গেল না প্যাঁচ? আরে ভাই মেয়ে যত আছে সমান ভাগ করে অর্ধেক তার এ আর অর্ধেক তার বি’তে দেবেনÑ এটাই তো গণতন্ত্র। না, তা না করে চালায়ে দিলেন স্বৈরতন্ত্র। এখন কোন ছেলেটা বি সেকশনে যেতে চাইবে? সবাই এখন হা করে রয়েছে এ সেকশনে ঢুকার জন্য। না থাকবে কি, সারা জীবন পড়ে এলাম বয়েজ স্কুলে এখন কলেজে এসেও কি তা-ই করব? বলেছিলাম শর্তসাপেক্ষে কিছু ছেলেকে এ সেকশনে নেয়া হবে, সেখানে করেছে বিশেষ নিয়মÑ ছাঁকন পদ্ধতি। ছাঁকবেন রহিম স্যার, একেবারে চুনে চুনে বাছাই করবেন এ সেকশনের যোগ্য দেখে। হল তো এবার, বারটা বেজেছে না?
অতএব এ সেকশনে যাওয়ার প্রথম ও প্রধান শর্ত হল রহিম স্যারের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া। এটি সকলে জানি চুলের প্রতি স্যারের বিশেষ এলার্জি রয়েছে, তাই বাছাইয়ের আগের দিন সেলুনে গিয়ে হালের মাহফুজ ছাঁট দিয়ে এলাম। পরদিন নারিকেল তেল দিয়ে সিঁথি করে ননইন শার্টে অতিভদ্র বেশে স্যারের সম্মুখস্থ হলাম। আমাকে আগাগোড়া দেখে স্যার সিধা বি সেকশনে পাঠিয়ে দিলেন। মাথা কি আর ঠিক থাকে, ঠাটা একটা পড়ে গেলো না বিশাল বড় মাথার উপর? মুহূর্তে সব শ্রম পÐ হয়ে গেল, কি যে করতে ইচ্ছা করছিল তখন বলতে পারব না। থাক না বলি উনাকে আবার আমি ভীষণ শ্রদ্ধা করি। পরে ঠাটা থেমে মাথা যখন ঠাÐা হল বুঝলাম, অতি ভক্তি যে চোরের লক্ষণ স্যার তা বুঝে ফেলেছেন। আর বুঝবেন নাই বা কেন, সারা জীবন তো কেবল এই কামই তো করে আসছেন, বানর চরানো। তবে দুঃখ এত চেষ্টা করেও স্যারকে ধোঁকা দিতে পারলাম না, উল্টা তিনিই আমাকে বোকা বানিয়ে দিলেন, হাহাহা। ফলে বুঝা যাচ্ছে চুল চরিত্র নির্ধারণ করেনা, পোশাক স্বভাব নির্ধারণ করেনা যদি করত স্যার আমাকে এ সেকশনে দিয়ে দিতেন। তাহলে মার্শাল্ল আর পুলিশ কেন চুল দিয়ে চরিত্র নির্ধারণ করে বুঝলাম না। যদিও স্যার চুলকে রুষতেন কিন্তু চুলে ধোঁকা তিনি খেতেননা বরং আমরা বোকা হতাম। থাক বোকা না হয় আমি হয়েছি, আমাদের অনিল কিন্তু মাশাল্লাহ্ বাপের বেটা, বাঘের বাচ্চা। চলুন এবার তাহলে অনিলের গল্প শুনিÑ
আমাদের এমদাদ দারোগাÑ মাশাল্লাহ্ প্রখর ব্যক্তিত্ব, দাপটে তাঁর বাঘে আর মোষে একঘাটে জল খেত। তা হল কি চুলের প্রতি তাঁরও বড় এলার্জি ছিল, উদ্ভট ফ্যাশনে, উগ্র ভূষণে চুল দেখলেই তাঁর চুলকানি শুরু হয়ে যেত। নেমে পড়তেন এ্যাকশনে, বখাটেদের একদম সিধা করে ফেলতেন, চুল ছেঁটে মাথা জং উন হেড বানিয়ে দিতেন। ফলে অনেক অভিভাবক তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যেত এবং ধন্যবাদ টুকু দিতে মোটেই কার্পণ্য করত না তাই দারোগা বড়ই আত্মশ্লাঘায় মগ্ন থাকতেন। তার প্রভাবে দারোগার দাপট ও কর্তৃত্ব আরো বিস্তার লাভ করল। উদ্ভট পাঙ্কু জামা, চুলের কাটিং দেখলেই তৎক্ষণাৎ কর্তৃত্বের প্রয়োগ ঘটাতেন। আমাদের পাড়ার ফ্যাশনবয় অনিল, বড় অদ্ভুত তার চুলের ছাঁট, রাহুল কাট রঙের হাট, নামও করেছে কাটছাঁট অনিল থেকে অনু। একদিন অনু পড়ল এমদাদ দারোগার সামনে দারোগা সোজা সেলুনে নিয়ে অনুকে বানিয়ে দিলেন কিম জং উন। বখাটেদের ধরে তিনি এমনই করতেন ফলে তারা তাঁকে এড়িয়ে চলত। অদ্ভুত বিষয় হল অনুর ঘটনার সপ্তাহ দুই পর থেকে দারোগাকে আর রাস্তায় দেখা যাচ্ছিল না। দারোগার যেহেতু দারোগাগিরি নাই বখাটেদের উৎপাত আগের মত আবার গেল বেড়ে। বিষয় কি দারোগা কেন নাই? খবর নিয়ে জানা গেল দারোগার সুন্দরী মেয়ে শিউলী অনুর সাথে ভেগেছে, দারোগা সে লজ্জায় কাউকে মুখ দেখাতে পারছেন না। বাবারে বাবা একেবারে ডাইরেক্ট এ্যকশন, কেমনে করল এ কাম অনু? ঘটনার বিবরণে প্রকাশ দারোগা কর্তৃক চুলের কর্তন সাধন বাদ কার পরামর্শে যেন অনু চলার স্টাইল পাল্টে ফেলেছে। কমপ্লিট কোট-টাই-সু আর সানগøাস লাগিয়ে চলাফেরা করে, তাতে নাকি তাকে দারোগার কলেজ পড়–য়া কন্যাটির ভীষণ ভাল লেগে যায়। অতএব দারোগার দারোগাগিরি শেষ বখাটেদের কাটছে সময় বেশ। আসলে বোনের বুদ্ধিতে দেয়া অনুর একটি বিশেষ গিফ্টই নাকি শিউলীকে কাতর করে ফেলেছে, হায়রে বোনের মমতা।
মানুষের চেহারা দেখে সবকিছু বিচার করা যায় না, মুখে এক অন্তরে আরেক তার তো থাকে। প্রকৃতপক্ষে চুলই হচ্ছে সকল সৌন্দর্যের মূল, বাগানে সুন্দর ফুল মাথায় সুন্দর চুল। তাই তো কবিগণ লিখেছেন, চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, তোমার দীঘল কালো চুলে হারিয়ে যায় মন, তোমার কাজল কেশ ছড়াল বলে এই রাত এমন মধুর, ইত্যাদি অনেক বলে শেষ করা যাবে না। নারীর চুল নরকে আকর্ষণ করে নরের চুল নারীকে, তাই চুল নিয়ে চুলোচুলি করে চুলকানি না তুলে চুলের ঝলকানিকেই আমরা গ্রহণ করি। চুল যে কি জিনিস যার নাই কেবল সে’ই বুঝে, টেকোর মনের দুঃখ কেউ বুঝেনা। কিন্তু নজরুলের চুল নিয়ে কোন চুলকানির কারণে কবিগুরু, নজরুল করিয়াছ ভুল না রাখিয়া দাড়ি রাখিয়াছ চুলÑ লিখে ফেললেন বুঝলাম না। থাক সেদিকে মাথা না দেই, বড় মানুষ বড় ব্যাপার আমদের সেদিক না তাকানোই উপকার। আসলে চুলে খালি চুলকানি না চুলের অনেক ঝলকানিও আছে, তবে উকুন আর খুসকি বড়ই যন্ত্রণা। অবশ্য যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে ঠিক তেমন যার চুল আছে সে তার যতœও করে। তাই আসুন চুল নিয়ে চুলোচুলি করে চুলকানি না বাড়িয়ে চুলের ঝলকানিটাই আমরা উপভোগ করি। কিন্তু এটা কি কাÐ, পুলিশ ছুটছেন চোরের পিছে চোর দৌড়ছে পুলিশ দৌড়ছেন, বাহবা ধরে ফেলেছেন কষে চোরের চুল। মাশাল্লাহ্ পাকা শিকারি, ব্যাটা চোর এবার যাবি কোথায়, হেহেহে। ওমাÑ এটা কি, চুল আছে চোর নাই, চোর গেল কোথায়? ও খোদা এটাতো পরচুলাÑ ওরে চুলের চুলকানি কত আর দেখাবি ঝলকানি, ধোঁকা দিয়ে পুলিশকেই বোকা বানালি?

লেখক : কলামিস্ট